প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ০৮ এপ্রিল ২০২৫ ২২:৪৪ পিএম
তারল্য সংকটে থাকা দুর্বল ব্যাংকগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে টাকা ছাপিয়ে তারল্য সহায়তা দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ৯০ দিন মেয়াদের এই টাকা পরিশোধ করার কথা। কিন্তু এখনও তারা এক টাকাও শোধ করতে পারেনি। এমন পরিস্থিতিতে কিছু দুর্বল ব্যাংককে দেওয়া তারল্য সহায়তা নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে ঢাকায় সফররত আন্তর্জাতিক মূদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রতিনিধিদল। তবে তারল্য সহায়তায় আপত্তি থাকলেও তাতে কোনো সমস্যা হবে না বলে মনে করেন দেশের অর্থনীতিবিদরা।
তারা বলেন, যে পদ্ধতিতে তারল্য সহায়তা দেওয়া হয়েছে তাতে আইএমএফ থেকে অর্থ পেতে কোনো সমস্যা হবে না। আইএমএফ এটাকে গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি বলে মনে করে না। এজন্য তারা আপত্তি জানিয়েছে। তবে আইএমএফ অনেক শর্ত দিয়েছে। যেগুলো তারা পর্যালোচনা করে দেখছে। বেশিরভাগ শর্তই পূরণ হয়েছে। দুয়েকটায় হয়তো আপত্তি আছে। এজন্য কিস্তির টাকা পেতে কোনো সমস্যা হবে না।
বৈঠক সূত্রে জানা যায়, ব্যাংক খাতের ওপর গ্রাহকের আস্থা ফেরাতে দুর্বল ব্যাংককে তারল্য সহায়তা দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার কৌশল নিয়ে শুরু থেকেই উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে আইএমএফ। এ সময় আইএমএফ মিশন-পরবর্তী করণীয় নিয়ে রোডম্যাপ জানতে চায়। তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানায়, এই ব্যাংকগুলোর অবস্থার উন্নতি ঘটাতে সব ধরনের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, কয়েকটি ব্যাংককে গ্যারান্টির বদলে সরাসরি টাকা ছাপিয়ে সহায়তা করা হয়েছে। তারপরও যদি উন্নতি না হয় তবে অন্য ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করা হবে। সে পদক্ষেপেও দৃশ্যমান কোনো উন্নতি না ঘটলে ব্রিজ করে ব্যাংকগুলো পর্যায়ক্রমে বন্ধ করে দেওয়া হবে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘প্রমিসরি নোটের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক দুর্বল ব্যাংকগুলোকে তারল্য সহায়তা দিয়েছে। প্রমিসরি নোট হলোÑ একটা চিঠি। একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ফেরত দেয়ার প্রতিশ্রুতিপত্র। এটা তো কোনো বন্ড না। এটাকে গ্রহণযোগ্য কিছু মনে করে না আইএমএফ।’
তিনি বলেন, ‘এটা একটা টেকনিক্যাল মিশন। আর টেকনিক্যাল মিশনে কী ঘটেছে তার মূল্যায়নটা দিয়ে যায়। আমার মনে হয় না এটা দিয়ে ডিল ব্রেকার হবে। যে কিস্তি পুরোপুরি আটকে যাবে। এমন হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এটা নিয়ে আরও হয়তো কিছু আলোচনা হবে। তবে টাকা আটকে যাবে না।’
বৈঠকে উপস্থিত একাধিক কর্মকর্তা জানান, দুর্বল ব্যাংকগুলোর মধ্যে কয়েকটি ব্যাংক গ্রাহকের টাকা ফেরত দেওয়ার নাম করে কলমানিতে বিনিয়োগ করেছে বলে সুনির্দিষ্ট তথ্য রয়েছে। কেউ কেউ নিজেদের বেতন-ভাতার কাজেও তারল্য সহায়তার টাকা ব্যয় করেছে। এসব বিষয় নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে। তবে আইএমএফকে বিষয়গুলো জানানো হয়নি।
