আহমেদ ফেরদাউস খান
প্রকাশ : ০১ মার্চ ২০২৫ ০৯:৪৬ এএম
গ্রাফিক্স : প্রবা
একসময় প্রাইজবন্ডের তুমুল জনপ্রিয়তা থাকলেও বর্তমানে তা তলানিতে ঠেকেছে। সত্তর দশকে প্রিয়জনকে উপহার হিসেবে সরাসরি টাকা বা অন্য কিছু না দিয়ে প্রাইজবন্ড দেওয়ার প্রচলন শুরু হয়। বর্তমানেও প্রচলন আছে, তবে আগের মতো নয়। উপহার হিসেবে প্রাইজবন্ড দিলে একদিকে যেমন উপহারটি ভিন্ন ধরনের হয়, পাশাপাশি ভাগ্য পরীক্ষার একটি বিষয় থাকায় বাড়তি আকর্ষণ যুক্ত হয়। তবে জনপ্রিয় এই বন্ডের প্রচলন কমে যাওয়ার পেছনে প্রচারণার ঘাটতি এবং কেনাবেচার পদ্ধতি আধুনিকায়ন বা ডিজিটাল না করাকে দায়ী করছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, এ খাত আরও বড় করার মাধ্যমে রাজস্ব আদায় বাড়ানো সম্ভব।
জানা যায়, জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের একটি আর্থিক পণ্য প্রাইজবন্ড। সরকার পরিচালিত সঞ্চয় কর্মসূচি ‘বাংলাদেশ প্রাইজবন্ড’ চালু হয় ১৯৭৪ সালে। এটি বিক্রি করে সরকার জনগণের কাছ থেকে সরাসরি ঋণ নেয়। সমাজের সব শ্রেণির মানুষের মধ্যে সঞ্চয়প্রবণতা বৃদ্ধির জন্য এটি চালু করা হয়। বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও নেই কোনো সীমা। এটি কিনতে কোনো ব্যাংক হিসাব বা ফরম পূরণের শর্তও নেই। তা ছাড়া প্রাইজবন্ডে সুদের কোনো ব্যাপার নেই বলে একে কেউ কেউ সুদবিহীন বন্ডও বলে থাকেন। যেকোনো সময় এ প্রাইজবন্ড ভাঙিয়ে টাকা ফেরত নেওয়া যায়। ভাঙানো ও কেনা দুটিই করা যায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সব ক্যাশ অফিস, যেকোনো বাণিজ্যিক ব্যাংক ও ডাকঘর থেকে। কিন্তু এমন একটি সহজ ও সরকারি গ্যারান্টিযুক্ত সঞ্চয়ী উপকরণের প্রতি সঞ্চয়কারীদের আগ্রহ কমে যাচ্ছে।
রবিউল ইসলাম নামের এক বিনিয়োগকারী প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘১৯৯৫ সালে চালু হওয়া ১০০ টাকার প্রাইজবন্ড এখনও চলছে। সময় ব্যবধানে এটি আরও বাড়ানো দরকার। এখন আরও বেশি মানের প্রাইজবন্ড চালু করা উচিত। তা ছাড়া প্রাইজবন্ডের ড্র অনুষ্ঠান ও এর ফলাফল যথেষ্ট প্রচার হয় না। বিনিয়োগকারীদের এসব জানতেও অনেক সমস্যা হয়। অনেক গ্রাহকই জানেন না কখন ড্র হচ্ছে বা এর ফলাফল কোথায় পাবে। এ কারণে অনেক প্রাইজবন্ড পুরস্কার পেলেও সেগুলো সঞ্চয়কারীরা নিতে পারছেন না। সরকারের উচিত বিষয়টি নিয়ে আরও কাজ করা।’
তিনি বলেন, প্রাইজবন্ড সাধারণ মানুষের কাছে ভাগ্য পরীক্ষা। তাই ভাগ্য পরীক্ষা করতে অনেকেই এ বন্ড কিনে থাকেন। ব্যাংকের সব সেবাই এখন আধুনিক অথচ প্রাইজবন্ড অতটা আধুনিক নয়। ফলে বিনিয়োগকারীদের অনেক সমস্যা হচ্ছে। যুগের সঙ্গে মিলিয়ে আরও আধুনিক করা উচিত। তাহলে এ খাতে আরও বিনিয়োগ বাড়বে। সেই সঙ্গে প্রচার-প্রচারণাও খুব দরকার বলে মনে করেন তিনি।
এ বিষয়ে জানতে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘বিষয়টা পুরোপুরি সরকারের। আমরা শুধু বিক্রি করি। তবে বন্ডটি জনপ্রিয় করতে বেশ কিছু পদক্ষেপ ইতোমধ্যে নেওয়া হয়েছে। তবে পুরস্কারের টাকা পেতে তেমন কোনো জটিলতা নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুরস্কার বিজয়ীদের অসচেতনতার কারণে পুরস্কারের টাকা বিতরণ করা যায় না।’
ঢাকার একটি স্কুলে শিক্ষকতা করেন জাহাঙ্গীর যুবরাজ। তিনি প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমরা স্কুল থেকে শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন গুণীজনকে সংবর্ধনা ও উপহার দিয়ে থাকি। আমরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে সার্টিফিকেট ও ক্রেস্টের সঙ্গে নগদ টাকার পরিবর্তে প্রাইজবন্ড দিই।’
