প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২১ জানুয়ারি ২০২৫ ২২:১৬ পিএম
প্রতিবছর প্রায় ৫ বিলিয়ন (৫০০ কোটি) ডলার ব্যয় হয় শুধু চিকিৎসার জন্য বিদেশমুখী রোগীদের পেছনে। বিশ্বব্যাংক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক এক গবেষণা বলছে, দেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার ওপর আস্থার অভাবে এই ব্যয় ক্রমে বাড়ছে। একই সঙ্গে দেশের কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার মানোন্নয়ন না হওয়ায় দক্ষ শ্রমশক্তি তৈরিতে পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশ। এ অবস্থায় অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যে সুশাসনের জন্য গঠিত টাস্কফোর্স স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মানোন্নয়নে বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) উন্মুক্ত করার সুপারিশ করেছে।
অর্থনৈতিক কৌশল পুনর্নির্ধারণ ও প্রয়োজনীয় সম্পদ আহরণে গত সেপ্টেম্বর মাসে এ টাস্কফোর্স গঠন করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। ১২ সদস্যের টাস্কফোর্স কমিটির নেতৃত্বে আছেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক কাজী একেএম মুরশিদ। ইতোমধ্যে কমিটির প্রতিবেদন চূড়ান্ত করা হয়েছে এবং বর্তমানে এটি সম্পাদনার পর্যায়ে আছে।
একেএম মুরশিদ নিশ্চিত করেছেন, চূড়ান্ত প্রতিবেদনটি এ সপ্তাহে জমা দেওয়া হবে। পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের সুপারিশগুলোও কমিটি গ্রহণ করেছে বলে জানা গেছে।
স্বাস্থ্য খাতে এফডিআই কেন গুরুত্বপূর্ণ?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাস্থ্য খাত উন্মুক্ত করলে দেশের মানুষের চিকিৎসা ব্যয় কমবে এবং মানসম্মত সেবা পাওয়া সহজ হবে। বর্তমানে চিকিৎসার জন্য ভারত, সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ডের মতো দেশগুলোর ওপর বাংলাদেশের মানুষের নির্ভরশীলতা অত্যন্ত বেশি। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে দেশের স্বাস্থ্যসেবা খাতে মোট ব্যয় ছিল ৭৭ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্যক্তিগত ব্যয় ৬৮.৫ শতাংশ, যা মানুষের অর্থনৈতিক সুরক্ষার জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে।
টাস্কফোর্সের সদস্যরা বলছেন, বিদেশি হাসপাতালগুলোকে দেশে কার্যক্রম পরিচালনার অনুমতি দেওয়া হলে দেশের জনগণ উন্নত সেবা পাবেন। এ প্রসঙ্গে টাস্কফোর্সের প্রধান কাজী একেএম মুরশিদ বলেন, ‘আমাদের বহু নাগরিক উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেন। অথচ আমরা এখানে বিখ্যাত বিদেশি হাসপাতাল পরিচালনার অনুমতি দিচ্ছি না। এটি একটি নীতিগত পরিবর্তনের মাধ্যমে সম্ভব।’
তিনি আরও বলেন, ‘যদিও এ ধরনের উদ্যোগে স্থানীয় স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের পক্ষ থেকে বিরোধিতা হতে পারে, তবে এটি দেশের জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হতে পারে। স্বাস্থ্য খাতের উন্নতি হলে একদিকে দেশ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা রক্ষা হবে, অন্যদিকে কর্মসংস্থান ও সেবার মান বাড়বে।’
স্বাস্থ্য খাতের অপ্রতুলতা এবং সম্ভাবনা
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাম্প্রতিক এক জরিপ অনুযায়ী, দেশে বেসরকারি স্বাস্থ্য খাত গড়ে ৪৯.৫৪ শতাংশ মুনাফা করছে। ডেন্টাল ক্লিনিকগুলো সর্বোচ্চ ৯০.২৩ শতাংশ পর্যন্ত মুনাফা করছে। এরপরও দেশের মানুষের আস্থা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উন্নত দেশগুলোর মতো এখানে আন্তর্জাতিক মানের হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা গেলে চিকিৎসা ব্যয়ের বড় অংশ দেশেই থেকে যাবে। এফডিআই অনুমোদনের ফলে আন্তর্জাতিক মানের চিকিৎসাসেবা, প্রযুক্তি এবং জ্ঞান স্থানান্তর হবে। একই সঙ্গে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা তাদের অভিজ্ঞতার আলোকে স্থানীয় চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ দিতে পারবেন।
