প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১৬ মার্চ ২০২৫ ২২:০৪ পিএম
আপডেট : ১৭ মার্চ ২০২৫ ১০:৪৪ এএম
এখন থেকে ৪৫ বছর পূর্ণ হওয়ার আগে কেউ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হতে পারবেন না। এমডি নিযুক্তির দুই মাস আগে প্রয়োজনীয় নথিপত্রসহ নিয়োগ প্রস্তাব কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পাঠাতে হবে। সম্প্রতি এমডি পদে নিয়োগের নীতিমালা জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেখানে এমডি নিয়োগের পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা জারি করে সংস্থাটি। বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের জারীকৃত প্রজ্ঞাপনকে ইতিবাচক হিসেবে নিলেও অনেক বিষয়েই নিজেদের অস্বস্তি প্রকাশ করেছেন। এমডি হতে ন্যূনতম ৪৫ বছর বয়ষসীমা নির্ধারণ করায় বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। এই নীতিমালা অযৌক্তিক, অনৈতিক এবং বৈষম্যমূলক বলে আখ্যা দিয়ে ব্যাপক সমালোচনা করেছেন ব্যাংক খাতের অভ্যন্তরীণ বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদরা।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলেন, এমডি নিয়োগে একটি পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা থাকার বিষয়টি ইতিবাচক। কিন্তু নীতিমালায় এমন অনেক শর্ত দেয়া হয়েছে, যেগুলো আমলে নিলে ব্যাংকের জন্য এমডি খুঁজে পাওয়া যাবে না। যোগ্য ও দক্ষ ব্যাংক কর্মকর্তারা এমডি হতে চাইবে না। প্রজ্ঞাপনের অনেক শর্তে ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদের স্বাধীনতা ও ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছে। দেশের রাষ্ট্রপতি হতে ৩৫ বছর, সংসদ সদস্য বা মন্ত্রী হতে ২৫ বছর এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হওয়ার জন্য কোনো ন্যূনতম বয়সসীমা নেই। কিন্তু ব্যাংকগুলোর এমডি হতে ৪৫ বছর বয়স পুরোপুরি অযৌক্তিক। ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের মূল যোগ্যতা হওয়া উচিত অভিজ্ঞতা, দক্ষতা এবং নেতৃত্বগুণÑ শুধুমাত্র নির্দিষ্ট বয়স নয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি ব্যাংক কর্মকর্তা প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদগুলোতে কম বয়সে দায়িত্ব নেওয়ার সুযোগ থাকলেও একটি বেসরকারি ব্যাংকের এমডি হতে গেলে অতিরিক্ত ১০-২০ বছর অপেক্ষা করতে হবে, যা অযৌক্তিক। বিশ্বব্যাপী অনেক সফল ব্যাংক প্রধান ৪৫ বছরের আগেই এমডি অথবা সিইও হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের গোল্ডম্যান স্যাক্সে ডেভিড সলোমন ৪৪ বছর বয়সে এমডি হন। অস্ট্রেলিয়ার ম্যাককোয়ারি ব্যাংকে ৪৩ বছর বয়সে এমডি হন শেমারা উইক্রামনায়া। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের সিটি ব্যাংকে জেন ফ্রেজার এমডির দায়িত্ব পান ৪৪ বছর বয়সে। তরুণ ও উদ্যমী পেশাজীবীরা বয়সের কারণে নেতৃত্বের সুযোগ হারাবেন, যা ব্যাংকিং খাতের ভবিষ্যতের জন্য ক্ষতিকর। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হতে বয়সের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই, অথচ একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রধান হতে ৪৫ বছর বয়স বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এটি সুস্পষ্ট নীতিগত বৈষম্য।
