× ই-পেপার প্রচ্ছদ সর্বশেষ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ধর্ম ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

বৈদেশিক বাণিজ্যে যমুনা ব্যাংকে অনিয়মের পাহাড়

রেদওয়ানুল হক

প্রকাশ : ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৯:১৪ এএম

আপডেট : ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪ ১০:০৫ এএম

প্রবা গ্রাফিক্স

প্রবা গ্রাফিক্স

রপ্তানিপণ্যের অর্থ দেশে না এনে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়কে রপ্তানি আয় দেখিয়েছে যমুনা ব্যাংক। এমনকি রপ্তানিপণ্যের ৭০ হাজার ডলার দেশে প্রত্যাবাসন না করার সুস্পষ্ট প্রমাণ মিলেছে ব্যাংকটির বিরুদ্ধে। এসব লেনদেনকে সন্দেহজনক হিসেবে চিহ্নিত করেছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। যা রপ্তানির আড়ালে অর্থ পাচারকে নির্দেশ করে। এমন পাঁচটি সন্দেহজনক লেনদেনের প্রমাণসহ প্রতিবেদন দাখিল করেছে অর্থিক দুর্নীতি প্রতিরোধ সংস্থাটি। এ ছাড়া আমদানিপণ্যের আড়ালে মাদক আনার অভিযোগও রয়েছে ব্যাংকটির বিরুদ্ধে। সংশ্লিষ্ট সূত্র এবং তদন্ত প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। 

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঋণপত্রের (এলসি) ইস্যুর তারিখ থেকে বিল অব লেডিং ইস্যুর তারিখ গরমিল করে জালিয়াতির আশ্রয় নেওয়া হয়। এ ছাড়া বিল অব এক্সচেঞ্জে ঠিকানা পরিবর্তন করে অস্ট্রেলিয়ার পরিবর্তে সিঙ্গাপুরের ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে। এখানেই শেষ নয়, এক দেশে উৎপাদিত কৃষিজাত পণ্য অন্য দেশ থেকে জাহাজীকরণ করা হয়। যা অবাস্তব ও ব্যয়বহুল। অন্যদিকে আমদানিপণ্যে কোকেনের অস্থিত্ব পাওয়ার পরও গ্রাহকের বিষয়ে কোনো প্রকার যাচাই-বাছাই করা হয়নি।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যাংক লিইউমি ইউএসএ কর্তৃক ইস্যুকৃত ২ লাখ ৮ হাজার ৩৮ মার্কিন ডলার মূল্যমানের ঋণপত্রের বিপরীতে যমুনা ব্যাংকের নারায়ণগঞ্জ শাখার গ্রাহক রাসেল অ্যাপারেলস কর্তৃক এক্সপ্রেস ট্রেড ক্যাপিটাল ইনকরপোরেশন, ইউএসএর উদ্দেশ্যে ২ লাখ ১২ হাজার ৭২৯ মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি করা হয়েছে। উক্ত রপ্তানির বিপরীতে সিটি ব্যাংক এনএর মাধ্যমে ব্লুস্টার ফ্যাশন ইনকরপোরেশন কর্তৃক ৪৫ হাজার ৯৪৩ মার্কিন ডলার এবং গ্লোবাল ক্যাপিটাল ফ্যাশন ইনকরপোরেশন কর্তৃক ৯৬ হাজার ৪৬৩ মার্কিন ডলার রপ্তানির মূল্য প্রত্যাবাসন দেখানো হয়। কিন্ত বিএফআইইউর তদন্তে উঠে আসে এসব অর্থ মূলত রেমিট্যান্স ছিল। ব্যাংকটি প্রবাসী আয়কে রপ্তানি আয় দেখিয়ে রপ্তানির অর্থ আনেনি। যা রপ্তানির আড়ালে অর্থ পাচারের শামিল। এমনকি উল্লিখিত রেমিট্যান্সও রপ্তানির পুরো অর্থের থেকে ৭০ হাজার ৩২২ মার্কিন ডলার কম। যা পরে আর আনা হয়নি। অর্থাৎ রেমিট্যান্স বা রপ্তানি আয় কোনোভাবেই দেশে আসেনি এই ৭০ হাজার ডলার। বিএফআইইউ এটিকে সন্দেহজনক লেনদেন হিসেবে চিহ্নিত করে প্রতিবেদন দাখিল করে।