শিক্ষা খাতে সংস্কারের প্রস্তাব
দেশের কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা ব্যবস্থাকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার লক্ষ্যে পলিটেকনিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে বি-টেক ডিগ্রি চালুর প্রস্তাব করেছে টাস্কফোর্স। তারা বলছেন, এ উদ্যোগ দেশের শ্রমশক্তিকে আরও দক্ষ করে তুলতে এবং বিদেশে উচ্চ বেতনে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়াতে সহায়ক হবে।
টাস্কফোর্সের একজন সদস্যের মতে, বাংলাদেশের কারিগরি শিক্ষার মান উন্নত করতে হলে পলিটেকনিকগুলোকে আধুনিকায়ন করা জরুরি। দুই বছরের বি-টেক ডিগ্রি চালু হলে শিক্ষার্থীরা আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন প্রশিক্ষণ ও সনদ পাবে, যা তাদের কর্মজীবনে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে।
বর্তমানে দেশের পলিটেকনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো শুধু ডিপ্লোমা পর্যায়ের শিক্ষা প্রদান করে। টাস্কফোর্সের প্রস্তাব অনুযায়ী, এসব প্রতিষ্ঠানকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এনে বি-টেক ডিগ্রি চালু করা হবে। এই ডিগ্রি আন্তর্জাতিক মানের হবে এবং আধুনিক শিল্পের চাহিদা পূরণে শিক্ষার্থীদের প্রস্তুত করবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে দেশে এমন অনেক কারিগরি শিক্ষার্থী রয়েছেন, যারা শুধু ডিপ্লোমা নিয়ে সন্তুষ্ট। কিন্তু বি-টেক ডিগ্রি চালু হলে তারা আরও উন্নত দক্ষতা অর্জন করে চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতার জন্য যোগ্যতা অর্জন করতে পারবে।
বাংলাদেশে দক্ষ শ্রমশক্তি তৈরির ঘাটতি দীর্ঘদিন ধরে অর্থনীতির এক বড় চ্যালেঞ্জ। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে বিদেশে কর্মসংস্থানের জন্য যাওয়া শ্রমিকদের বেশিরভাগই অদক্ষ বা অল্প দক্ষ। এর ফলে তারা উচ্চ বেতন বা প্রযুক্তিগত চাকরির সুযোগ পায় না।
বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার উন্নয়নের মাধ্যমে প্রতিবছর ৫ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত বৈদেশিক মুদ্রা দেশেই রাখা সম্ভব। এক টাস্কফোর্স সদস্য বলেন, ‘এফডিআইয়ের মাধ্যমে উন্নত সেবা নিশ্চিত করা গেলে দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। একদিকে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, অন্যদিকে প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও দক্ষতার উন্নতি ঘটবে।’
তবে এ উদ্যোগ বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জও রয়েছে। স্থানীয় হাসপাতাল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর বিরোধিতার পাশাপাশি নীতিগত বাধা এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কাটিয়ে উঠতে হবে।
বিশ্বব্যাংকের একটি রিপোর্ট অনুসারে, বাংলাদেশে ২০২২ সালে প্রতিটি পরিবারের গড় মাসিক স্বাস্থ্য ব্যয় ছিল ২ হাজার ১১৫ টাকা। অথচ সরকারি ব্যয়ের মাত্র ২৩ শতাংশ স্বাস্থ্য খাতে যায়। এ অবস্থায় বেসরকারি খাতের পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগের প্রবাহ শিক্ষার মানোন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
সুপারিশ
টাস্কফোর্সের সুপারিশ অনুযায়ী, সরকার যদি স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বিদেশি বিনিয়োগের জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা তৈরি করে, তবে এটি দেশের জন্য এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে। দেশের স্বাস্থ্যসেবা খাতকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি এটি জনগণের আস্থা বাড়াতে এবং বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা খাতে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার উদ্যোগ দেশের অর্থনীতি ও জনগণের জীবনের মানোন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারে। তবে এর জন্য সরকারকে একটি সুসংহত নীতিমালা তৈরি করে সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।