তবে প্রজ্ঞাপন প্রস্তুতের সঙ্গে সম্পৃক্ত বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, ‘দেশের ব্যাংকগুলোর এমডিরা অনেক বেশি বেতন পান, যা দেশের আর্থসামাজিক পরিস্থিতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। মাসে ১৫-২০ লাখ টাকা বেতনের বাইরেও ব্যাংক থেকে বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা নেন। এ কারণে কোনো এমডিই চাকরি ছাড়তে চান না। চাকরি বাঁচাতে তারা চেয়ারম্যান ও পরিচালকদের যেকোনো অন্যায় আবদার নির্দ্বিধায় মেনে নেন। অনেক ব্যাংকের এমডিই লুটেরাদের সহযোগীর ভূমিকা পালন করছেন। জারীকৃত প্রজ্ঞাপনটি বাস্তবায়ন করা গেলে এমডিদের চাকরিতে স্বচ্ছতা আসবে। একই সঙ্গে এমডিরাও চাকরির ক্ষেত্রে সুরক্ষা পাবেন।’
প্রজ্ঞাপনে ব্যাংক এমডিদের নিয়োগ বা পুনর্নিয়োগের যোগ্যতা ও উপযুক্ততার বিষয়ে বলা হয়, ফৌজদারি আদালতে দণ্ডিত কিংবা জাল-জালিয়াতি, আর্থিক অপরাধ বা অন্যান্য অবৈধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত কোনো ব্যক্তি ব্যাংকের এমডি হতে পারবেন না। এমডি সম্পর্কে কোনো দেওয়ানি বা ফৌজদারি মামলায় আদালতের রায়ে কোনো বিরূপ পর্যবেক্ষণ বা মন্তব্য থাকবে না। কোনো নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের বিধিমালা, প্রবিধান বা নিয়মাচার লঙ্ঘনের কারণে দণ্ডিত না হওয়ার বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে। অবসায়ন বা লাইসেন্স বাতিল হয়েছে এমন কোনো কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানের মালিকানার সঙ্গে যুক্ত থাকার ইতিহাস থাকলেও কেউ এমডি হতে পারবেন না। কোনো কোম্পানি বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন বা লাইসেন্স বাতিলের সঙ্গে কারো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অপরাধ জড়িত থাকার ইতিহাস থাকলে তাকেও ব্যাংকের এমডি হিসেবে নিয়োগ দেয়া যাবে না। সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে তার পরিবারের কোনো সদস্য থাকতে পারবে না। এমডি হতে হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ব্যাংকিং পেশায় সক্রিয় কর্মকর্তা হিসেবে কমপক্ষে ২০ বছরের অভিজ্ঞতাসহ ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীর ঠিক আগের পদে কমপক্ষে দুই বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, এমডি হতে হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ন্যূনতম বয়স হবে ৪৫ বছর। কোনো ব্যক্তির বয়স ৬৫ বছর অতিক্রান্ত হলে তিনি কোনো ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পদে থাকতে পারবেন না। সাধারণভাবে এমডি পদের মেয়াদ হবে তিন বছর। তবে তিনি পুনর্নিয়োগের যোগ্য হবেন। পুনর্নিয়োগের সময় প্রার্থীর বয়স ৬৫ বছর পার হতে যদি তিন বছরের কম সময় থাকে, তাহলে ওই সময়ের জন্যও তাকে নিয়োগ দেয়া যাবে। তবে ব্যাংক থেকে যে মেয়াদের জন্যই প্রস্তাব করা হোক না কেন, প্রার্থীর সাক্ষাৎকার নিয়ে তার উপযুক্ততা পরীক্ষার পর বাংলাদেশ ব্যাংক যে মেয়াদের জন্য সুপারিশ করবে, সে মেয়াদের জন্যই তাকে ব্যাংক এমডি হিসেবে নিয়োগ দেবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শর্তে আরো বলা হয়, এমডি পদে নিযুক্তি বা পুনর্নিযুক্তির জন্য ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ হ্রাস এবং অবলোপনকৃত