× ই-পেপার প্রচ্ছদ সর্বশেষ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি শিক্ষা ধর্ম ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

ট্যানারি খাত

চামড়া শিল্প পিছিয়ে ঠিকাদারি শ্রমিকে

ফারুক আহমাদ আরিফ

প্রকাশ : ০৮ মার্চ ২০২৫ ১৪:০৭ পিএম

আপডেট : ০৮ মার্চ ২০২৫ ১৪:২৩ পিএম

গ্রাফিক্স : প্রতিদিনের বাংলাদেশ

গ্রাফিক্স : প্রতিদিনের বাংলাদেশ

বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি খাত চামড়া শিল্প। দেশের অর্থনীতিতে এই শিল্পের অবদান অপরিসীম। তবে এই শিল্পের বিকাশে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি, প্রশিক্ষণ ও সুযোগ-সুবিধার অভাব। ঠিকাদারিভিত্তিক শ্রমিক নিয়োগ, কম মজুরি, যাতায়াত ও আবাসন সংকট, চিকিৎসা সুবিধার অভাব এবং পরিবেশগত সমস্যা এই শিল্পের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করছে। শ্রমিকরা বলছেন, একসময় বলা হতো শ্রমিক বাঁচলে শিল্প বাঁচাবে। এখন বলা হয়, শিল্প বাঁচলে বাঁচবে শ্রমিক। এ ধরনের উল্টোপথে চলছে ট্যানারি খাত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সঠিক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন হলে ২০৩০ সালের মধ্যে এই শিল্পে ৩০ থেকে ৩৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব। কিন্তু বর্তমানে এই শিল্পে প্রায় ১০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান থাকলেও শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না।

স্থায়ীর বদলে বাড়ছে ঠিকাদারি শ্রমিক নিয়োগ

ট্যানারি শিল্পে দিন দিন স্থায়ী শ্রমিকের সংখ্যা কমছে। মালিকপক্ষ ইচ্ছাকৃতভাবে দক্ষ ও অভিজ্ঞ শ্রমিকদের চুক্তি নবায়ন না করে ঠিকাদারির মাধ্যমে সস্তায় শ্রমিক নিয়োগ দিচ্ছে। এতে করে দক্ষ ও দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞ শ্রমিকরা কাজ হারাচ্ছেন। 

এ ব্যাপারে ট্যানারি ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের (টিডব্লিইইউ) সভাপতি আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘শ্রম আইন অনুযায়ী, কোনো শিল্প প্রতিষ্ঠান শ্রমিক নিয়োগ দিলে নিয়োগপত্র, হাজিরা কার্ড ও আইডি কার্ড দেওয়া বাধ্যতামূলক। কিন্তু ট্যানারি শিল্পে এই নিয়ম মানা হচ্ছে না। আগে চুক্তিভিত্তিক কিছু নিয়োগ হতো, কিন্তু এখন ঠিকাদারির মাধ্যমে প্রডাকশনভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। এতে শ্রমিকরা আইনি লড়াই করতে পারছে না, কারণ তাদের কোনো কাগজপত্র নেই।’

তিনি আরও বলেন, ‘২০ থেকে ৩০ বছর বা তারও বেশি সময় ধরে যারা এই খাতে কাজ করছেন, তারা অনেক দক্ষ ও অভিজ্ঞ। কিন্তু তাদের বেতন বেশি হওয়ায় মালিকপক্ষ তাদের বাদ দিয়ে কম মজুরিতে নতুন শ্রমিক নিয়োগ দিচ্ছে। এসব শ্রমিক আইনি লড়াই করতে পারে না কাগজপত্র না থাকায়। ঠিকাদারির মাধ্যমে শ্রমিক নিয়োগ দিলে ছুটি দিতে হয় না, বেতন-ভাতা বাড়াতে হয় না। এটি ট্যানারি শিল্পে মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। এতে শিল্পের মানও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দক্ষ শ্রমিক না থাকলে ভালো মানের চামড়া উৎপাদন সম্ভব নয়, যা বিদেশে ভালো দামে বিক্রি করা যায় না। যেকোনো কাজে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার মূল্য থাকলেও ট্যানারি শিল্পের মালিকরা সস্তায় ও কম টাকায় কাজ করাতে চায়। এতে করে বিশ্বে বাজারে চামড়ার দাম হারাচ্ছে।’