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের উপসচিব মকিমা বেগম প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘প্রাইজবন্ড কেনা এমনিতে সহজ। প্রাইজবন্ডের রেজাল্ট চাইলে আপনি সহজেই খুঁজে পাবেন। আমাদের ওয়েবসাইটে একটা সার্ভিস আছে। ওখানে আপনার নম্বর দিলেই আপনার কোনো পুরস্কার আছে কি না, জানতে পারবেন। এ ছাড়া আর কোনো আধুনিক করার পরিকল্পনা নেই। যেভাবে আছে সেভাবেই আধুনিক আছে বলে আমি মনে করি।’
তবে বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, ব্যাংক খাতে সরকারের ঋণনির্ভরশীলতা যেভাবে বাড়ছে, তাতে সঞ্চয়পত্রের পাশাপাশি প্রাইজবন্ডটি জনপ্রিয় করা গেলে কিছুটা হলেও এর প্রভাব কমবে। জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের নিষ্ক্রিয়তার কারণেই বন্ডটি জনপ্রিয়তা পাচ্ছে না বলে মনে করছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। ১০০ টাকা মূল্যমানের এ প্রাইজবন্ডের ড্র বছরে চারবার অনুষ্ঠিত হয়। তারিখগুলো হচ্ছে ৩১ জানুয়ারি, ৩০ এপ্রিল, ৩১ জুলাই ও ৩১ অক্টোবর।
তবে কেনার দুই মাস পার হওয়ার পর প্রাইজবন্ড ড্রয়ের আওতায় আসে। নতুন কেনা প্রাইজবন্ডের পাশাপাশি আগে কিনে রাখা প্রাইজবন্ডও ড্রয়ের আওতায় থাকে। প্রাইজবন্ডে প্রতি সিরিজের জন্য ৪৬টি পুরস্কার রয়েছে, যার মূল্যমান ১৬ লাখ ২৫ হাজার টাকা। প্রথম পুরস্কার একটি ৬ লাখ টাকা, দ্বিতীয় পুরস্কার একটি ৩ লাখ ২৫ হাজার টাকা, তৃতীয় পুরস্কার দুটি ১ লাখ টাকা করে, চতুর্থ পুরস্কার দুটি ৫০ হাজার টাকা করে এবং পঞ্চম পুরস্কার ৪০টি ১০ হাজার টাকা করে। ড্রয়ের তারিখ থেকে দুই বছরের মধ্যে পুরস্কারের টাকা দাবি করতে হয়। তবে পুরস্কারপ্রাপ্ত অর্থ থেকে ২০ শতাংশ উৎসে কর কর্তন করে পুরস্কারের টাকা প্রদান করা হয়।
কীভাবে প্রাইজবন্ডের আরও জনপ্রিয় করা যায়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ এবং গবেষণা ও নীতিসহায়ক সংস্থা ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএফ) নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তফা কে মুজেরী প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘প্রাইজবন্ড এখন আর আকর্ষণীয় নয়, তাই মানুষ এতে বিনিয়োগ করতে তেমন আগ্রহী নন। প্রাইজবন্ড বিক্রির অন্যতম জায়গা হলো ডাকঘর। এখন আর মানুষ ডাকঘরে যায় না।’
তিনি বলেন, ‘প্রাইজবন্ডকে যদি আকর্ষণীয় করতে হয়, তাহলে ডিজিটাল করতে হবে। এখন তো ডিজিটাল যুগ। মানুষ ঘরে বসেই ব্যাংকিং সেবা পাচ্ছে। জিনিসপত্র কিনতে পারছে। তাই এখন ১০০ টাকার প্রাইজবন্ড কেনার জন্য ডাকঘর বা অন্য কোথায় গিয়ে লাইনে দাঁড়াবে না। এটা যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আপডেট করতে হবে। ডিজিটাল করতে পারলে মানুষের আগ্রহ বাড়তে পারে। মানুষ সঞ্চয় করতে চায়। প্রাইজবন্ডকে ডিজিটালাইজড করা এবং জনপ্রিয়তা কীভাবে বাড়ানো যায়, তার চিন্তাভাবনা করা দরকার।’
দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রাইজবন্ড কিনে রাখলে যারা লটারিতে পুরস্কার পান, তারা লাভবান হলেন, তবে অন্যদের তো লোকসান হচ্ছে। তাই বিষয়টি নিয়ে আরও কাজ করা দরকার। ৭০-৮০ দশকে যেভাবে সমাজ ছিল, এখন তেমন নেই। তাই অন্যান্য পণ্যের মতোই এটাকেও আরও আকর্ষণীয় করতে পরিকল্পনা করা উচিত। যাতে প্রাইজবন্ড সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারে।’
বিনিয়োগের স্থিতি কমছে