ঋণ আদায়ের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা যুক্ত করতে হবে। সময়ে সময়ে এর অগ্রগতি পরিবীক্ষণ করতে হবে। একই সঙ্গে ওই পদে নিযুক্ত ব্যক্তির কর্ম মূল্যায়নের লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট আর্থিক ও ব্যবস্থাপনাগত উন্নতি তথা অন্যান্য কর্মসম্পাদন সূচক বা নির্দেশক যুক্ত করতে হবে। আমানতকারী, ব্যাংক বা জনসাধারণের স্বার্থে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সময় সময় যেসব বিশেষ দায়িত্ব বা লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেয়া হবে, নিয়োগের ক্ষেত্রে সেটিকেও কর্মসম্পাদন সূচক হিসেবে যুক্ত করতে হবে।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, এমডিদের উৎসব ভাতা হবে সর্বোচ্চ দুটি। প্রতিটি এক মাসের মূল বেতনের অধিক হবে না। লিভ-ফেয়ার অ্যাসিস্ট্যান্স এক মাসের মূল বেতনের অধিক হবে না। প্রধান নির্বাহীর নিয়োগপত্রে উল্লেখিত চাকরির মেয়াদকালে বেতন-ভাতার কোনো শর্ত পরিবর্তন করা যাবে না মর্মে শর্ত আরোপ করতে হবে। তবে পুনর্নিযুক্তির ক্ষেত্রে কর্ম-উৎকর্ষ বিবেচনায় বেতন-ভাতা পুনর্নির্ধারণের প্রস্তাব করা যাবে। প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা অন্য কোনো পরোক্ষ সুবিধা যেমন ব্যাংকের মুনাফার বিপরীতে কোনো লভ্যাংশ, কমিশন, ক্লাবের জন্য কোনো চাঁদা বা খরচ, বিদেশে চিকিৎসা খরচ বা বার্ষিক মেডিকেল চেকআপ বাবদ খরচ, বিদেশে পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসা খরচ, ব্যক্তিগত ভ্রমণের ক্ষেত্রে নিজের বা পরিবারের সদস্যদের বিদেশ ভ্রমণ ভাতা প্রাপ্য হবেন না। তবে তিনি নিজে বিদেশে (এশিয়ার যেকোনো দেশে) চিকিৎসা নিতে পারবেন। এক্ষেত্রে দেশের চিকিৎসা যথেষ্ট নয় মর্মে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের প্রত্যয়ন জমা দিতে হবে। নিয়োগ চুক্তিভিত্তিক হওয়ায় চুক্তির মেয়াদকালে প্রধান নির্বাহীরা বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি বা ইনক্রিমেন্ট, প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটি সুবিধা, নববর্ষ ভাতা, ছুটি নগদায়ন, সুপারঅ্যানুয়েশন ফান্ড, বেনোভোলেন্ট ফান্ড ইত্যাদি সুবিধা প্রাপ্য হবেন না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জারীকৃত প্রজ্ঞাপনকে স্বাগত জানিয়ে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘আগে এমডি পদে নিয়োগ ও এমডিদের দায়দায়িত্বের বিষয়ে এত বেশি বিস্তৃত কোনো নীতিমালা ছিল না। জারীকৃত প্রজ্ঞাপনে অনেক বিষয়ই স্পষ্ট করা হয়েছে। তবে প্রজ্ঞাপনে এমন অনেক শর্তও আরোপ করা হয়েছে, যেগুলো পালন করতে গিয়ে সমস্যা হতে পারে।’
জানতে চাইলে গবেষণা ও নীতিসহায়ক সংস্থা ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএফ) সাবেক নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তফা কে মুজেরী প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘যে কোন ব্যাংকের এমডি হতে গেলেই অভিজ্ঞতা দরকার। বয়সে থেকেও অভিজ্ঞতাকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। ৪০ বছর বয়সে যদি কেউ এমডি হওয়ার দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারে- তাহলে তার এমডি হতে বাধা থাকার কথা না। তাই বয়সকে নয়, গুরুত্ব দেওয়া উচিত অভিজ্ঞতা ও কাজের দক্ষতাকে।’