গবেষণা ও নীতিসহায়ক সংস্থা ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএফ) সাবেক নির্বাহী পরিচালক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তফা কে মুজেরী প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘আইএমএফের আপত্তি তো আরও অনেক কিছুতেই আছে। তাদের এজেন্ডা তো একটা না। অনেক শর্ত ছিল। রাজস্ব আদায় বাড়ানো, দুর্বল ব্যাংককে সহায়তা, মন্দ ঋণ আদায়Ñ এমন অনেক শর্ত ছিল তাদের। তারা কিন্তু শর্তাবলিগুলো পর্যালোচনা না করে একটা কিস্তিও ছাড় করেনি। যে টিম আসছে, তারা ফেরত গিয়ে কী রিপোর্ট দেয় তার ওপর নির্ভর করছে অর্থ আসা।’
তিনি বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে তারল্য সহায়তা করছে, এটা কতটুকু কাজ করছে সেটা দেখার বিষয়। তারল্য সহায়তার কারণে যদি ব্যাংকগুলো সবল হয়। এখন কতটা সফল হয়েছে, এখন সেটা দেখার বিষয়। এখন আর ব্যাংকগুলো রুগ্ণ নেই। আর সেটা যদি আইএমএফকে বোঝাতে পারে তাহলে তো সমস্যা নেই। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সহায়তার কারণে ব্যাংকগুলো সবল হয়েছে বলে মনে হয় না। আগের মতোই আছে ব্যাংকগুলো। উত্তরণের কোনো লক্ষণ নেই। কোনো সহায়তা তখনই জাস্টিফাই হয়, যখন সেটা কাজে দেয়।’
মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশের নিচে এলে নীতি সুদহার কমবে
দেশের মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশের নিচে এলে নীতি সুদহার (পলিসি রেট) কমিয়ে আনা হবে বলে আইএমএফকে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গতকাল মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নরদের সঙ্গে সংস্থাটির প্রতিনিধিদলের বৈঠকে এই আশ্বাস দেওয়া হয়। সেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি সুদহার কখন কমানো হবে তা জানতে চায় প্রতিনিধিদলটি। জবাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর এ কথা বলেন। বৈঠক শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানান।
মুখপাত্র বলেন, ‘গভর্নরের জবাবের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিনিধিদলটি বলেছে, আমাদের সংস্থারও প্রজেকশন রয়েছে যে চলতি বছরের জুনের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৮.২ শতাংশে নেমে আসবে। আইএমএফ আমাদের সংস্কার প্রস্তাবগুলোর বিষয়ে প্রশংসা করেছে। আমরা দ্রুতই আর্থিক খাতের সংস্কার বাস্তবায়নে বদ্ধপরিকর।’
এ ছাড়া আগামী জুন মাসের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৮ দশমিক ৫ শতাংশের নিচে নেমে আসার পূর্বাভাস দিয়েছে আইএমএফ। পাশাপাশি সফররত আইএমএফ প্রতিনিধিদল সব বিষয়ে সন্তোষজনক উত্তর পাচ্ছে বলে জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রকাশিত হালনাগাদ প্রতিবেদন মতে, ফেব্রুয়ারিতে মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৩২ শতাংশ, যা তার আগের মাস জানুয়ারিতে ছিল ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ। অর্থাৎ বাংলাদেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতির নিম্নমুখী ধারা অব্যাহত।
আরিফ হোসেন খান বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকে আইএমএফের সঙ্গে চলা বৈঠকে মূল্যস্ফীতি নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে সংস্থাটি। এ সময় প্রতিনিধিদলটি আগামী জুন নাগাদ বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি ৮ দশমিক ৫ শতাংশের নিচে নেমে আসবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে। তবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ শুধু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একক সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে না। সরকারের সব অর্গান যখন একসঙ্গে কাজ করে তখনই এটা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয় বলে জানান তিনি।