আরমান হেকিম
প্রকাশ : ১৮ মার্চ ২০২৫ ০৯:৫৬ এএম
আপডেট : ১৮ মার্চ ২০২৫ ১০:৫৭ এএম
গ্রাফিক্স, প্রবা
দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ কমাতে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের জন্য আটটি নতুন প্রকল্পের প্রস্তাব দিয়েছে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ (ইএমআরডি)। প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে দেশীয় গ্যাস উৎপাদন বাড়িয়ে ব্যয়বহুল এলএনজি আমদানির ওপর নির্ভরতা কমানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বাপেক্সের সক্ষমতা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী, এসব প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১৩ হাজার ৬৯৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে পাঁচটি প্রকল্পের জন্য ৪ হাজার ৯৩৬ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যা মূলত সিসমিক সার্ভে এবং অনুসন্ধানের মাধ্যমে গ্যাসের নতুন মজুদ খুঁজে বের করার জন্য ব্যয় করা হবে। এ ছাড়া বাপেক্স ও বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তরের (জিএসবি) অনুসন্ধান সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য আরও দুটি প্রকল্পে ৮৫৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে।
অন্যদিকে দেশের সবচেয়ে বড় গ্যাস বিতরণ কোম্পানি তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (টিজিডিটিসিএল) নেটওয়ার্ক উন্নয়নের জন্য একটি পৃথক প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, যার ব্যয় ধরা হয়েছে ৭ হাজার ৯০৪ কোটি টাকা। এই প্রকল্পের মাধ্যমে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জসহ আশপাশের অঞ্চলে গ্যাসের লিকেজ প্রতিরোধ, কম চাপের সমস্যা সমাধান এবং জিআইএস ম্যাপিং ও এসসিএডিএ সিস্টেম সংযোজন করা হবে।
সরকারের পরিকল্পনা কমিশন চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (আরএডিপি) প্রকল্পগুলোকে অননুমোদিত তালিকায় রেখেছে, যা ভবিষ্যতে অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে গ্যাস আমদানির ওপর নির্ভরতা কমবে এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সুরক্ষিত থাকবে। তবে প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন ও পরিচালনার সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশ্লেষকরা।
প্রকল্প বাস্তবায়নে বাধা বাপেক্সের সীমাবদ্ধতা
সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০২৮-২৯ অর্থবছরের মধ্যে ২৩টি প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, যার মধ্যে ১৫টি কূপ খননের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে দেশীয় গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে প্রধান দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি লিমিটেডের (বাপেক্স) সক্ষমতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা।
বর্তমানে বাপেক্সের জনবল ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা সীমিত, যা এত বড় পরিসরের প্রকল্প বাস্তবায়নে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। নতুন প্রকল্পের আওতায় ২ হাজার হর্সপাওয়ারের দুটি নতুন রিগ কেনার পরিকল্পনা থাকলেও দক্ষ জনবল ও কার্যকর ব্যবস্থাপনা ছাড়া এগুলো যথাযথভাবে ব্যবহার করা সম্ভব হবে না বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বাপেক্স সূত্র বলছে, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দুটি অনুসন্ধান কূপ খনন ও দুটি ওয়ার্কওভার (কূপে একধরনের সংস্কার) মিলে চারটি খননযন্ত্র কিনে দেয় সরকার। এর মধ্যে সর্বশেষ অনুসন্ধান খননযন্ত্রটি কেনা হয়েছে ২০১২ সালে। এখন কোম্পানির মোট খননযন্ত্র আছে ছয়টি।
এর মধ্যে অনুসন্ধান কূপ খনন করার মতো যন্ত্র মোটে দুটি, যা দিয়ে বছরে সর্বোচ্চ তিনটি কূপ খনন করা যাবে। যদিও জমি অধিগ্রহণ এবং ভূমি উন্নয়নে দীর্ঘসূত্রতার কারণে সেটিও সম্ভব হয় না।
