আহমেদ ফেরদাউস খান
প্রকাশ : ১৪ জানুয়ারি ২০২৫ ২১:৪৭ পিএম
আপডেট : ১৪ জানুয়ারি ২০২৫ ২১:৫১ পিএম
দেশের পুঁজিবাজারে অস্থিরতা বাড়ছেই। এ বছরে লেনদেন হওয়া ১০ দিনের সাত দিনই সূচকের পতন হয়েছে। চলতি সপ্তাহে লেনদেন হওয়া তিন দিনই সূচক কমেছে। গতকাল শুরুতে সূচক বাড়লেও দিনশেষে পতনেই শেষ হয়েছে লেনদেন। এদিকে প্রতিনিয়ত পতন হওয়ায় পুঁজিবাজারে আগ্রহ হারাচ্ছে বিনিয়োগকারীরা। টানা দরপতনে অনেকে আর ভরসা রাখতে পারছেনা। এ আস্থাহীনতার কারণে পুঁজিবাজার আর আগের গতি ফিরে পাচ্ছেন না বলে মনে করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
তাদের মতে, নিয়ন্ত্রক সংস্থার ভুল সিদ্ধান্ত ও বিগত সরকারের লুটপাটই অব্যাহতভাবে পুঁজিবাজারে দরপতন হওয়ার কারণ। তাছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে ভ্যাট-ট্যাক্স বৃদ্ধি পাওয়ায় পুঁজিবাজারের ওপর একটা প্রভাব পড়েছে। এ থেকে বের হতে অনেক সময় লাগবে।
এবিষয়ে মিডওয়ে সিকিউরিটিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আশিকুর রহমান প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘পুঁজিবাজারের সমস্যা এখনো কাটেনি। আরো নতুন করে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। সরকার যে ভ্যাট-ট্যাক্স বাড়িয়েছে- এর প্রভাব পড়ছে বাজারে। তাছাড়া নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর একের পর ভুলের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে পুঁজিবাজারে। বিনিয়োগকারীদের ভুল শেয়ারে বিনিয়োগ করা এখনো কমেনি।’
আর বিনিয়োগকারীরা বলছেন, পুঁজিবাজার অস্থিতিশীল হওয়ায় তারা বাজারে বিনিয়োগ করার আস্থা পাচ্ছেন না। অনেকে মার্জিন ঋণের খপ্পরে পড়ে ফোর্স সেলের শিকার হয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে ছেড়েছেন বাজার।
পুঁজিবাজারে সাধারণ বিনিয়োগকারী জাকির হোসেন প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘পুঁজিবাজারে আমরা আসছি লভ্যাংশ নিতে, মূলধন হারাতে নয়। কিন্তু বেশ কিছু দিন ধরে আমরা লভ্যাংশ তো পাচ্ছিই না। উল্টো হারাচ্ছি। টানা লোকসান হওয়ায় পুঁজিবাজারে আমরা বিনিয়োগ করতে আস্থা পাচ্ছি না।’
মার্জিন ঋণ প্রসঙ্গে আরেক বিনিয়োগকারী নাইম সালেহীন বলেন, ‘বাজারে আগ্রহ ছিল বলেই অনেকে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করেছেন। কিন্তু দেদারসে শেয়ারের দাম কমতে থাকায় মার্জিন ঋণের খপ্পরে পড়েন তারা। একদিকে মাঝারি বা খারাপ মানের শেয়ারের দাম কমায় টান পড়ছে ঋণের টাকায়। অন্যদিকে ফোর্স সেল হওয়ায় বিক্রি হয়ে যাচ্ছে ভালো শেয়ারও। এতে করে সর্বস্বান্ত হয়ে ফিরে যেতে হচ্ছে বিনিয়োগকারীদের।’
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০২৪ সালজুড়ে পুঁজিবাজারে বড় দরপতন হয়। এতে এক বছরে ডিএসইর বাজার মূলধন কমেছে ১ লাখ ১৮ হাজার ২৩০ কোটি টাকা। বাজার মূলধনের বড় পতনের পাশাপাশি মূল্যসূচকেরও বড় পতন হয় বছরটিতে। ২০২৪ সালে ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক কমে ১ হাজার ৩০ পয়েন্ট।
এমন দরপতনের পর নতুন বছর ২০২৫ সালে পুঁজিবাজারে সুদিন দেখা যাবে এমন প্রত্যাশায় ছিলেন বিনিয়োগকারীরা। কারণ অব্যাহত দরপতনের কবলে পড়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সার্বিক মূল্য আয় অনুপাত (পিই) ৯ দশমিক ৫০ পয়েন্ট নেমে যায়। নতুন বছরেও পুঁজিবাজারে সুদিন ফেরেনি। বরং আগের মতোই দরপতনের বৃত্তেই আটকে রয়েছে পুঁজিবাজার। ফলে বিনিয়োগকারীদের লোকসানের পাল্লা দিন যত যাচ্ছে তত ভারী হচ্ছে।’
তবে বিগত সরকারের লুটপাটকে দুষছেন ব্রোকারেজ মালিকদের সংগঠন ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) সাবেক সভাপতি মোশতাক আহমেদ সাদেক। তিনি প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘বিগত সরকার কোটি কোটি টাকা লুটপাট করার কারণে পুঁজিবাজারে আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। সেখান থেকে বাজার বের হতে পারছে না। বিনিয়োগকারীরা এখনো পুঁজিবাজারকে আস্থায় নিতে পারেনি। স্বৈরাচার সরকারের অনুগত লোক দিয়ে বিএসইসি নিয়ন্ত্রন করতো। এরপর তারা পুঁজিবাজার থেকে হাজার কোটি টাকা নিয়ে যায়।’