এ ঘটনায় যমুনা ব্যাংকের পক্ষ থেকে দেওয়া ব্যাখ্যা নাকচ করে দিয়েছে বিএফআইইউ। ব্যাংকটি দাবি করে, বিদেশি ক্রেতা এক্সপ্রেস ট্রেড ক্যাপিটাল ইনকরপোরেশন ও রেমিট্যান্স প্রেরণকারী প্রতিষ্ঠান দুটি মূলত সিস্টার কনসার্ন বা অঙ্গপ্রতিষ্ঠান। তবে বিএফআইইউ বলছে, রপ্তানি সম্পাদিত হয়েছে ঋণপত্রের বিপরীতে, যার মূল্য ঋণপত্র ইস্যুয়িং ব্যাংকের মাধ্যমে প্রত্যাবাসিত হতে হবে বিধায় রেমিট্যান্স প্রেরণকারী প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংক ভিন্ন হওয়ার সুযোগ নেই। এ ছাড়া রেমিট্যান্স প্রেরণকারী ও আমদানিকারকের সম্পর্ক প্রমাণক হিসেবে উপস্থাপিত ব্লুস্টার ফ্যাশন ইন করপোরেশনের পত্রে কোনো তারিখ ও সূত্র নম্বর উল্লেখ নেই। আবার এসব প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধনের বিষয়েও কোনো তথ্য উল্লেখ করা হয়নি। অর্থাৎ তৃতীয় পক্ষের রেমিট্যান্সকে রপ্তানি আয় প্রত্যাবাসন দেখানোর বিষয়ে ব্যাংকের বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়। ফলে গ্রাহকের সামগ্রিক কার্যক্রম ছিল সন্দেহজনক।

এ ছাড়া ঋণপত্র ইস্যুর আগে বিল অব লেডিং ইস্যু করার প্রমাণও পেয়েছে বিএফআইইউ। আর এলসি মূল্য থেকে ডকুমেন্ট মূল্যও দেখানো হয়েছে বেশি। এ ছাড়া বিল অব এক্সচেঞ্জে অস্ট্রেলিয়ার পরিবর্তে সিঙ্গাপুরের ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে।

যমুনা ব্যাংকের এই গ্রাহকের বিষয়ে বিএফআইইউর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খাতুনগঞ্জ শাখার গ্রাহক সাঈদ ফুডস লিমিটেড কর্তৃক প্রায় ৭৬ লাখ মার্কিন ডলার মূল্যের আমদানিতে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে। এর মধ্যেÑ এলসি মূল্য সাড়ে ৬৭ লাখ মার্কিন ডলার হলেও ডকুমেন্ট মূল্য এসেছে প্রায় ৭৬ লাখ মার্কিন ডলার। তারপর মূল বিল অব লেডিংয়ের পরিবর্তে নন-নেগোশিয়েবল চার্টার পার্টি বিল অব লেডিং প্রেরণ করা হয়েছে। এরপর চার্টার পার্টি বিল অব লেডিংয়ের পোর্ট অব লোডিংÑ ওয়ালারু হলেও প্লেস অব ইস্যু উল্লেখ রয়েছে ব্রিসবেন। এ ছাড়া ঋণপত্র ইস্যু এবং বিল অব লেডিং তারিখে গরমিল রয়েছে। অন্যদিকে বিল অব এক্সচেঞ্জে অস্ট্রেলিয়ার পরিবর্তে সিঙ্গাপুরের ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে। 

এ ছাড়া ৬১ কোটি ৩০ লাখ টাকা দায় অবলোপনের আগে মানি লন্ডারিংয়ের সম্ভাবনা যাচাই করা হয়নি। এসব অনিয়মের পরিপ্রেক্ষিতে সন্দেহজনক লেনদেন হিসেবে রিপোর্ট করে বিএফআইইউ।

