প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২২ ডিসেম্বর ২০২৪ ২১:৫৩ পিএম
স্থবিরতা কাটিয়ে চাঙ্গা হয়ে উঠছে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক বাণিজ্য। রপ্তানিতে বাজিমাত করেছে ব্যাংকগুলো। একই সঙ্গে চাঙ্গাভাব দেখা যাচ্ছে আমদানিতেও। রেমিট্যান্সপ্রবাহ ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। তবে আমানতকারীদের আস্থার সংকট এখনও পুরোপুরি কাটেনি। আমানতের মন্দাভাবের মধ্যেও বৃদ্ধি পাচ্ছে বিনিয়োগ। এর অর্থ হচ্ছেÑ শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোতে অচলাবস্থা কেটে গেছে। এখন আমানতকারীদের আস্থা ফেরত এলেই শক্তিশালী হয়ে উঠবে ব্যাংকগুলো। কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রকাশিত চলতি বছরের তৃতীয় প্রান্তিক তথা জুলাই-সেপ্টেম্বরের প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, পতিত হাসিনা সরকারের আমলে ইসলামী ব্যাংকগুলোকে লুটপাটের অন্যতম ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নেয় বিভিন্ন লুটেরা গোষ্ঠী। এতে দুর্বল হয়ে পড়ে মানুষের আস্থার জায়গায় শীর্ষে থাকা শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলো। দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংক খাতের অনিয়ম শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো চেপে রাখা হলেও ৫ আগস্টের পর এসব অনিয়মের প্রকৃত চিত্র বেরিয়ে আসতে থাকে। আস্থার সংকট তৈরি হয় পুরো ব্যাংক খাতে। এমন পরিস্থিতিতে লুটেরাদের লুটপাটের খেসারত দিতে হচ্ছে সংকটে থাকা বেশ কয়েকটি ব্যাংককে। বিশেষ করে, সঞ্চয়কারীদের মধ্যে আস্থা কমে যাওয়ায় ইসলামী ব্যাংকগুলোর আমানত ক্রমাগত কমছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ইসলামী ব্যাংকগুলোর আমানত কমেছে সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকারও বেশি। তবে ইতোমধ্যে বৈদেশিক বাণিজ্যে স্থবিরতা কেটে গেছে। আমদানি-রপ্তানি চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। প্রবাসী বাংলাদেশিরা ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোতে ফের রেমিট্যান্স পাঠাতে শুরু করেছেন। তাই ক্রমাগত বাড়ছে প্রবাসী আয়। তাই সঠিক পদক্ষেপ নিতে পারলে ইসলামী ব্যাংকগুলো আবারও শীর্ষস্থান দখল করবে বলে মত সংশ্লিষ্টদের। কারণ দেশে ইসলামী ব্যাংকের ওপর মানুষের প্রবল আস্থা রয়েছে।
শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক বাণিজ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গত জুন প্রান্তিকে ব্যাংকগুলোর রপ্তানির স্থিতি ছিল ২৮ হাজার ২০৪ কোটি টাকা, যা সেপ্টেম্বর শেষে দাঁড়িয়েছে ৩৫ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা। সে হিসাবে রপ্তানি বেড়েছে ৭ হাজার ১১১ কোটি টাকা বা ২৫ শতাংশ। পাশাপাশি আমদানিও ১০ শতাংশ বেড়েছে। গত জুন শেষে ইসলামী ব্যাংকগুলোর আমদানির স্থিতি ছিল ৪২ হাজার ৬১ কোটি টাকা। গত সেপ্টেম্বর শেষে স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৪৬ হাজার ৬২৭ কোটি টাকা। সে হিসাবে আমদানি বেড়েছে ৪ হাজার ৫৬৬ কোটি টাকা। এসব ব্যাংকের বৈদেশিক বাণিজ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর শর্ত না থাকলে আমদানি প্রবৃদ্ধি আরও বেশি হতো বলে জানিয়েছেন ব্যাংকগুলোর শীর্ষ নির্বাহীরা।
জানা গেছে, গত ১৯ আগস্ট বিগত সরকারের বিশেষ আনুকূল্যে এস আলম গ্রুপ মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল এমন ছয় ব্যাংকের ঋণ বিতরণে বিধিনিষেধ আরোপ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ছাড়া শতভাগ মার্জিন ছাড়া নতুন করে এলসি (ঋণপত্র) না খোলারও নির্দেশনা দেওয়া হয়। ব্যাংকগুলো হলোÑ ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, সোশ্যাল ইসলামী, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, ইউনিয়ন, গ্লোবাল ইসলামী ও বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক। তবে গত ৫ ডিসেম্বর এই ছয় ব্যাংকের এলসি খোলায় শতভাগ মার্জিনের বাধ্যবাধকতা তুলে নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