বাকি চারটির মধ্যে দুটি অনুসন্ধান খননযন্ত্র নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। এর একটি ১৯৮৪ সালের, যা মেরামতে রাজি হয়নি কোনো বিদেশি ঠিকাদার। আর ১৯৮৭ সালেরটি মেরামতের আলোচনা চলছে। তবে মেরামত হলেও তা দিয়ে আর অনুসন্ধান করা যাবে না। পুরোনো কূপের সংস্কারে এটি কাজে লাগানো হবে। বাকি দুটি ওয়ার্কওভার কূপ খননে ব্যবহৃত হচ্ছে। অন্যদিকে ভারতীয় ওএনজিসির এখন খননযন্ত্র আছে ১৫০টি।
একটি অনুসন্ধান কূপ খনন করতে বাপেক্সের যা খরচ হয়, তার প্রায় তিনগুণ নিচ্ছে রাশিয়ার কোম্পানি গাজপ্রম। এখন পর্যন্ত ২০টির মতো কূপের কাজ দেওয়া হয়েছে গাজপ্রমকে। আরও কূপ খননের কাজ পেতে পারে এ বিদেশি সংস্থা।
পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেন, আগের আওয়ামী লীগ সরকার দেশীয় গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন ইচ্ছাকৃতভাবে স্থগিত রেখেছিল এবং ব্যয়বহুল এলএনজি আমদানির ওপর নির্ভর করেছিল।
তিনি বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশীয় গ্যাস উত্তোলন বাড়ানো ও নতুন ক্ষেত্র অনুসন্ধানের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে, তবে বাপেক্সের সক্ষমতা বাড়ানো জরুরি।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, গত এক দশকে পর্যাপ্ত বিনিয়োগের অভাবে বাপেক্সের সক্ষমতা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়েনি, বরং বিদেশি কোম্পানির ওপর নির্ভরতা বেড়েছে। বর্তমানে বাপেক্সের সীমিত প্রযুক্তিগত সক্ষমতার কারণে বিদেশি কোম্পানিগুলো গ্যাস উৎপাদনের ৯০ শতাংশ নিয়ে যাচ্ছে, যা দীর্ঘমেয়াদে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।
অন্য দেশের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা
বিশ্বের অনেক দেশ গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে স্থানীয় কোম্পানিগুলোর সক্ষমতা বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ভারত এবং ইন্দোনেশিয়া দেশীয় কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে গ্যাস উত্তোলন বাড়িয়ে আমদানি-নির্ভরতা কমিয়েছে।
বাংলাদেশেও একই পথ অনুসরণ করা প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, গ্যাস অনুসন্ধান, উত্তোলন ও বিতরণ কার্যক্রমের জন্য মূল্য নির্ধারণ এবং সরকারি সংস্থার মাধ্যমে প্রকল্প বাস্তবায়ন নিশ্চিত করলে ব্যয় কমানো সম্ভব হবে।
তিনি বলেন, অনুমোদনের পাশাপাশি প্রকল্প বাস্তবায়নেও সমান গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ পরিকল্পনার অভাবে অনেক প্রকল্প সময়মতো বাস্তবায়িত হয় না, ফলে ব্যয় অনেকগুণ বেড়ে যায়।
সরকারের নেওয়া নতুন প্রকল্পগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হলে দেশীয় গ্যাস উৎপাদন বাড়বে এবং আমদানি-নির্ভরতা কমবে। তবে বাপেক্সের সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে কার্যকর বাস্তবায়ন নিশ্চিত না হলে এই প্রকল্পগুলো প্রত্যাশিত সুফল নাও দিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সরকারের নতুন উদ্যোগকে স্বাগত জানালেও বিশ্লেষকরা মনে করছেন, শুধু প্রকল্প অনুমোদন দিলেই হবে না, বরং প্রকল্পগুলোর স্বচ্ছ ও দক্ষ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা জরুরি। বিশেষ করে, বাপেক্সের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য পৃথক দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
সূত্র জানায়, জাতীয় গ্রিডে বর্তমানে প্রতিদিন ২৬০ কোটি ঘনফুটের মতো গ্যাস যুক্ত হচ্ছে। এর মধ্যে বাপেক্স সরবরাহ করছে সাড়ে ১৪ কোটি ঘনফুট। চলমান ২২টি কূপ খননের প্রকল্প থেকে আরও ২৮ কোটি ১০ লাখ ঘনফুট গ্যাস যুক্ত করার কথা রয়েছে। এ ছাড়া ৬৮টি কূপ থেকে আরও ১০৭ কোটি ঘনফুট। সব মিলিয়ে ২০২৮ সাল নাগাদ জাতীয় গ্রিডে বাপেক্সের মোট গ্যাস সরবরাহ লক্ষ্যমাত্রা দাঁড়াবে ১৫০ কোটি ঘনফুট।