প্রতিবেদন বলছে, যমুনা ব্যাংকের পক্ষ থেকে অনিয়মের বিষয়ে ত্রুটি স্বীকার করা হয়েছে। তবে বিএফআইইউ তাদের মতামতে বলেছে, ইস্যুকৃত ঋণপত্রের দলিলাদি হিসেবে দাখিলকৃত বিল অব লেডিং (বিএল) ভিন্ন তারিখে ইস্যু করা হয়েছে। একই সঙ্গে ঋণপত্রের নম্বর ও তারিখ ত্রুটিযুক্ত থাকার পরও আমদানিকারকের স্বীকৃতির পরিপ্রেক্ষিতে বিলমূল্য পরিশোধের সুযোগ নেই। অর্থাৎ ব্যাংকটির দায়সারা বক্তব্য বিএফআইইউর কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। এ ছাড়া বিদেশি (অস্ট্রেলিয়ান) সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান জে কে ইন্টারন্যাশনাল একটি ব্যক্তি মালিকানাধীন (ভারত বংশোদ্ভূত) ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান, যার অনুকূলে সাড়ে ৬৭ লাখ মার্কিন ডলার মূল্যমানের ঋণপত্র স্থাপন করার বিষয়টিও সন্দেহজনক। ফলে সামগ্রিকভাবে গ্রাহকের লেনদেন সন্দেহজনক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

বিএফআইইউর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লা শাখার গ্রাহক নুর ট্রেডিং কোম্পানির আমদানি কার্যক্রমে দেখা যায়Ñ কৃষিজাত পণ্য উৎপাদনকারী দেশ ভারতের পরিবর্তে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে শিপমেন্টের শর্ত উল্লেখ করা হয়েছে, যদিও শিপমেন্ট করা হয়েছে শ্রীলঙ্কার কলম্বো থেকে।

প্রসঙ্গত, এক দেশে উৎপাদিত কৃষিজাত পণ্য অন্য দেশ থেকে জাহাজীকরণ করাটা মূল্য সাশ্রয়ী নয়। তাই এটি অযৌক্তিক হিসেবে বিএফআইইউর কাছে বিবেচিত হয়। এ ছাড়া গ্রাহক প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারীর মালিকানাধীন অপর প্রতিষ্ঠান কর্তৃক অন্য ব্যাংকের মাধ্যমে আমদানিকৃত পণ্য খালাসের জন্য চট্টগ্রাম বন্দরে অপেক্ষমাণ থাকা অবস্থায় চালানে মাদকপণ্য ‘কোকেন’-এর অস্তিত্ব ধরা পড়ে। সর্বশেষ গ্রাহকের ৮ কোটি ৬৩ লাখ টাকা দায় অবলোপন করা হয়েছে। গ্রাহকের এরূপ আমদানির বিষয়ে ট্রেড বেইজড মানি লন্ডারিংয়ের (টিবিএমএল) সম্ভাব্যতা যাচাই শেষে সন্দেহজনক লেনদেন রিপোর্ট দাখিল করা দরকার ছিল। একই সঙ্গে দায় অবলোপনের আগে মানি লন্ডারিংয়ের সম্ভাবনা যাচাই করা আবশ্যক ছিল।

যদিও ব্যাংকের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছেÑ যে পণ্য চালানে কোকেনের অস্তিত্ব ধরা পড়েছে তা যমুনা ব্যাংকের আমদানিসংশ্লিষ্ট নয়। কিন্তু তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বিএফআইইউ বলেছে, গ্রাহক প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারীর মালিকানাধীন অপর প্রতিষ্ঠান কর্তৃক অন্য ব্যাংকের মাধ্যমে আমদানিকৃত পণ্য খালাসের জন্য চট্টগ্রাম বন্দরে অপেক্ষমাণ থাকা অবস্থায় চালানে মাদকপণ্য কোকেনের অস্তিত্ব ধরা পড়ে। এ বিষয়ে সে সময় বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হলেও যমুনা ব্যাংক উক্ত বিরূপ প্রতিবেদন আমলে নিয়ে গ্রাহকের বৈদেশিক লেনদেনে ট্রেড বেইজড মানি লন্ডারিংয়ের (টিবিএমএল) সম্ভাব্যতা যাচাই ও সন্দেহজনক লেনদেনের রিপোর্ট দাখিল করেনি। এটি মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২-এর ২৩(৫) ধারা মোতাবেক শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

এ বিষয়ে জানতে যমুনা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মির্জা ইলিয়াস উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোরছালীন বাবলা

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা