আগরতলা-আখাউড়া রেলসংযোগ
আরমান হেকিম
প্রকাশ : ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০৯:৩৯ এএম
গ্রাফিক্স : প্রবা
বহুল আকাঙ্ক্ষিত আগরতলা-আখাউড়া ডুয়েলগেজ রেলসংযোগ প্রকল্পে রেলপথ নির্মাণের পরিমাণ কমেছে, বাদ পড়েছে সিগন্যালিং এবং সেতু নির্মাণের কাজ। তবু প্রকল্প ব্যয়ে যুক্ত হয়েছে ৩১৮ কোটি টাকা। চূড়ান্ত বিল পরিশোধের জটিলতা এবং নতুন আইটেম সংযোজনের অজুহাতে ভারতীয় অর্থায়নে নির্মাণাধীন প্রকল্পটির মেয়াদ আরও এক বছর বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায় প্রকল্প সংশোধনের এ প্রস্তাব তুলে ধরা হয়। প্রকল্প সংশোধনের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংস্থানের প্রস্তাবও পেশ করা হয়েছে। এর মধ্যে ২৪ কোটি ৯ লাখ টাকা সরকারি তহবিল থেকে এবং ২৯৪ কোটি ৪৩ লাখ টাকা ভারতীয় অনুদান থেকে বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে।
উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মূল ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৭৭ কোটি ৮১ লাখ ১৮ হাজার টাকা। ২০১৬ সালের জুলাই থেকে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পটি শেষ করার পরিকল্পনা থাকলেও বিভিন্ন জটিলতায় তা সম্ভব হয়নি। সর্বশেষ অনুমোদিত মেয়াদ ছিল গত বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত। তবে চূড়ান্ত বিল দাখিলের জটিলতা এবং কিছু খাতে ব্যয় বাড়ার কারণে প্রকল্পটি এখনও শেষ হয়নি। নতুন করে পরিকল্পনা কমিশনে প্রকল্পের সংশোধিত প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। এতে অতিরিক্ত ৩১৮ কোটি ৫২ লাখ টাকা চাওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ২৪ কোটি ৯ লাখ টাকা সরকারি তহবিল থেকে এবং ২৯৪ কোটি ৪৩ লাখ টাকা ভারতীয় অনুদান থেকে বরাদ্দের জন্য সংশোধিত প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া এক বছর বাড়তি সময় চাওয়া হয়েছে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আখাউড়ার গঙ্গাসাগর থেকে আগরতলার নিশ্চিন্তপুর পর্যন্ত ১২ দশমিক ২৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের আখাউড়া-আগরতলা রেলপথ নির্মাণকাজের জন্য প্রকল্পটি নেওয়া হয়। এই রেলপথের বাংলাদেশ অংশে রয়েছে ৬ দশমিক ৭৮ কিলোমিটার। ভারতের উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে পূর্বাঞ্চলের ৪০০ কিলোমিটারের সহজ পথে রেলপথের জন্য এ প্রকল্প হাতে নেয় বাংলাদেশ রেলওয়ে।
যে কারণে বাড়ছে ব্যয়
প্রকল্প সংশোধনের জন্য যে ৩১৮ কোটি টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে, তার পেছনে রয়েছে বিভিন্ন খাতে ব্যয় বৃদ্ধির অজুহাত। ডিপিপিতে রেলপথ নির্মাণের দৈর্ঘ্য ১৪.২৬ কিলোমিটার নির্ধারিত থাকলেও এর মধ্যে ৬.১৭ কিলোমিটার অন্য একটি প্রকল্পের আওতায় সম্পন্ন হয়েছে। ফলে এই অংশের ব্যয় কমেছে। এ খাতে বেঁচেছে প্রায় ৪৫ কোটি টাকা।
মূল ডিপিপিতে তিনটি মেজর ব্রিজ নির্মাণের সংস্থান ছিল। অ্যালাইনমেন্ট পরিবর্তনের কারণে ব্রিজ নির্মাণের কাজ বাতিল করা হয়েছে। এক্ষেত্রে ১৩ কোটি টাকা ব্যয় কমেছে। গঙ্গাসাগর ইয়ার্ডে লাকসাম-আখাউড়া প্রকল্পে সিগন্যালিং কাজ করা হয়েছে। তাই এ প্রকল্পের আওতায় সিগন্যালিংয়ের কাজ প্রয়োজন হয়নি। এ খাতে বেঁচে গেছে ২৪ কোটি ৬৫ লাখ টাকা।
তবে প্রকল্প সংশোধনের পেছনে নতুন কিছু কাজ যোগ হওয়ার অজুহাত দেখানো হয়েছে। এগুলো হলোÑ সাব ব্যালাস্টের পরিমাণ বৃদ্ধি, ইনসুলেটর টাইপ বিশেষ লাইনার সরবরাহ, ড্রেনেজ আউটলেটের জন্য নতুন কোর কাটিং, ইউআইসি ৬০ কেজি রেল স্ট্যাটিক সুইচ স্থাপন।
এ ছাড়া প্রকল্পের বিভিন্ন পূর্ত খাতে বাস্তব চাহিদার ভিত্তিতে নতুন আইটেম যুক্ত করা হয়েছে। এসব কারণে ব্যয় বেড়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে।
প্রকল্প পরিচালক আবু জাফর মিয়া সভায় বলেন, বাঁধ নির্মাণ, পানি নিষ্কাশন ও প্রাচীর নির্মাণ খাতে সাব ব্যালাস্টের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়া এবং কিছু নতুন আইটেম যুক্ত হওয়া যেমনÑ ইনসুলেটর টাইপ বিশেষ লাইনার সরবরাহ, ড্রেনেজ আউটলেটের জন্য কোর কাটিং ৫০০ গুণ ৫০০ মিলিমিটার, নতুন ইউআইসি ৬০ কেজি আইই রেল স্ট্যাটিক সুইচ স্থাপন সেকশনে ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। এজন্য বাড়তি ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে।
ভূমি অধিগ্রহণ এবং সিডি-ভ্যাট খাতে ব্যয় কমেছে প্রকল্প সংশোধনে যেখানে বিভিন্ন খাতে ব্যয় বেড়েছে, সেখানে কিছু খাতে ব্যয় কম হয়েছে।
ভূমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসন খাতে প্রকৃত ব্যয় পূর্বাভাসের চেয়ে কম হয়েছে। ট্র্যাক, সেতু এবং সিগন্যালিং কাজ কম হওয়ায় সিডি-ভ্যাট খাতেও ব্যয় কমেছে। তবে প্রকল্প সংশোধনের জন্য এগুলোকে সুষম হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে।
এ প্রকল্পের বাংলাদেশ অংশের নির্মাণকাজ করেছে ভারতীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান টেক্সমেকো রেল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড। করোনা মহামারিসহ নানা সংকটে দেড় বছরের এ প্রকল্পের কাজ শেষ করতে সময় লেগেছে ছয় বছরেরও বেশি।
ইআরডি (অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ) জানিয়েছে, প্রকল্পের অনুদানের বাকি অর্থের নিশ্চয়তা রয়েছে। তবে রেল মন্ত্রণালয়কে অনুদান দাতা সংস্থার কাছে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব পাঠাতে হবে। এদিকে, প্রকল্প সংশোধনের মাধ্যমে মেয়াদ এক বছর বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
ভৌত অবকাঠামো বিভাগের প্রধান (অতিরিক্ত সচিব) কবির আহমেদ জানান, প্রকল্পের ভৌত কাজ প্রায় শতভাগ শেষ হয়েছে। চূড়ান্ত বিল পরিশোধ এবং পিসিআর (প্রকল্প সমাপ্তি প্রতিবেদন) প্রণয়নসহ প্রকল্পের বাকি কাজ শেষ করার জন্য সময় বাড়ানো দরকার।
ব্যয় বৃদ্ধির যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন
বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রকল্প সংশোধনের সময় ব্যয়ের স্বচ্ছতা ও কার্যকারিতা যাচাই করা জরুরি। প্রকল্পের বেশ কিছু কাজ কমে যাওয়া সত্ত্বেও ব্যয় বৃদ্ধি প্রকল্প বাস্তবায়নে দুর্বল পরিকল্পনার ইঙ্গিত দেয়। নতুন আইটেম সংযোজন ও আনুষঙ্গিক খাতে ব্যয় বৃদ্ধির যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। জনসাধারণের অর্থের যথাযথ ব্যবহারে এ ধরনের জটিলতা উদ্বেগ তৈরি করেছে।
প্রায় শতভাগ বাস্তবায়ন হওয়া সত্ত্বেও আগরতলা-আখাউড়া রেলসংযোগ প্রকল্প এখনও জটিলতার মধ্যে রয়েছে। কাজ কমে যাওয়ার পরও ব্যয় বৃদ্ধির বিষয়টি জনগণের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। প্রকল্প সংশোধনের মাধ্যমে বাড়তি ব্যয়ের যৌক্তিকতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
জানতে চাইলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘বর্তমানে বাংলাদেশের প্রকল্পগুলোর বড় সমস্যা হচ্ছে নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করতে না পারা এবং ব্যয় বাড়ানো। বারবার মেয়াদ বৃদ্ধির কারণে অর্থের অপচয় হচ্ছে। আমরা দীর্ঘদিন ধরেই এ কথাটি বলে আসছিলাম। প্রত্যাশা থাকবে সামনের দিনগুলোয় সুশাসনের সঙ্গে প্রকল্পগুলো সঠিক সময়ে শেষ হবে।’