প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪ ২০:৫৩ পিএম
মূল্যস্ফীতির কশাঘাতে জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে দিশাহারা মানুষ। এর বাইরে নয় শিক্ষার্থীরাও। মাসিক হাতখরচ আর বৃত্তির টাকায় পড়ালেখা ও থাকা-খাওয়ার ব্যয় মিটিয়ে কিছু সঞ্চয় করত অনেক শিক্ষার্থী। এখন সে সামর্থ্য হারিয়ে ফেলেছে তারা। অনেকে সঞ্চয়ের আশায় হিসাব খুলছে। কিন্তু ব্যয়ের চাপে জমা করতে পারছে না তারা। ফলে শিক্ষার্থীদের সঞ্চয় হিসাব বাড়লেও কমেছে সঞ্চয় স্থিতি। চার মাস ধরে টানা কমতে থাকায় শিক্ষার্থীদের হিসাব স্থিতি দুই হাজার কোটি টাকায় নেমে এসেছে।
তথ্য বলছে, দেশে প্রায় তিন বছর ধরে গড় মজুরির চেয়ে মূল্যস্ফীতি বেশি। অর্থনীতির পরিভাষায় মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি কম হলে সেটি অর্থনীতির সংকটকে ইঙ্গিত করে। দুই বছর ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে দেশের পরিবারগুলোর আয় কমে গেছে। এতে সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে মানুষ। পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, দেশের শিক্ষা ব্যয়ও বাড়ছে প্রতি মাসে। এর প্রভাব পড়েছে স্কুল শিক্ষার্থীদের সঞ্চয়েও। গেল অর্থবছরের শেষ দিকে অর্থাৎ জুন মাসে কিছুটা প্রবৃদ্ধি থাকলেও নতুন অর্থবছরের শুরু থেকেই ধারাবাহিকভাবে কমছে শিক্ষার্থীদের সঞ্চয়। এক মাসের ব্যবধানে সঞ্চয় কমেছে প্রায় ৫০ কোটি টাকা। এ ছাড়াও গত চার মাসে সঞ্চয় কমেছে প্রায় ২৫০ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য মতে, চলতি বছরের অক্টোবর মাসে স্কুল শিক্ষার্থীদের আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৮৭ কোটি টাকা, যা গত সেপ্টেম্বরে ছিল ২ হাজার ১৩৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক মাসে আমানত কমেছে ৪৮ কোটি টাকা। এর আগের বছর ২০২৩ সালের মে শেষে আমানতের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ২২৮ কোটি টাকা। সে হিসেবে কমেছে প্রায় ১০১ কোটি টাকা। গত জুন মাসে ছিল ২ হাজার ৩২৫ কোটি টাকা। সে হিসেবে ৪ মাসে শিক্ষার্থীদের সঞ্চয় কমেছে ২৩৮ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের জুলাইয়ে শিক্ষার্থীদের ব্যাংক আমানতের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ২০০ কোটি টাকা, যা আগস্টে কমে দাঁড়ায় ২ হাজার ১৭২ কোটি, সেপ্টেম্বরে ২ হাজার ১৩৫ কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সাধারণত যেকোনো শ্রেণির হিসাবে আমানত অল্প হলেও বাড়ে। কারণ কেউ যদি নতুন করে টাকা জমা নাও দেয় তবুও আগের জমাকৃত আমানতের সুদ যোগ হয়ে মোট অঙ্ক বৃদ্ধি পায়। আর যদি গ্রাহকরা তার মুনাফার টাকা উত্তোলন করে ফেলে তাহলে হিসাব অপরিবর্তিত থাকে। তা ছাড়া নতুন বাড়তে থাকা হিসাবের আমানত যোগ হয়। আমানত কমে যাওয়ার অর্থ হলো নতুন করে যেসব হিসাব খোলা হয়েছে কিংবা আগের হিসাবে যে পরিমাণ টাকা জমা হয়েছে তার চেয়ে বেশি অঙ্কের টাকা উত্তোলন হয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ আর্থিক চাপের কারণে শিক্ষার্থীরাও তাদের সঞ্চয় ভেঙে ফেলছেন।