গত তিন মাসে নিম্নমানের দরপতনের কারণে বেক্সিমকো লিমিটেড, সামিট পাওয়ার, ইসলামী ব্যাংক, হাইডেলবার্গ, লিন্ডে এবং ওরিয়ন ফার্মাসহ নয়টি হেভিওয়েট কোম্পানি ঢাকার শীর্ষ ৩০টি শেয়ারের তালিকা থেকে ছিটকে পড়েছে।
এই কোম্পানিগুলো বিনিয়োগকারীদের আস্থার বাইরে চলে গেছে। ফলে তারা শীর্ষ ৩০টি শেয়ারের তালিকা থেকে ছিটকে গেছে। এ বিষয়টিও পুঁজিবাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘ এখানে মূল সমস্যা বিনিয়োগকারীরা বাজারে লেনদেনে আত্মবিশ্বাস পাচ্ছেন না। অনেক বিও অ্যাকাউন্ট বহুদিন ধরে অকার্যকর হয়ে পড়েছিল। অনেকে আবার অ্যাকাউন্টের টাকা তুলে বাজার থেকে চলে গেছেন। সব মিলিয়ে বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের ভরসা কমে গেছে। এখন যা জরিমানা হচ্ছে তার বেশিরভাগই আগের কমিশনের। কারসাজির ৯৮ শতাংশ বিচার তারা করেননি, যা বর্তমান কমিশনকে এসে করতে হচ্ছে। অপরাধীদের সাজা না দিলে বাজারে শৃঙ্খলা ফিরবে না।’
ডিএসইর হিসাব অনুযায়ী, পুঁজিবাজার থেকে ১২ লাখ বিনিয়োগকারী কমে গেছে। ২০২৩ সালে বাজারে বিও অ্যাকাউন্টধারী ছিলেন ১৭ লাখ ৫৬ হাজার ১০৪ জন। ২০২৪ সালে কমে হয়েছে ১৬ লাখ ৬৪ হাজার ৯৫২। সে হিসাবে এক বছরে বিনিয়োগকারী কমেছে ৯০ হাজারেও বেশি। আর ২০১৬ সালে ঢাকার পুঁজিবাজারে মোট বিও অ্যাকাউন্ট ছিল ২৯ লাখ ২৯ হাজার ১৮৯টি। যা আট বছরে বিনিয়োগকারী কমেছে ১২ লাখ ৬৪ হাজার ২৩৭ জন।
মঙ্গলবারও দরপতন
রবি ও সোমবার দরপতনের পর গতকাল মঙ্গলবারও ডিএসইতে দিনের লেনদেন শেষে দাম বেড়েছে ১৮১টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিট। কমেছে ১৩১টির এবং ৮৪টির দাম অপরিবর্তিত। এরপরও ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স আগের দিনের তুলনায় ১ পয়েন্ট কমে ৫ হাজার ১৫০ পয়েন্টে নেমে গেছে।
অপর দুই সূচকের মধ্যে ডিএসই-৩০ সূচক আগের দিনের তুলনায় ১ পয়েন্ট কমে ১ হাজার ৯০৪ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। তবে ডিএসই শরিয়াহ্ সূচক আগের দিনের তুলনায় ১ পয়েন্ট বেড়ে ১ হাজার ১৫৮ পয়েন্টে অবস্থান করছে। লেনদেন হয়েছে ৩৫১ কোটি ১৪ লাখ টাকা। আগের কার্যদিবসে লেনদেন হয় ৩৯৭ কোটি ৮১ লাখ টাকা। সে হিসাবে আগের কার্যদিবসের তুলনায় লেনদেন কমেছে ৪৬ কোটি ৬৭ লাখ টাকা।
অপরবাজার সিএসইর সার্বিক সূচক সিএএসপিআই কমেছে ১৬ পয়েন্ট। ৮৫টির দাম বেড়েছে, কমেছে ৭২টির এবং ৩০টির দাম অপরিবর্তিত। লেনদেন হয়েছে ১১ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। আগের কার্যদিবসে লেনদেন হয় ৫৪ কোটি ৩ লাখ টাকা।
দুয়ার সার্ভিসেসের কিউআইওর চাঁদাগ্রহণ স্থগিত
পুঁজিবাজারের এসএমই খাতে তালিকাভুক্তির অপেক্ষায় থাকা তথ্যপ্রযুক্তি খাতের কোম্পানি দুয়ার সার্ভিসেস পিএলসির কোয়ালিফায়েড ইনভেস্টর অফারের (কিউআইও) সাবস্ক্রিপশন বা চাঁদা গ্রহণ স্থগিত করেছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
গতকাল বিএসইসির চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত কমিশনের ৯৩৯তম সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে কোম্পানিটির বিষয়ে খতিয়ে দেখতে একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছে। বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
বিএসইসির পক্ষ থেকে জানানো হয়, গত বছরের ২৭ এপ্রিল কিউআইওর মাধ্যমে পাঁচ কোটি টাকা উত্তোলনের জন্য কমিশনে আবেদন করে দুয়ার সার্ভিসেস। এরপর গত জুনে বিএসইসির ৯১১তম সভায় দুয়ার সার্ভিসেসকে শর্তসাপেক্ষে অভিপ্রায়পত্র (লেটার অব ইন্টেন্ট) এবং ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত কমিশনের ৯৩৪তম সভায় কোম্পানিটিকে সম্মতিপত্র (কনসেন্ট লেটার) দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এর ধারাবাহিকতায় কিউআইও অফারের শেয়ার বরাদ্দের জন্য চলতি বছরের ১৯ থেকে ২৩ জানুয়ারি তারিখ নির্ধারণ করে দুয়ার সার্ভিসেস।