প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১৬ জানুয়ারি ২০২৫ ১০:৪৫ এএম
গ্রাফিক্স : প্রতিদিনের বাংলাদেশ
তারল্য সংকটের কারণে সৃষ্ট আস্থাহীনতা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ বিভিন্ন কারণে ব্যাংক থেকে টাকা তুলছিলেন গ্রাহকরা। এতে টানা ১০ মাস ব্যাংকের বাইরে থাকা টাকার পরিমাণ বাড়তে থাকে। তবে গত কয়েক মাস ধরে পরিস্থিতি ক্রমেই স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। ধীরগতিতে হলেও ঘরের টাকা ব্যাংকে ফিরতে শুরু করেছে। গত নভেম্বরে অক্টোবরের তুলনায় ব্যাংকের বাইরে থাকা অর্থের পরিমাণ কমেছে ৩৫৪ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে।
তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০২৪ সালের নভেম্বর শেষে ব্যাংকের বাইরে অর্থাৎ মানুষের ঘরে বা হাতে ছিল ২ লাখ ৭৭ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকা। যেখানে গত অক্টোবরে ছিল ২ লাখ ৭৭ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক মাসে ৩৫৪ কোটি টাকা মানুষের ঘর থেকে ব্যাংকে ফিরেছে। অক্টোবরেও ব্যাংকের বাইরে থাকা টাকার পরিমাণ কম ছিল। সেই অঙ্ক ৫ হাজার ৭৪৩ কোটি টাকা। গত সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকের বাইরে মানুষের হাতে ছিল ২ লাখ ৮৪ হাজার কোটি টাকা।
অর্থনীতিবিদদের মতে, ব্যাংকের বাইরে থাকা টাকার পরিমাণ বেড়ে গেলে সেটি অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর হয়। কারণ ব্যাংকের বাইরে থাকলে টাকার হাতবদল হওয়া কমে যায়, যা দিনশেষে ‘মানি ক্রিয়েশন’ কমিয়ে দেয়। মানুষের হাতে থাকা টাকা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ব্যাংকে ফিরলে একদিকে যেমন ব্যাংকের তারল্য পরিস্থিতি ভালো হয়, অন্যদিকে ঋণ দেওয়ার মতো তহবিলের পরিমাণ বাড়ায় দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধির মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, ২০২৩ সালের অক্টোবরে ব্যাংকের বাইরে থাকা টাকার পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৪৬ হাজার কোটি টাকা। এরপর থেকে প্রতি মাসেই এর পরিমাণ ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। ২০২৪ সালের জুলাই শেষে ব্যাংকের বাইরে থাকা টাকার পরিমাণ সর্বোচ্চ ২ লাখ ৯২ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছে। গত সেপ্টেম্বর থেকে পরিস্থিতি ভিন্ন মোড় নিয়েছে। ব্যাংকে ফিরতে শুরু করেছে বাইরে থাকা টাকা। মূলত ব্যাংকিং ব্যবস্থার ওপর আস্থা ফেরত আসতে শুরু করায় জমানো টাকা ব্যাংকে জমা দিচ্ছে মানুষ।
এদিকে ভালো ব্যাংকগুলোর প্রতি মানুষের আস্থা বাড়ায় এবং ব্যাংক নামে-বেনামে ঋণ বের হওয়া কমতে থাকায় দেশের ব্যাংকিং খাতে আমানত প্রবৃদ্ধি গত তিন মাস ধরে বাড়ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত নভেম্বরে ব্যাংকগুলোতে আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ৬৩ হাজার ৩২৮ কোটি টাকা, যা ২০২৩ সালের একই মাসের তুলনায় ১ লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা বেশি। ২০২৩ সালের নভেম্বর শেষে ব্যাংকিং খাতে আমানত ছিল ১৬ লাখ ৪০ হাজার ৯৮১ কোটি টাকা।
গত বছরের আগস্টে আমানতে প্রবৃদ্ধি ছিল ১৮ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। ওই মাসে আমানত প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৭ দশমিক ০২ শতাংশ। তবে সেপ্টেম্বর থেকে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হতে শুরু করে। ওই মাসে আগের মাসের তুলনায় আমানত বাড়ে ১৪ হাজার ২০৮ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বরে আমানতে প্রবৃদ্ধির হার বেড়ে হয় ৭ দশমিক ২৬ শতাংশ। অক্টোবরে আমানতে প্রবৃদ্ধি হয় আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ। অক্টোবর শেষে ব্যাংক খাতে মোট আমানতের পরিমাণ ছিল ১৭ দশমিক ৫৫ লাখ কোটি টাকা।
বেশ কয়েকটি ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ব্যাংক খাত থেকে অনিয়মের মাধ্যমে ঋণ নেওয়ার বেশ কিছু ঘটনা প্রকাশের পর গ্রাহকদের আস্থাহীনতাই কম প্রবৃদ্ধির মূল কারণ। পাশাপাশি দুর্বল ব্যাংকগুলো থেকে গ্রাহকরা তাদের আমানতের টাকা ঠিকমতো ফেরত না পাওয়ায় খাতটি নিয়ে আতঙ্ক বেড়ে যায়। পরে ড. আহসান এইচ মনসুর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত অন্তত ১১টি ব্যাংকের বোর্ড পুনর্গঠন, জরুরি প্রয়োজন মেটাতে টাকা ছাপিয়ে তারল্য সহায়তা দেওয়া, বেনামি ঋণ ইস্যু ঠেকানোসহ নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এসব পদক্ষেপের কারণে দুর্বল ব্যাংকগুলোর অবস্থা খুব বেশি ভালোর দিকে না গেলেও খারাপের দিকে যাওয়া ঠেকানো গেছে। আবার ভালো ব্যাংকগুলোর প্রতি গ্রাহকদের আস্থা বাড়তে থাকায় এই ব্যাংকগুলোতে আমানত বাড়তে শুরু করেছে।
অন্যদিকে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় প্রবাহও বাড়ছে। রেমিট্যান্স দেশে এলে এর একটি অংশ ব্যাংকে জমা করেন প্রবাসীদের স্বজনরা। এতেও ব্যাংকের আমানত বৃদ্ধি পায়। অপরদিকে ডলার সরবরাহ স্বাভাবিক হওয়ায় নতুন এলসি খোলা হচ্ছে। এলসি খুলতে প্রয়োজনীয় ডলার কিনতে ব্যবসায়ীরা যে নগদ অর্থ জমা করছেন সেটিও এতদিন হাতে থাকা টাকা হিসেবে গণ্য ছিল। সব মিলিয়ে নানা উপায়ে হাতের টাকা ব্যাংকে যাচ্ছে। এতে অর্থনীতি গতিশীল হয়েছে।
গত ডিসেম্বর মাসে দেশে প্রবাসী আয়ের নতুন ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে। সদ্য সমাপ্ত ২০২৪ সালের বাংলাদেশের প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ রেমিট্যান্সের পরিমাণ ২৬ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে নতুন রেকর্ড গড়েছে। ২০২৪ সালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসী বাংলাদেশিরা ২ হাজার ৬৮৯ কোটি ডলার (২৬ দশমিক ৮৯ বিলিয়ন) সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা পাঠিয়েছেন।