এ ছাড়া ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোতে বড় উল্লম্ফন হয়েছে প্রবাসী আয়ে। শত সংকটের পরও ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমেই রেমিট্যান্স পাঠাতে আস্থা রেখেছেন প্রবাসীরা। তথ্য বলছেÑ গত জুন শেষে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকের মাধ্যমে আসা রেমিট্যান্সের স্থিতি ছিল ২৭ হাজার ৮২৬ কোটি টাকা। তিন মাসের ব্যবধানে অর্থাৎ গত সেপ্টেম্বর শেষে রেমিট্যান্সের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা। সে হিসাবে তিন মাসে বেড়েছে ৩ হাজার ৬৭ কোটি টাকা। এদিকে বছরের ব্যবধানেও রেমিট্যান্স বেড়েছে এসব ব্যাংকে। এক বছর আগে অর্থাৎ গত বছরের সেপ্টেম্বরে প্রবাসী আয় এসেছিল ২৮ হাজার ৪৭ কোটি টাকা।
তবে আমানতকারীদের আস্থা তলানিতে নামে আলোচ্য তিন মাসে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর আমানতের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৩৬ হাজার ৬৬৭ কোটি টাকা। যা গত জুন শেষে ছিল ৪ লাখ ৪৫ হাজার ৩০৯ কোটি টাকা। সে হিসাবে তিন মাসের ব্যবধানে আমানত কমেছে ৮ হাজার ৬৪২ কোটি টাকা। তবে পূর্ণাঙ্গ শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোতে আমানত কমলেও প্রবৃদ্ধি দেখা গেছে প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলোর ইসলামী ব্যাংকিং শাখা ও উইন্ডোগুলোতে।
একটি ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান বলেন, ‘ইসলামী ব্যাংকগুলোকে দাঁড় করাতে আমরা চেষ্টা করছি। এই সংকটাবস্থায়ও আমরা নতুন আমানত সংগ্রহ করছি। ইসলামী ব্যাংকগুলোতে একটা প্যানিক তৈরি হয়েছিল। যার কারণে অনেক গ্রাহক একসাথে টাকা তুলতে এসেছিল। এখন এক দিনে যদি সব মানুষ টাকা তুলতে আসে তবে তো কোনো ব্যাংকই তা দিতে পারবে না। আর বাংলাদেশ ব্যাংক আমাদের যে তারল্য সহায়তা দিয়েছে, তা যদি সময়মতো পাওয়া যেত, তবে এই সংকট তৈরি হতো না। আমরা যদি গ্রাহকের চাওয়ার সাথে সাথে টাকা দিতে পারতাম, তবে তারা আবারও আমাদের ব্যাংকেই টাকা রাখত। কারণ আমাদের ওপর তাদের আস্থা আছে। এখন আমরা চেষ্টা করছি। আশা করছি, খুব শিগগিরই সংকট কেটে যাবে।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত সেপ্টেম্বর শেষে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর ঋণ বা বিনিয়োগ দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৭০ হাজার ৪৪৩ কোটি টাকা। যা গত জুন মাস শেষে ছিল ৪ লাখ ৬৮ হাজার ৬৬৮ কোটি টাকা। সে হিসাবে বিনিয়োগ বেড়েছে ১ হাজার ৯৭৫ কোটি টাকা। তবে পূর্ণাঙ্গ শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ সামান্য কমেছে। বেড়েছে ইসলামী ব্যাংকিং শাখা ও উইন্ডোগুলোতে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক আব্দুল আউয়াল সরকার বলেন, ‘ইসলামী ব্যাংকগুলোতে সবচেয়ে বড় সমস্যা খেলাপি ঋণ। অথচ শরিয়াহ ব্যাংকগুলোতে খেলাপির বিষয়ে কঠোর পলিসি আছে। ইসলামী শরিয়াহ অনুযায়ী যদি কেউ ইচ্ছাকৃত খেলাপি হয়, তবে প্রথম পদক্ষেপ তাকে গ্রেপ্তার করতে হবে। তাকে আটক রেখে খেলাপি আদায় করে তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে। এসবের আমরা কখনও বাস্তবায়ন দেখিনি। এখন গভর্নর কিছু দিন আগে অ্যাসেট অ্যাকুইজিশনের (সম্পদ অধিগ্রহণ) কথা বলেছিলেন। খেলাপিদের যাদের সম্পদ আছে সেগুলো বিক্রি করে দেওয়ার কথা বলেছিলেন। এটার যদি একটা নজির স্থাপন করতে পারেন, তবে খেলাপি ঋণের একটা বড় অংশ আদায় করা সম্ভব হবে। তারল্য আবারও স্বাভাবিক হবে।’