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা গেছে, প্রাইজবন্ডকে গ্রাহকরা দীর্ঘমেয়াদি সঞ্চয়ী উপকরণ হিসেবে নিচ্ছেন না। যে কারণে কেনার পর এটিকে ধরে না রেখে ভাঙিয়ে টাকা নগদায়ণ করে ফেলছেন। ফলে প্রাইজবন্ডে গ্রাহকদের বিনিয়োগের স্থিতি কমে যাচ্ছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিক্রি হয়েছিল ৪৩ কোটি ৭০ লাখ টাকার। তবে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিক্রি কিছুটা বেড়ে ৫২ কোটি ৯০ লাখ টাকায় দাঁড়ায়; যা ২১ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রাইজবন্ড ভাঙানো হয় ১৯ কোটি টাকা; যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বেড়ে দাঁড়ায় ২৪ কোটি ৬০ লাখ টাকায়। ওই সময়ে ভাঙানোর প্রবণতা বেড়েছিল ২৯ দশমিক ৪৭ শতাংশ। একই সময়ে পুরস্কার বাবদ অর্থ নেওয়ার প্রবণতাও বাড়ে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে গ্রাহকরা প্রাইজবন্ড বিক্রি করে অর্থ উত্তোলন করে ১২ কোটি ৭০ লাখ টাকা; যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বেড়ে দাঁড়ায় ৩১ কোটি ৪০ লাখ টাকায়।
২০২১-২২ অর্থবছরে প্রাইজবন্ড বিক্রি হয়েছিল ৮৭ কোটি ২০ লাখ টাকার। ওই অর্থবছরে রেকর্ড পরিমাণে ৪৩ কোটি ৭০ লাখ টাকার প্রাইজবন্ড ভাঙিয়ে গ্রাহকরা টাকা নগদায়ণ করেন। ২০২০-২১ অর্থবছরে বিক্রি হয়েছিল ৮২ কোটি ৯০ লাখ টাকা, ভাঙানো হয়েছিল ৪১ কোটি ১০ লাখ টাকার। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বিক্রি হয়েছিল ৭৯ কোটি ১০ লাখ টাকা, ভাঙানো হয়েছিল ৩৭ কোটি ৪০ লাখ টাকার। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বিক্রি হয়েছিল ৮২ কোটি টাকার, অর্থ তুলে নেওয়া হয় ৪২ কোটি টাকার। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বিক্রি হয়েছিল ৭২ কোটি টাকার, অর্থ তুলে নেওয়ার পরিমাণ ছিল ৩৬ কোটি টাকা।
প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রাইজবন্ডের স্থিতি ছিল সর্বোচ্চ। ওই বছরে স্থিতি বেড়ে দাঁড়ায় ৩১ কোটি টাকায়। পরের দুই অর্থবছরে স্থিতি সামান্য কমেছে। এর মধ্যে ২০২০-২১ অর্থবছরে স্থিতি কমে দাঁড়ায় ২৮ কোটি টাকায়। ২০২১-২২ অর্থবছরে তা আরও কমে স্থিতি দাঁড়িয়েছে ২৫ কোটি টাকায়। গত অর্থবছরে স্থিতি সামান্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৯ কোটি টাকায়। এর আগে ২০১৭-১৮ ও ২০১৮-১৯ দুই অর্থবছরে স্থিতি ছিল ২৫ কোটি টাকা করে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের সব বাণিজ্যিক ব্যাংকে প্রাইজবন্ড বিক্রি করার কথা থাকলেও ক্যাশ বিভাগের অনেক কর্মকর্তারই বিক্রিতে আগ্রহ কম। এ ছাড়া ভাঙতি টাকার অজুহাতে প্রাইজবন্ড ভাঙাতেও তেমন একটা আগ্রহ দেখান না কর্মকর্তারা।
প্রসঙ্গত, প্রাইজবন্ড হচ্ছে সরকারের একটি বিনিয়োগ প্রকল্প। এতে দেশের যে কেউ যেকোনো অঙ্কের অর্থ যেকোনো সময় বিনিয়োগ করতে পারেন। শরিয়াহ ভিত্তিতে পরিচালিত ব্যাংকগুলো ছাড়া বাকি সব ব্যাংকের যেকোনো শাখা, ডাকঘর ও সঞ্চয় ব্যুরো অফিস ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সব শাখা অফিস থেকে প্রাইজবন্ড কেনা ও ভাঙানো যায়। গ্রাহকরা এর মাধ্যমে সঞ্চয় করতে পারেন এবং বিনিয়োগ করা টাকা ঋণ হিসাবে গ্রহণ করে সরকার। এতে কোনো হিসাব বা কাগজপত্র লাগে না। নগদ টাকা দিয়ে এ বন্ড কেনা যায়। এটি নিজের কাছে সংরক্ষণ করতে হয়। এতে কোনো সুদ বা মুনাফা দেওয়া হয় না। তবে প্রতি ৩ মাস পরপর বছরে চারবার লটারির ড্র অনুষ্ঠিত হয়। এর মাধ্যমে গ্রাহকদের নগদ টাকা পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হয়।