চামড়া শিল্পে দক্ষতা উন্নয়নের জন্য প্রশিক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নেই। শ্রমিকরা সাধারণত আত্মীয়স্বজন বা সহকর্মীদের কাছ থেকে কাজ শিখে থাকেন। ট্যানারি ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সভাপতি আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘চামড়া শিল্পে কাজ করতে হলে দীর্ঘদিনের প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। কিন্তু সরকার বা মালিকপক্ষের পক্ষ থেকে কোনো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই। এতে করে শ্রমিকদের দক্ষতা উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতার এই যুগে চামড়া শিল্পে টিকে থাকতে হলে পরিবেশ, দক্ষ শ্রমিক ও মানসম্মত উৎপাদন নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশে এই শিল্পে প্রশিক্ষণের অভাব একটি বড় সমস্যা। সরকার ও মালিকপক্ষের উচিত খাতভিত্তিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।’

যাতায়াতে নষ্ট হচ্ছে অতিরিক্ত ৬-৭ ঘণ্টা

সাভারের হেমায়েতপুরে অবস্থিত ট্যানারি শিল্পনগরীতে যাতায়াত ও আবাসন সংকট একটি বড় সমস্যা। হাজারীবাগ থেকে প্রতিদিন সকালে হেমায়েতপুরে কাজ করতে আসেন আব্দুল জলিল নামের এক শ্রমিক। তিনি বলেন, ‘শুরুতে আমাদের বলা হয়েছিল ট্যানারির পক্ষ থেকে যাতায়াতের ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু এখন আর তা দেওয়া হয় না। সকাল ৮টায় কাজে যোগ দিতে হলে ভোর ৫টা বা ৬টায় ঘুম থেকে উঠতে হয়। রাতে বাসায় ফিরতে ফিরতে ৮-১০টা লেগে যায়। আমাদের মতো প্রত্যেক শ্রমিকের একই অবস্থা।’

টিডব্লিইইউর অফিস সেক্রেটারি শেখ কামাল হোসেন বলেন, ‘হাজারীবাগে ট্যানারি থাকাবস্থায় এত কষ্ট পোহাতে হয়নি। বর্তমানে শ্রমিকরা নিজেদের টাকা দিয়ে গাড়ি ভাড়া করে যাতায়াত করছে। ৮ ঘণ্টা ডিউটির জন্য ভোর ৫-৬টায় ঘুম থেকে উঠতে হয় এবং রাতে ১০টায় বাসায় ফিরতে হয়। অর্থাৎ ৮ ঘণ্টা কাজের জন্য ১৩-১৪ ঘণ্টা সময় ব্যয় হচ্ছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘হেমায়েতপুরে অফ সিজনে ১০ হাজার শ্রমিক কাজ করে এবং কুরবানির পর তিন মাস ৫০ হাজারের মতো শ্রমিক এখানে কাজ করে। শ্রমিকদের যাতায়াত সুবিধা বাড়াতে হবে। এখানে আবাসনের ব্যবস্থা করাও জরুরি।’

ন্যূনতম মজুরি পায় না ট্যানারি শ্রমিকরা 

ট্যানারি শিল্পে শ্রমিকরা ন্যূনতম মজুরি পাচ্ছেন না। ৩২ বছর ধরে ট্যানারিতে কাজ করছেন মোহাম্মদ আলী। তার বেতন ২৫ হাজার টাকা। প্রতি বছর এক হাজার টাকা করে বেতন-ভাতা বাড়লেও তার বেতন ৩২ হাজার টাকা হওয়ার কথা ছিল। যে বেতন পান তা দিয়ে মা-বাবা, সন্তানসহ ৬ জনের সংসার চালাতে হয়। নিজ বাড়িতে থাকেন বিধায় ঘর ভাড়া লাগে না। তিনি বলেন, ‘গত ৪ বছর ধরে শ্রমিকদের সঙ্গে কোনো চুক্তি হচ্ছে না, বেতন বাড়ানো হচ্ছে না। সরকার ৫ ক্যাটাগরিতে বেতন স্কেল ঘোষণা করেছে, কিন্তু মালিকপক্ষ তা বাস্তবায়ন করছে না। আমরা সবাই খুব কষ্টে আছি।’

ট্যানারিতে ৪২ বছর ধরে কাজ করছেন মো. আব্দুল আওয়াল। তার বেতন ২৫ হাজার টাকার কম। তিনি বলেন, সরকার সর্বশেষ যে বেতন কাঠামো ঘোষণা করেছে সেটি দ্রুত কার্যকর করা দরকার। তারপরও বর্তমান বাজার অনুযায়ী আমাদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায়। এখাতে বেতন-ভাতা খুব কম। 

