প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ২০:৪৪ পিএম
আপডেট : ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০৯:৫৯ এএম
দেশে জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহতা দিন দিন তীব্র হচ্ছে। ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ও লবণাক্ততার কারণে দেশের পরিবেশ, কৃষি ও অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিশাল অঙ্কের বিনিয়োগ প্রয়োজন হলেও বাংলাদেশ বছরে প্রায় ১৮ বিলিয়ন ডলারের অর্থায়নের ঘাটতির সম্মুখীন। বছরে চাহিদা ২২.৬ বিলিয়ন ডলার। বিপরীতে পাওয়া যাচ্ছে ৪.৩ বিলিয়ন ডলার।
মঙ্গলবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর একটি হোটেলে ‘বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া: জলবায়ু নীতি ও সবুজ জ্বালানি রূপান্তর’ শীর্ষক সংলাপে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। এর আয়োজন করে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলেসি ডায়ালগ সিপিডি।
সংলাপে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘জলবায়ু অর্থায়নের সংজ্ঞা স্পষ্ট হওয়া দরকার। এটি এমনভাবে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে যাতে বিভিন্ন ধরনের সহায়তাও এর অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে, যা সঠিক নয়।’
তিনি বলেন, ‘যেসব দেশ অতীতে বেশি কার্বন নিঃসরণ করেছে, তাদের বড় দায়িত্ব রয়েছে। তবে কিছু উন্নয়নশীল দেশও এখন বড় দূষক। তাদেরও অবদান রাখা উচিত।’
তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, ‘এমন কোনো অবস্থান নেয়া যাবে না, যা গুরুত্বপূর্ণ জলবায়ু তহবিলের ঝুঁকি বাড়াবে।’
বাংলাদেশের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘জলবায়ু অর্থায়নে আরও দেশকে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়টি বাংলাদেশ সমর্থন করে। উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর উদ্দেশ্য এক নয়। কেউ কেউ ভোগবাদী জীবনযাত্রা টিকিয়ে রাখতে চায়, আর কেউ দারিদ্র্য দূরীকরণে কাজ করছে। জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সরে আসা অনেক দেশের জন্য কঠিন হতে পারে।’
প্যারিস চুক্তির কাঠামোকে তিনি ইতিবাচক হিসেবে দেখেন, তবে তিনি বলেন, বিশ্ব সঠিক পথে নেই। পাঁচ বছর পরপর উচ্চতর লক্ষ্য নির্ধারণের ব্যবস্থা কার্যকর হলেও বাস্তবে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি হচ্ছে না। জীবাশ্ম জ্বালানি ও প্লাস্টিক বিষয়ক আলোচনায় বাধার বিষয়টিও তিনি উল্লেখ করেন।
অস্ট্রেলিয়ার জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক দূত ক্রিস্টিন টিলি বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় অস্ট্রেলিয়া সহযোগিতা বাড়াতে চায়।’ তিনি স্বীকার করেন, অভিযোজন প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ নেতৃত্ব দিচ্ছে, তবে আন্তর্জাতিক আলোচনায় দেশের অবস্থান আরও শক্তিশালী হওয়া উচিত।’
তিনি বলেন, ‘জলবায়ু অর্থায়নের ক্ষেত্রে প্রকল্প গ্রহণের চেয়ে কাঠামোগত পরিবর্তনে জোর দেয়া জরুরি।’
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুনের সভাপতিত্বে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সংস্থাটির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। মূল প্রবন্ধে বলা হয়, বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার জন্য বার্ষিক প্রয়োজন ২২.৬ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু বর্তমানে পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ৪.৩ বিলিয়ন ডলার, যা প্রয়োজনের মাত্র ২০ শতাংশ। অর্থের এই ঘাটতির কারণে জলবায়ু অভিযোজন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও দুর্যোগ প্রস্তুতির মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোতে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি সম্ভব হচ্ছে না।
সরকারি ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সহায়তায় কিছু বিনিয়োগ আসলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। উন্নত দেশগুলোর প্রতিশ্রুত ১০০ বিলিয়ন ডলারের জলবায়ু তহবিল থেকে বাংলাদেশ তার ন্যায্য অংশ পায়নি।
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে উপকূলীয় অঞ্চল। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে হাজার হাজার মানুষ বাস্তুহারা হচ্ছে। শহরাঞ্চলে তীব্র বৃষ্টিপাত ও তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। কৃষি খাতে লবণাক্ততা ও খরার কারণে ফসলের উৎপাদন কমছে, যা খাদ্য নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠছে।’
তিনি বলেন, ‘শিল্প ও অর্থনীতিও জলবায়ুর নেতিবাচক প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকটের কারণে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, যা কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
মুল প্রবন্ধে আরও বলা হয়, বাংলাদেশের ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন নির্গমন নেট-শূন্যে আনার লক্ষ্য রয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে ৬.৭ শতাংশ নির্গমন কমানোর বাধ্যতামূলক লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা আন্তর্জাতিক সহায়তা থাকলে ২১.৮ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব।
নবায়নযোগ্য শক্তির প্রসারে বাংলাদেশ ২০৪১ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ৪০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানির অন্তর্ভুক্তির পরিকল্পনা করেছে। কিন্তু এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য ২০৫০ সাল পর্যন্ত প্রায় ২৩০ বিলিয়ন ডলার অতিরিক্ত বিনিয়োগ প্রয়োজন।
অর্থায়নে প্রধান চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশের জলবায়ু বিনিয়োগের প্রধান বাধা হলো আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের ধীরগতি। উন্নত দেশগুলো ১০০ বিলিয়ন ডলারের জলবায়ু তহবিলের প্রতিশ্রুতি দিলেও তার একটি বড় অংশ বাংলাদেশ এখনো পায়নি। সবুজ অর্থনীতিতে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগের অভাব একটি বড় সমস্যা। নবায়নযোগ্য শক্তি ও পরিবেশবান্ধব শিল্পায়নে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে সমন্বিত উদ্যোগ না থাকলে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব হবে না।
সংলাপে বলা হয়, অস্ট্রেলিয়া জলবায়ু অর্থায়নে একটি নতুন মডেল গ্রহণ করেছে, যা উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য কার্যকর হতে পারে। বাংলাদেশে অস্ট্রেলিয়ার বিনিয়োগ ও প্রযুক্তি সহযোগিতার মাধ্যমে নবায়নযোগ্য শক্তি খাতে উন্নতি সম্ভব।
অস্ট্রেলিয়ার উন্নত হাইড্রোজেন প্রযুক্তি, স্মার্ট গ্রিড ও নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবস্থাপনার অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের সবুজ অর্থনীতির প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ ও জলবায়ু তহবিল ব্যবহারে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে অংশীদারিত্ব বাড়ানো গেলে সবুজ অর্থনীতি, কর্মসংস্থান ও প্রযুক্তি উন্নয়নের মাধ্যমে জলবায়ু সংকট মোকাবিলা সহজ হবে।