আহমেদ ফেরদাউস খান
প্রকাশ : ০৬ এপ্রিল ২০২৫ ২২:৩৪ পিএম
যুক্তরাষ্ট্রের নতুন রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ বা শুল্ক আরোপ ঘোষণার পর থেকেই বৈশ্বিক অর্থনীতিতে নতুন অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। এ ঘোষণার পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও এশিয়ার পুঁজিবাজারে টানা দরপতন ঘটছে। দেশের পুঁজিবাজারে শুল্ক আরোপের প্রভাব পড়ার আশঙ্কা কম। তবে দেশের পুঁজিবাজারে যে দরপতন ঘটছে, সেটা ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের কারণে নয়। এটা ঘটছে অভ্যন্তরীণ নানা কারণে। তাই এ বিষয়ে বিনিয়োগকারীদের আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।
তারা বলছেন, এমন পরিস্থিতিতে দেশের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের আতঙ্কের কিছু নেই। বাংলাদেশের রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক কোম্পানিগুলোর অধিকাংশই পুঁজিবাজারে নেই। আর পুঁজিবাজারে যেসব কোম্পানি তালিকাভুক্ত রয়েছে সেগুলোর ইউরোপে বড় বাজার রয়েছে। তবে যেসব কোম্পানি ডেনিম পণ্য রপ্তানি করে সেগুলোর বড় অংশ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে যায়। সেসব পণ্যের ক্ষেত্রে কিছুটা প্রভাব পড়তে পারে। এ ছাড়া বর্তমানে দেশের পুঁজিবাজার সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে। তাই এ ধরনের ঘোষণার প্রভাব খুব বেশি পড়ার সুযোগ নেই। বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কিত না হলে দ্রুত এ শঙ্কা থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব।
গত ২ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পাল্টা শুল্কারোপের ঘোষণা দেন। ঈদের ছুটির কারণে লেনদেন বন্ধ থাকায় দেশের পুঁজিবাজারে এতদিন শুল্কারোপের ধাক্কা লাগেনি। গতকাল রবিবার ঈদের ছুটি শেষে দেশের উভয় পুঁজিবাজার খুলেছে। তবে লেনদেন শুরুর আধা ঘণ্টায় বিনিয়োগকারীদের আতঙ্কিত হয়ে শেয়ার বিক্রির চাপ লক্ষ করা গেছে। এতে ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই-সিএসই) সূচকে পতনমুখী প্রবণতা দেখা যায়। তবে এরপর থেকেই সূচকের নেতিবাচক প্রবণতা ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে। দিনের লেনদেনের শেষে সেই শঙ্কা কাটিয়ে উঠেছে পুঁজিবাজার।
দেশের ওপর চলমান শুল্কহার গড়ে ১৫ শতাংশ। এর সঙ্গে যোগ হতে পারে নতুন আরোপ করা ৩৭ শতাংশ। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের পণ্যের ওপর প্রায় ৫২ শতাংশ শুল্ক বসবে। দেশের পুঁজিবাজারে বর্তমানে বস্ত্র খাতের ৫৮টি ও চামড়া খাতের ৬টি কোম্পানি তালিকাভুক্ত রয়েছে। এর মধ্যে পুঁজিবাজারের মোট বাজার মূলধনের ৩.৪০ শতাংশ বস্ত্র এবং ০.৬০ শতাংশ চামড়া খাতের দখলে রয়েছে। সব মিলিয়ে এ দুই খাতের দখলে রয়েছে মোট বাজার মূলধনের ৪ শতাংশ।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) প্রেসিডেন্ট সাইফুল ইসলাম প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্কারোপ ঘোষণার প্রভাব খুব বেশি পড়ার সুযোগ নেই। বর্তমানে দেশের পুঁজিবাজার যে পর্যায়ে রয়েছে, এর চেয়ে খুব বেশি নিম্নমুখী হওয়ার সুযোগ দেখছি না। এ বিষয়ে বিনিয়োগকারীদের আতঙ্কিত না হওয়া জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।’
গতকাল সকালে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের অর্থ উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্ক আরোপের ফলে অর্থনীতিতে যে প্রভাব পড়বে তা সামাল দেওয়া কঠিন হবে না। এটি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনের সঙ্গে নেগোসিয়েশনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ভালো কিছু হবে বলে আশাবাদী।’
বাংলাদেশ ক্যাপিটাল মার্কেট ইনভেস্টর অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান মুখপাত্র মো. নুরুল ইসলাম মানিক বলেন, ‘মার্কিন নতুন রিসিপ্রোকাল ট্যারিফ নীতির অংশ হিসেবে শুল্ক আরোপকে কেন্দ্র করে পৃথিবীর অনেক দেশের পুঁজিবাজারে ধস নেমেছে। আমাদের পুঁজিবাজার সেই শঙ্কার বাইরে নয়। তবে আমাদের পুঁজিবাজার বর্তমানে সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে। তাই এর চেয়ে খুব বেশি নিচে নামার সুযোগ কম। আশা করছি শিগগিরই এ শঙ্কা থেকে মুক্ত হবে দেশের পুঁজিবাজার।’
মিডওয়ে সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আশিকুর রহমান প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের পরিস্থিতি অতটা খারাপ না। ট্রাম্পের শুল্কের প্রভাব তেমন একটা পড়েনি। আমাদের বাজার এমনিতেই পতনের মধ্যে ছিল। এ ছাড়া ঈদের বড় একটা ছুটির কারণে সবাই এখনও কাজ শুরুও করেনি। সরকার যেভাবে বিষয়টা নিয়ে কাজ করছে তাতে আমার মনে হয় আতঙ্ক যা ছিল তা কেটে গেছে। এমনিতেই মার্কেট ডাউন, আর এই ডাউনের মধ্যে আপনি খারাপ খবর দিলেই যে আরও খারাপ হবে। তবে এটা আমাদের বাজারের জন্য প্রযোজ্য নয়।’ তিনি বলেন, ‘এমনিতেই গ্লোবাল পুঁজিবাজারের সঙ্গে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের সম্পর্ক খুবই কম। আমাদের বাজারে বিদেশি বিনিয়োগকারী বলতে গেলে নেই। গ্লোবালি আমাদের ডিসকানেকড আছে। লং টাইমে পজেটিভ-নেগেটিভ প্রভাব পড়তে পারে। তবে শর্ট টাইমে পড়ার আশঙ্কা নেই। আজকে মার্কেটে এই শুল্কের প্রভাব একেবারেই নেই।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের বাজারে এর ইমপ্যাক্ট খারাপ কিছুই হবে না। এখন অনেক কিছু নির্ভর করে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কী রকম থাকবে তার ওপর। সরকার যদি নেগোশিয়েট করে তাড়াতাড়ি সমস্যা সমাধান করতে পারে, তাহলে আমাদের দেশের জন্য ভালো। তবে পোশাক শিল্পে বড় কোনো প্রভাব পড়বে বলে মনে হয় না। কারণ আমাদের পোশাকের প্রাইজ অনেক ভালো। এটা বড় বেনিফিট। আর আমাদের প্রতিযোগিতা হচ্ছে ভিয়েতনাম, পাকিস্তান, কম্বোডিয়ার সঙ্গে। কিন্তু তারা আমাদের প্রাইজের সঙ্গে টিকতে পারবে না। তা ছাড়া তাদেরও শুল্ক বেড়েছে। অর্ডার বেশি শিফট হবে বলে মনে হয় না।’
সরকারি প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) চেয়ারম্যান ও পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবু আহমেদ প্রতিদিনের বাংলাদেশেকে বলেন, ‘বাংলাদেশের পুঁজিবাজার আজ (রবিবার) যা হয়েছে, তা সাময়িক। শুল্কের কারণে বাংলাদেশের বেশি ক্ষতির কিছু দেখি না। আমরা যে পোশাক রপ্তানি করি, তা ভিয়েতনাম, পাকিস্তান, ভারতও রপ্তানি করে। তাদের ওপরও শুল্ক বসানো হয়েছে। এ ছাড়া আমরা কম মূল্যের পোশাকের আইটেমগুলো রপ্তানি করি। যেগুলো মধ্যবিত্তরা পরে। ওইগুলোর চাহিদা কমার তেমন কোনো কারণ নেই। প্রাইস বাড়লেই চাহিদা কমেÑ সব ক্ষেত্রে হয় না। কারণ এটা অ্যাসেনশিয়াল। এটা যুক্তরাষ্ট্রের ভোক্তাদের জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মতো। হাই ভেল্যুর আইটেমগুলোর চাহিদা কিছুটা কমতে পারে। কিন্তু লো ভেল্যুর আইটেমগুলোর চাহিদা কমবে না।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতিতে শুল্ক আরোপের তেমন প্রভাব পড়বে না এবং বাংলাদেশের পুঁজিবাজারেও প্রভাব পড়বে না। বাংলাদেশের পুঁজিবাজার এমনিতেই ভালো অবস্থানে নেই। আজ (রবিবার) সূচকের পতন হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে শুল্ক বাড়ানোর জন্য নয়। এটা অভ্যন্তরীণ কারণে হয়েছে।’