তথ্য বলছে, গত অক্টোবর মাসে ব্যাংকে শিক্ষার্থীদের হিসাব সংখ্যা ছিল ৪৩ লাখ ৬৪ হাজার ২৫৯টি। তার আগের মাস সেপ্টেম্বর এ ধরনের হিসাবের সংখ্যা ছিল ৪৩ লাখ ৫ হাজার ৬০টি। সে হিসেবে এক মাসে হিসাব সংখ্যা বেড়েছে ৫৯ হাজার ১৯৯টি। এর মধ্যে সর্বশেষ ছেলেদের হিসাব সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২২ লাখ ৩৮ হাজার ১৩২টি আর মেয়েদের হিসাব সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২১ লাখ ২৬ হাজার ১২৭টি। অক্টোবরে ছেলে ও মেয়ে উভয়রই হিসাব সংখ্যা বেড়েছে।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, সাধারণত বছরের শুরুতে কিংবা শেষের দিকে অনেকের টাকা উত্তোলনের চাপ থাকে। অনেকে নভেম্বর-ডিসেম্বর সময়ে বিভিন্ন পর্যটন এলাকায় বেড়াতে যান। আবার অনেকে তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বকেয়া পরিশোধ করতে গিয়ে আমানত ভাঙেন। কিন্তু বছরের পুরো সময়জুড়ে শিক্ষার্থীদের আমানত কমে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে নিয়মিত খরচ মেটাতে হিমশিম অবস্থার মধ্যেই আমানত উত্তোলন করতে হচ্ছে। সামগ্রিক পরিস্থিতি ও ঊর্ধ্ব মূল্যস্ফীতি এমনটাই ইঙ্গিত করছে।
শিক্ষার্থীদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তির আওতায় আনা ও তাদের আর্থিক ব্যবস্থাপনার বিষয়ে শিক্ষিত করে তোলার উদ্যোগের অংশ হিসেবে ২০১০ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্কুল ব্যাংকিং কার্যক্রম চালু করে। এই কার্যক্রমের লক্ষ্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে টাকা জমানোর অভ্যাস তৈরি করা এবং আর্থিক ব্যবস্থাপনায় তাদের আরও উপযোগী করে তোলা। এ পর্যন্ত ৫৯টি ব্যাংক স্কুল ব্যাংকিং কার্যক্রম চালু করেছে। ১১ থেকে ১৭ বছর বয়সি শিক্ষার্থীরা এ ধরনের অ্যাকাউন্ট খুলতে পারে। এই অ্যাকাউন্টগুলোর সঙ্গে বেশ কিছু সুবিধা পাওয়া যায়। যেমনÑ সব ধরনের ফিস ও চার্জের ক্ষেত্রে রেয়াত পাওয়া, বিনামূল্যে ইন্টারনেট ব্যাংকিং সুবিধা পাওয়া, ন্যূনতম স্থিতির বাধ্যবাধকতার ক্ষেত্রে ছাড় ও স্বল্প খরচে ডেবিট কার্ড পাওয়ার সুযোগ। মাত্র ১০০ টাকা আমানত রেখেই এ ধরনের অ্যাকাউন্ট খোলা যায়।
২০১০ সালে স্কুল ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরু হলেও শিক্ষার্থীরা টাকা জমা রাখার সুযোগ পায় ২০১১ সাল থেকে। প্রথম বছরে ২৯ হাজার ৮০টি স্কুল ব্যাংকিং হিসাব খোলা হয়। এর পরের বছর ২০১২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত স্কুল ব্যাংকিংয়ের আওতায় ব্যাংকগুলোতে ১ লাখ ৩২ হাজার ৫৩৭টি হিসাব খোলা হয়। এর ধারাবাহিকতা বজায় ছিল প্রতি বছরই। তবে করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে শিক্ষার্থীদের ব্যাংক হিসাব ও আমানতের পরিমাণ কিছুটা কমে আসছে। এরপর থেকেই স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের সঞ্চয়ে উদ্বুদ্ধ করতে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো আকর্ষণীয় মুনাফার নানা স্কিম চালু করে।