২০২২ সালের আগস্টে ট্যানারি শ্রমিকদের চাকরি নিয়ে একটি গবেষণা করা হয়। তাতে দেখা যায়, সাভার চামড়া শিল্পনগরীতে ১৩৫টি ট্যানারির কার্যক্রম রয়েছে। এখানে ৬০ শতাংশ শ্রমিকের নিয়োগপত্র নেই, ৯২ শতাংশ শ্রমিক বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট পায় না।

টিডব্লিইইউ সহ-সাধারণ সম্পাদক টিএম লিয়াকত হোসেন বলেন, ‘এলডব্লিউজির সার্টিফিকেট না পেলে গ্রান্টের বায়ার আসবে না। গ্রান্টের বায়ার না এলে চামড়ার দাম বাড়বে না। হাজারীবাগে আমরা প্রতি বর্গফুট চামড়া আড়াই ডলারে বিক্রি করতাম। বর্তমানে সেটি এক ডলার ১০-৩০ সেন্টে বিক্রি হচ্ছে। এর কারণ হচ্ছে-২০১৭ সালে সাভারে ট্যানারি স্থানান্তরিত হওয়ার পর এর পরিবেশ স্বাস্থ্যসম্মত ছিল না। এতে করে বায়ার অন্য দেশে চলে গেছে। বেশিরভাগ ভারতে চলে গেছে। এতে মালিকদের বায়ার হাতছাড়া হয়ে গেছে। তখন এক বায়ারে যে পরিমাণ চামড়া নিতো বর্তমানে ১০ জনেও সেই পরিমাণ চামড়া নিচ্ছে না। এখন শুধু চীনের ব্যবসায়ীরা চামড়া নিচ্ছে। এখন সোশ্যাল কমপ্লেক্স করতে হবে, পরিবেশবান্ধব করতে হবে। পরিবেশ ভালো থাকলে শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ও চেহারা ভালো থাকবে। তাতে করে উৎপাদন বাড়বে। সর্বনিম্ন বেতন-ভাতা নির্ধারণ করতে হবে। মালিকদের ব্যাংক ঋণও বাড়ানো দরকার। কেননা তাদের আগের টাকা নানা কারণে ব্লক হয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এ খাতের জন্য নির্দিষ্ট ঋণ প্রকল্প ঘোষণা করুক। এখন সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে মালিক, শ্রমিক ও সরকার তিন পক্ষ মিলে সমঝোতায় আসা। কীভাবে শিল্পটির উন্নয়ন করা যায়। সবাই এগিয়ে আসলে ব্যবসা চাঙ্গা হবে, এতে মালিকরা লাভবান হবে এবং শ্রমিকরাও ন্যূনতম বেতন পাবে। 

তিনি বলেন, ‘আমরা ন্যূনতম মজুরি চাচ্ছি। প্রয়োজনে লিভিং ওয়েজ পেতে পারি। সারা বিশ্বে লিভিং ওয়েজ আছে, শুধু বাংলাদেশে নেই। আমরা যে কাজ করি, ইতালিতে তার বেতন ২ লাখ টাকা। আমাদের মিনিমাম ওয়েজ ১৮ হাজার ১ টাকা, কিন্তু লিভিং ওয়েজ ৩০ হাজার টাকা হওয়া উচিত। আমাদের যে বেতন কাঠামো নির্ধারণ করেছে সরকার তা দ্রুত বাস্তবায়ন করলে শ্রমিকদের মধ্যে স্বস্তি আসবে। তারা কাজে উৎসাহ পাবে।’

সর্বনিম্ন মজুরি দিতেও গড়িমসি 

সরকার গত বছরের ২১ নভেম্বর ট্যানারি শ্রমিকদের জন্য নিম্নতম মজুরি ঘোষণা করেছে। এটি সরকার, মালিক ও শ্রমিক পক্ষ উভয়ের সম্মতিতে হয়েছে। কিন্তু দীর্ঘ প্রায় তিন মাস অতিবাহিত হলেও মালিকরা তা বাস্তবায়ন করছে না। 

বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ অনুযায়ী ট্যানারি শ্রমিক ও কর্মচারীদের জন্য সরকার ৫টি ক্যাটাগরিতে ঢাকা, বিভাগীয় শহর ও তার বাইরের এলাকার জন্য নিম্নতম মজুরি ঘোষণা করেছে। এতে দেখা যায়, গ্রেড ও এলাকাভেদে এখাতে নিম্নতম মজুরি হবে ১৭ হাজার ৪৮ টাকা ও সর্বোচ্চ ৩৪ হাজার ১৬৬ টাকা। প্রতি গ্রেডে সাভার ও বিভাগীয় শহরের জন্য আলাদা দুটি শ্রেণি রাখা হয়েছে। সেখানে মূল মজুরির সঙ্গে চিকিৎসা, যাতায়াত সমান রাখা হলেও বাড়ি ভাড়ায় পার্থক্য রাখা হয়েছে। প্রথম গ্রেডে ১৩টি পদে বিভাগীয় শহর ও সাভার এলাকার জন্য সর্বমোট মজুরি ৩৪ হাজার ১৬৮ টাকা ও অন্যান্য এলাকায় ৩২ হাজার ২৬৪ টাকা। দ্বিতীয় গ্রেডে ১০টি পদে বিভাগীয় শহর ও সাভার এলাকার জন্য সর্বমোট মজুরি ২৮ হাজার ৩৮৮ টাকা ও অন্যান্য এলাকায় ২৬ হাজার ৮২৪ টাকা। তৃতীয় গ্রেডে ২৮টি পদের জন্য বিভাগীয় শহর ও সাভার এলাকার জন্য সর্বমোট মজুরি ২৪ হাজার ২ টাকা ও অন্যান্য এলাকায় ২২ হাজার ৬৯৬ টাকা। পঞ্চম গ্রেডে অদক্ষ সাধারণ শ্রমিকদের জন্য বিভাগীয় শহর ও সাভার এলাকার জন্য সর্বমোট মজুরি ১৮ হাজার ১ টাকা ও অন্যান্য এলাকায় ১৭ হাজার ৪৮ টাকা এবং শিক্ষানবিশদের জন্য ৩ মাস ১১ হাজার ৩৩০ টাকা নির্ধারণ হয়। এরপর তারা গ্রেড অনুযায়ী বেতন পাবে। 

শ্রমিকদের ৫২ শতাংশই চর্মরোগে আক্রান্ত

ট্যানারি শিল্পের শ্রমিকরা জ্বর, চর্মরোগ, শ্বাসকষ্ট, কোমরের ব্যথাসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন। ২০১৯ সালে সাভারের হেমায়েতপুরের লেদার এস্টেটের ১০টি ট্যানারিতে ২২৩ জন শ্রমিকের ওপর একটি সমীক্ষা চালানো হয়। তাতে দেখা যায়, ৫২ শতাংশ শ্রমিক চর্মরোগে আক্রান্ত, ৩৩ শতাংশের পেশির ব্যাধি, ২৩ শতাংশের গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল সমস্যা এবং ১৫ শতাংশের দীর্ঘস্থায়ী মাথাব্যথা ও শ্বাসকষ্ট রয়েছে। তা ছাড়া ট্যানারিগুলো ছিল অত্যন্ত দুর্গন্ধময়, অপর্যাপ্ত আলো এবং উদ্বেগজনক তাপমাত্রা ছিল ৮টিতে, অসহনীয় শব্দ ৬টিতে এবং বায়ু চলাচল ব্যবস্থার ঘাটতি ছিল ৫টিতে। মাত্র ৩টির পাসযোগ্য বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা ছিল। বিপুলসংখ্যক শ্রমিক ব্যক্তিগত সুরক্ষামূলক সরঞ্জাম (পিপিই) ব্যবহার করে না বলে জানা যায়। শ্রমিকদের জরুরি চিকিৎসার জন্য ট্যানারিতে কোনো চিকিৎসা সুবিধাও ছিল না। অপর গবেষণায় ১০টি ট্যানারির ১৬৭ জন শ্রমিকের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। সেখানে তাদের কাজের ক্ষেত্রগুলোর ডেটা (বিম হাউস, ওয়েট ফিনিশিং, ড্রাই ফিনিশিং ইত্যাদি) অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তাতে দেখা যায়, ওয়েট ফিনিশিং ও ড্রাই ফিনিশিং শ্রমিকদের শ্বাসকষ্টের পরিমাণ বেশি। বিম হাউসের শ্রমিকদের চর্মরোগ হওয়ার ঝুঁকি অত্যধিক। 

