প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ০৮ এপ্রিল ২০২৫ ২১:৫৭ পিএম
রাজধানীর বনানীতে পিআরআই কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন সিপিডির চেয়ারম্যান ও অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান সোবহান। সংগৃহীত
ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্ক আরোপের কারণে বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের বিকল্প বাজার খোঁজার পরামর্শ দিয়েছেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) চেয়ারম্যান ও অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান সোবহান।
তিনি বলেন, এশিয়ার দেশ বিশেষ করে উদীয়মান পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো বাংলাদেশের পণ্যের ভালো বিকল্প বাজার হতে পারে। মার্কিন শুল্ক সংক্রান্ত এক আলোচনায় সভায় এ মূল্যায়ন তুলে ধরেছেন এই অর্থনীতিবিদ।
মঙ্গলবার (৮ এপ্রিল) রাজধানীর বনানীতে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ‘শুল্ক কারসাজির যুগে বাণিজ্যনীতি, বাংলাদেশ ও বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিত’ শীর্ষক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে অধ্যাপক রেহমান সোবহান আরও বলেন, ‘যারা বিশ্বায়ন শুরু করেছিল, অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র, সেই তারা আজ বিশ্বায়ন ব্যবস্থা ফেলে দিচ্ছে। এ বাস্তবতায় বাংলাদেশসহ অন্যদের টিকে থাকতে হবে। এত দিন বিশ্বব্যবস্থা একভাবে চলেছে; এখন বিশ্বব্যবস্থা আরেকভাবে চলবে।’
তিনি বলেন, ‘এখন আর সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট নয়, অর্থাৎ সেরা মানুষেরা টিকে থাকবে এই নীতি নয়, বরং যারা সবচেয়ে ভালো আলোচনা বা চুক্তি করতে পারবে, তারাই টিকে থাকবে।’
সেমিনারে ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্ক আরোপের ঘোষণা সমালোচনা করে অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বাণিজ্যের বিষয়টিকে এখন অস্ত্রে রূপান্তরিত করেছে। এ ধরনের শুল্কারোপ অন্যায্য এবং বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা ডব্লিউটিওর নীতির প্রতি অবহেলা। তবে শেষ পর্যন্ত এ শুল্ককাঠামো টেকসই হবে না। খোদ যুক্তরাষ্ট্রই এ পদক্ষেপ থেকে কোনো সুফল পাবে না।
ট্রাম্প যেভাবে দ্বিপক্ষীয় পর্যায়ে বাণিজ্য ঘাটতি মোকাবিলার চেষ্টা করছেন, পৃথিবীর ইতিহাসে তা বিরল ঘটনা। এমন ঘটনা আগে কখনও দেখা যায়নি। এর মধ্য দিয়ে বাজার অর্থনীতি ছুড়ে ফেলে দিলেন তিনি।’
গত ২ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনতে বিশ্বের সব দেশের পণ্যে পাল্টা শুল্ক আরোপ করেন। বাংলাদেশের পণ্যে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে ৩৭ শতাংশ। এর প্রেক্ষিতে এই সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়।
ট্রাম্পে যেভাবে বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে চাচ্ছেন, সেভাবে ঘাটতি কমানো সম্ভব নয় বলে মনে করেন রেহমান সোবহান। বাংলাদেশও যেভাবে উচ্চ শুল্কের খড়্গ থেকে বাঁচতে রপ্তানি বৃদ্ধির কথা বলেছে, তা বাজার অর্থনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় বলে তার মন্তব্য।
তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে কটন বা সুতা আমদানি করা হয় বিনা শুল্কে। সেই সুতা দিয়ে তৈরি পোশাক বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়। কিন্তু আমরা কি চাইলেই যুক্তরাষ্ট্র থেকে সুতা আমদানি বাড়াতে পারব? আমরা বিভিন্ন ধরন, দাম ও বাজারের জন্য পোশাক উৎপাদন করি। ফলে সব পোশাক মার্কিন সুতা দিয়ে তৈরি করা যাবে না; কমান্ড ইকোনমির মতো হুকুম দিয়ে তো এই আমদানি বাড়ানো সম্ভব নয়।
সেমিনার সঞ্চালনা করেন পিআরআইয়ের চেয়ারম্যান জাইদী সাত্তার। এ সময় তিনি বলেন, ‘নতুন করে বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ইতিহাসে এটা খারাপ অধ্যায় হয়ে থাকবে। এটা শেষ ধাক্কা। আমরা কীভাবে সেখান থেকে বের হব, সেটা কেউ জানে না। যুক্তরাষ্ট্রও বাণিজ্য ঘাটতিতে আছে, তারা যা উৎপাদন করে, তার চেয়ে বেশি খরচ করে। বাংলাদেশ চলতি হিসাবের ঘাটতিতে আছে, অর্থাৎ আমরা সঞ্চয়ের চেয়ে বেশি বিনিয়োগ করছি। এটা খারাপ কিছু নয়।’
জাইদী সাত্তার আরও বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র বলছে, বাংলাদেশের করভার অনেক; নিয়মনীতিতে স্বচ্ছতা নেই। দুর্নীতি আছে, মেধাস্বত্ব অধিকার নেই। সরকার কর কমিয়ে দিতে পারবে। কিন্তু এর বাইরে যে সমস্যাগুলো আছে, তার সমাধান হবে কীভাবে।’
তিনি বলেন, তাদের (ট্রাম্প প্রশাসনের) মতে, বাংলাদেশের রেজিম খুব রেস্ট্রিক্টেড। এখানে করাপশন আছে। অশুল্ক বাধা আছে। নন-ট্যারিফ ব্যারিয়ার ইনগ্নোর করা যাবে না। ট্যারিফ কীভাবে কমাব সেটা আলোচনা করা যায়।
সেমিনারে প্যানেল আলোচনায় বক্তব্য রাখেন গবেষণা সংস্থা সানেমের নির্বাহী পরিচালক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান, গবেষণা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট (র্যাপিড) চেয়ারম্যান ড. আব্দুর রাজ্জাক, সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান, বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী (পারভেজ)।
র্যাপিডের নির্বাহী পরিচালক ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘বাংলাদেশ, ভিয়েতনামসহ যুক্তরাষ্ট্র রপ্তানিতে প্রতিযোগী দেশগুলোর গড় শুল্ক ৪০ শতাংশ হয়েছে। এতে সামনের দিনগুলোতে পণ্যের দাম ১০ শতাংশ বাড়বে। যার ফলে ২৫ শতাংশ চাহিদা কমবে। তাই রপ্তানিকারকদের উচিত অন্য মার্কেটগুলোতে কীভাবে পণ্যের দাম ধরে রাখা যায়।’
তিনি বলেন, ‘যুদ্ধ ব্যয়বহুল তাই জিওইকোনমিক্স শুরু হচ্ছে। এটা নিয়ে আলোচনা শুরু হয় ১৯৯০ সালে। আমাদের সবকিছু এই আঙ্গিকে দেখতে হবে। এটা সামরিক যুদ্ধের চেয়ে ভয়াবহ। আনইকুয়াল নেগোসিয়েশনের পরিণতি ভয়াবহ হবে। ভিয়েতনাম, ইন্ডিয়ার মতো আমদানি আমরা করতে পারব না। ভিয়েতনাম যা পারবে আমরা তা পারব না। ট্রাম্প হয়তো ধরে রাখতে পারবে না। সরে আসবে। বাট প্রবণতা থাকবে। ট্রেড ওয়েলফেয়ার কস্ট হয়ে যাবে। ট্রেড হবে ওয়েলফেয়ার লজ ইকোনমি।’
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আনোয়ারুল আলম পারভেজ বলেন, ‘ট্রাম্পের এই কাজ এখানে শেষ হবে না। কেন এত দ্রুত চিঠি দিলাম? কর কমিয়ে দিয়ে সুবিধা নিতে পারব তো? যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট ফার্ম ছাড়া কাজ হয় না। অনেক দেশ সে পথেই হাঁটে। আমেরিকাকে কর কমায় দিলাম। তাহলে ইউরোপের সঙ্গে কী হবে? আমাদের ডিউটি ফ্রি কটনে ডিউটি ফ্রি পোশাক কেন যাচ্ছে না। এটা বলতে হবে তাদের। বাংলাদেশে ওয়্যারহাউস সুবিধার দাবি তাদের বহুদিনের। সেটা দিতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘ধরে নিতে হবে, বাণিজ্য ঘাটতি খুব কমবে না। অথবা সে যেখানে বেশি সুবিধা পাবে সেখানে সুবিধা দেবে। কিন্তু আমাকে আমার নিজেকে বাঁচাতে হবে। অন্য বাজারে যেন বিপদে না পড়ি। আমাকেও কম্পিটিটিভ হতে হবে। নিজেদের অযৌক্তিক খরচ কমাতে হবে।’
সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো প্রফেসর মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় যেতে হবে। চিঠি দেওয়া ভালো পদক্ষেপ। তবে কোন কোন পণ্য নিয়ে আলোচনা হবে তার সিদ্ধান্ত দরকার। তাদের আগ্রহ জানতে হবে। শুধু ইউএসের জন্য কিছু করতে হবে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি লাগবে। নিজেদের পরিস্থিতিও উন্নত করতে হবে। বাণিজ্যকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছেন ট্রাম্প।’
বিজিএমইএ পরিচালনা কমিটির সদস্য শামস মাহমুদ বলেন, ‘সরকার ধীরে চলছে। এটা উদ্বেগজনক। ওখানে মূল্যস্ফীতি হবে। ভোগ কমে যাবে।’