বাংলাদেশে একটি টেকসই চামড়া খাত বিনির্মাণে ১ মার্চ ২০২৩ থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৬ পর্যন্ত ৩ বছর মেয়াদি একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে দি ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন। প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনসহ দেশের ৫টি প্রতিষ্ঠান এ বিষয়ে কাজ করছে। এ সম্পর্কে প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনের প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর এএমএম খায়রুল আনাম বলেন, আমরা ট্যানারি, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি বিকাশে শ্রমিকদের নিয়োগপত্র, আইডি কার্ড, শোভন কর্মপরিবেশ, চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতকরণসহ বিভিন্ন বিষয়ে কাজ করছি। এসব খাতের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে সভা, সেমিনার, কর্মশালা ও আলাপ-আলোচনা চলমান রেখেছি। এতে করে অনেক প্রতিষ্ঠান শ্রমিকদের নিয়োগপত্র, আইডি কার্ড ও চিকিৎসাসেবা দেওয়ার কাজ শুরু করেছে। এটি আশার একটি দিক। আমরা প্রত্যাশা করি তৈরি পোশাকের পর চামড়া খাত দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি খাতে পরিণত হবে। 

প্রকল্পটির অধীনে সাভারে ট্যানারি শ্রমিকদের স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে থাকে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। প্রতি সপ্তাহে একদিন হেমায়েতপুরে চিকিৎসকরা গিয়ে শ্রমিকদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে এ সেবা দেয়। এ ব্যাপারে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের স্বাস্থ্য ও প্রশিক্ষণ বিভাগের সিনিয়র পরিচালক ডা. একেএম রেজাউল হক বলেন, ট্যানারি শিল্পের বর্জ্যের কারণে আশপাশের নদ, খাল-বিলের পানি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এখানকার পানিগুলো কালো হয়ে গেছে। এসব পানিতে নামলে শরীরে চর্ম রোগ হবে। এই পানিতে ক্রোমিয়াম জমা হবে। সেই পানি দিয়ে চাষাবাদ করলে ক্রোমিয়াম শরীরে গিয়ে ক্যানসারের সৃষ্টি করবে। এই অবস্থায় যেতে ১৮-২০ বছর সময় লাগবে। প্রত্যেক ট্যানারিকে নিজস্ব ইটিপি (ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট) স্থাপন করতে হবে। প্রত্যেকটি কারখানার অবশ্যই প্রি-ট্রিটমেন্ট করতে হবে। প্রি-ট্রিটমেন্ট না করে সিইটিপিতে পানি পাঠাতে পারবে না। প্রত্যেক কারখানাকে নিজস্ব ইটিপি করতে হবে। তিনি বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন আমাদের সিইটিপি করে দিক। কেননা একটা সিইটিপিতে হবে না, কমপক্ষে ৩টি দরকার। 

ডা. একেএম রেজাউল হক বলেন, শ্রমিকদের জন্য কেন্দ্রীয় একটি হাসপাতাল তৈরি করতে হবে। হাসপাতাল না হওয়ায় আমাদের দুজন ডাক্তার এসে চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন। এটা সাময়িক প্রলেপ। এখানে ২৪ ঘণ্টা ডাক্তার থাকতে হবে। আগামী বছর আমরা একটি ডিজিজ প্যাটার্ন দিতে পারব, এখানকার শ্রমিকরা কী ধরনের রোগবালাইয়ের শিকার হয়।

বেতন গ্রেড বাস্তবায়ন শুরু

বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) চেয়ারম্যান মো. শাহীন আহমেদ বলেন, আমরা গ্রেড অনুযায়ী বেতন কাঠামোর বাস্তবায়ন শুরু করেছি। ধীরে ধীরে সব ট্যানারি তা বাস্তবায়ন করবে। এদিকে ঠিকাদারি ভিত্তিতে জনবল নিয়োগ সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কুরবানির ঈদের পর আমাদের প্রচুর লোকবলের দরকার পড়ে বিধায় ঠিকাদারি ভিত্তিতে জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়। এটি আমাদের করতেই হবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের চামড়া শিল্পে শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। ঠিকাদারিভিত্তিক শ্রমিক নিয়োগ, কম মজুরি, যাতায়াত ও আবাসন সংকট, প্রশিক্ষণের অভাব এবং পরিবেশগত সমস্যা এই শিল্পের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করছে। সরকার, মালিক ও শ্রমিকদের সমন্বিত উদ্যোগে এই সমস্যাগুলো সমাধান করা গেলে চামড়া শিল্প দেশের অর্থনীতিতে আরও বড় ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি, প্রশিক্ষণ ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে এই শিল্পে কর্মসংস্থান আরও বৃদ্ধি পাবে এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোরছালীন বাবলা

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা