আরমান হেকিম
প্রকাশ : ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৯:৪৪ এএম
আপডেট : ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৯:৫৮ এএম
ছবি : সংগৃহীত
রাজধানীর ফুলবাড়িয়ার সরকারি কর্মচারী হাসপাতাল ৫০০ শয্যায় উন্নীতকরণ প্রকল্পে শুরু থেকেই ছিল নানা ত্রুটি ও অব্যবস্থাপনা। ভুল নকশা, প্রকল্পের কাজ চলার সময় তা পাল্টানোর চেষ্টা, নানা অপ্রয়োজনীয় কাজ যুক্ত করা এবং বাস্তবায়নে ধীরগতির খেসারত হিসেবে এ প্রকল্পটিতে তাই প্রয়োজন পড়ছে অতিরিক্ত ৮৭ কোটি টাকা। পাশাপাশি অভিযোগ উঠেছে প্রকল্পের কাজে দুর্নীতি, পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ পাইয়ে দেওয়া এবং টেন্ডার প্রক্রিয়ায় অনিয়মের। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যথাযথ পরিকল্পনা ও জবাবদিহিতার অভাবে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
সম্প্রতি প্রকল্পটির দ্বিতীয় সংশোধিত প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়। কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সদ্য সাবেক) সোলেমান খানের সভাপতিত্বে এই প্রস্তাবনার ওপর মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভাও হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব মামুন-আল-রশীদ বলেন, ‘দায়িত্বহীনতা ও জবাবদিহিতা না থাকার খেসারত দিতে হচ্ছে এই প্রকল্পে। ঠিকমতো সম্ভাব্যতা সমীক্ষা না করেই সম্ভবত প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়। এ কারণে বাস্তবায়ন পর্যায়ে গিয়ে ধাপে ধাপে মনে হয়েছে নকশাটা বদলানো দরকার। কিংবা এখনও এটা করলে ভালো হয়, ওখানে ওটা করা দরকার। শুরুতেই কেন এসব চিন্তা করা হয়নি, সেটিই বড় প্রশ্ন। পরিকল্পনা কমিশনের উচিত ছিল, কঠোরভাবে প্রকল্পটি পর্যালোচনা করা। এক্ষেত্রে মূলত দায়ী হবে যারা প্রকল্প তৈরির সময় যুক্ত ছিলেন। তাদের খুঁজে বের করে জবাবদিহির আওতায় আনতে পারলে একই ঘটনা বারবার ঘটত না।’
২০২৫ সাল পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব
উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পটির মূল ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩৭৯ কোটি ৯৬ লাখ ৫১ হাজার টাকা। ২০১৯ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের জুনের মধ্যে দুই বছরে বাস্তবায়ন মেয়াদ ধরা ছিল। প্রকল্পটি ২০১৯ সালের ১২ মার্চ অনুমোদন দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। এরপর এটির ব্যয় বাড়ানো না হলেও মেয়াদ ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়। এবার সময় আরও বাড়িয়ে ২০২৫ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়নের জন্য দ্বিতীয় সংশোধন প্রস্তাব করা হয়েছে পরিকল্পনা কমিশনে।
ডিপিপি বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ‘প্রকল্পটি অনুমোদনের পর বাস্তবায়নের মাঝপথেই হাসপাতালটিকে আধুনিক হাসপাতাল হিসেবে গড়ে তোলার জন্য নকশায় কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। সে অনুযায়ী পরে ব্যয় বাড়িয়ে করা হয় ৪২৮ কোটি ৫৬ লাখ ৬০ হাজার টাকা। এ ছাড়া মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৪ সালের জুনে বাস্তবায়নের জন্য তৎকালীন পরিকল্পনামন্ত্রী ২০২২ সালের ১২ অক্টোবর প্রকল্পটির প্রথম সংশোধন অনুমোদন করেন। কিন্তু এতেও শেষ হয়নি এর বাস্তবায়ন কাজ। বর্তমানে প্রকল্পে কয়েকটি নতুন অঙ্গের সংযোজন করে ও প্রায় ৩৮ কোটি টাকা ব্যয় বাড়িয়ে ৪৬৬ কোটি ৫২ লাখ ৯০ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। অর্থাৎ নকশার এসব ভুলের কারণে ও তা শোধরাতে বর্তমানে প্রয়োজন পড়ছে অতিরিক্ত ৮৭ কোটি টাকার।
এ প্রসঙ্গে ভৌত অবকাঠামো বিভাগের প্রধান (অতিরিক্ত সচিব) কবির আহামদ বলেন, ‘সরকারি কর্মচারীদের স্বাস্থ্যসেবাকে আধুনিক ও উন্নত করতে চায় সরকার। এজন্য এটির পরিসর বাড়াতে বিদ্যমান চারতলাবিশিষ্ট সরকারি কর্মচারী হাসপাতাল ভবনটি ১৬ তলা পর্যন্ত ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণে প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়। প্রকল্পের কাজে কিছুটা গলদ রয়েছে। মাঝপথে এসে প্রকল্পের নকশায় পরিবর্তন আনা হয়। প্রকল্পটির মেয়াদ ও ব্যয় আবারও বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
যেসব কারণে দ্বিতীয় সংশোধন প্রস্তাব
প্রকল্পটির অগ্রগতি সম্পর্কে গত ৫ নভেম্বর পিইসি সভায় প্রকল্প পরিচালক মো. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, বর্তমানে প্রকল্পটির আর্থিক অগ্রগতি ২৬৫ কোটি টাকা বা ৫৬ দশমিক ৮০ শতাংশ। এ ছাড়া বাস্তব অগ্রগতি ঘটেছে ৮৫ শতাংশ। এর পর তিনি প্রকল্পটির দ্বিতীয় সংশোধন প্রস্তাবের কারণ তুলে ধরতে গিয়ে বলেন, হাসপাতালে রোগীদের সেবা নির্বিঘ্ন করার জন্য অষ্টম পিএসসি (প্রকল্প স্টিয়ারিং কমিটি) সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৮০০ কেজির দুটি নতুন লিফট সংযোজন এবং সংশ্লিষ্ট সিভিল কাজের জন্য পরিকল্পনা কমিশন থেকে আগেই অনুমোদন নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পের মূল অনুমোদিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে (ডিপিপি) অনাবাসিক ভবন নির্মাণ কোডটির পরিবর্তে ভুলে আবাসিক ভবন কোড লেখা হয়েছিল। প্রস্তাবিত ডিপিপিতে ভুলটি সংশোধন করে অনাবাসিক করা হয়েছে। অনুমোদিত নকশা অনুযায়ী হাসপাতাল ভবনের দক্ষিণ-পূর্বদিকের খালি অংশের লিফট লবির জন্য প্রতিটি ফ্লোরে এরিয়া বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া সংশোধিত নকশায় পোর্চ ও পোর্চের ওপর ক্যান্টিন নির্মাণের সংস্থান থাকায় ফ্লোর এরিয়া বেড়েছে।
তিনি বলেন, হাসপাতালের অত্যাধুনিক মেডিকেল যন্ত্রপাতিগুলোর প্রতিটির জন্য বিশেষ ব্যবস্থায় বৈদ্যুতিক সংযোগ প্রয়োজন। যন্ত্রপাতিগুলোর উপযোগী ক্যামেরা সিস্টেম, সাউন্ড সিস্টেম, এয়ার কন্ডিশনিং ব্যবস্থা ইত্যাদি কাজগুলো শেষ করার জন্য অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজন। পিএসসি সভার সিদ্ধান্তে প্রতিটি ফ্লোরে ফলস সিলিং স্থাপন এবং কেবিনে মার্বেল স্থাপন, অগ্নিনির্বাপণের পানির জন্য বৃষ্টির পানি সংরক্ষণে জলাধারের ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি এবং সিভিল অবকাঠামোর নকশা পরিবর্তন করায় ব্যয় বেড়েছে। তা ছাড়া হাসপাতালটিতে আধুনিক সেবা দেওয়ার জন্য মেডিকেল ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম, মডিউলার কিচেন, অন্যান্য মেডিকেল যন্ত্রপাতি স্থাপন, জেব্রা ব্লাইন্ড, পোর্চ ও সংশ্লিষ্ট আইটেম, এয়ার হ্যান্ডলিং ইউনিট, স্টিল স্টেয়ারকেস, ভিআরএফ, চিলার, মেকানিক্যাল ভেন্টিলেশন কাজের অবশিষ্ট ও অতিরিক্ত কাজ, মেডিকেল যন্ত্রপাতিগুলোর জন্য বিশেষ বৈদ্যুতিক কাজ এবং ৮০০ কেজির দুটি লিফট সংযোজন করা হয়েছে। এসব কারণে প্রকল্পটির দ্বিতীয় সংশোধন প্রস্তাব করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, হাসপাতালটিতে ৭০ শতাংশ সরকারি চাকরিজীবী এবং ৩০ শতাংশ সাধারণ মানুষের সেবার জন্য ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ দিতে ছলচাতুরী
সরকারি কর্মচারী হাসপাতাল উন্নীতকরণ প্রকল্পে ভারী মেডিকেল যন্ত্রপাতি কেনার জন্য বিভিন্ন প্যাকেজে দরপত্র আহ্বান করা হলেও সেখানেও ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।
প্রকল্পের এসকেএইচইউপি জিডি-১০ প্যাকেজে এমআরআই, সিটিস্ক্যান, এক্স-রে এবং আলট্রাসাউন্ডসহ গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রপাতি কেনার জন্য ৪০ কোটি ৬১ লাখ টাকার প্রাক্কলিত বাজেট ধরা হয়। দরপত্রে উন্নত প্রযুক্তি ও উচ্চ গুণগত মানের যন্ত্রপাতির শর্ত ছিল। কিন্তু প্রকল্প পরিচালক ও ঠিকাদারদের যোগসাজশে শর্তগুলো ঠিকমতো অনুসরণ করা হয়নি এবং অযোগ্য প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেওয়া হয়।
পরবর্তী সময়ে এই প্রকল্পের এসকেএইচইউপি জিডি-১১, ১২, ১৩, ১৪ ও ১৫ নম্বর প্যাকেজের দরপত্র আহ্বান করা হয়। এর মধ্যে ১৪ ও ১৫ নম্বর প্যাকেজে সর্বোচ্চ দরদাতা প্রতিষ্ঠান মেডিকিট করপোরেশনকে নিয়ম লঙ্ঘন করে কাজ দেওয়া হয়। অন্যদিকে, ১১, ১২ ও ১৩ নম্বর প্যাকেজে উন্নত মানের যন্ত্রপাতি সরবরাহের শর্ত থাকলেও পিপিআর (সরকারি ক্রয়বিধি) অনুযায়ী দরপত্রে অংশ নিতে সরবরাহকারীদের অন্তত ৭০ ভাগ কাজের অভিজ্ঞতা থাকা বাধ্যতামূলক ছিল।
১১ নম্বর প্যাকেজে ৪৮ কোটি ৪৭ লাখ টাকার কাজের জন্য ন্যূনতম ৩৩ কোটি টাকার একক চুক্তি বাস্তবায়নের অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়। প্রকল্প পরিচালকের পছন্দের ঠিকাদারের এই অভিজ্ঞতা না থাকায় তারা অংশ নিতে পারেননি। কিন্তু অভিজ্ঞ সরবরাহকারীরা যোগ্যতা অনুযায়ী দরপত্র জমা দিলেও প্রকল্প পরিচালক তাদের দরপত্র বাতিল করে পুনরায় দরপত্র আহ্বান করেন। পরবর্তী আহ্বানে শর্ত শিথিল করে একই কাজের জন্য দুটি চুক্তিতে ২০ কোটি টাকার অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়, যা পছন্দের ঠিকাদারের পক্ষে সুবিধাজনক হয়।
এ ছাড়াও এসকেএইচইউপি জিডি-১৪ (সিএসএসডি) এবং জিডি-১৫ (ফার্নিচার) প্যাকেজের কাজেও অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে নিয়ম মেনে সর্বনিম্ন দরদাতাকে কাজ না দিয়ে প্রকল্প পরিচালকের পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ পাইয়ে দেওয়া হয়েছে।
এসব অনিয়মের কারণে প্রকল্পের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এতে রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় ঘটেছে এবং টেন্ডার প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতাও হুমকির মুখে পড়েছে।
অনিয়মের বিষয়ে উপদেষ্টা ও সচিবকে চিঠি
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মেডিকেল যন্ত্রপাতি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল বিজনেস অ্যাসোসিয়েশন (বিএমবিএ) গত ১২ নভেম্বর জনপ্রশাসন উপদেষ্টা ও সচিবকে একটি লিখিত অভিযোগ দেয়। এই সংগঠনের আহ্বায়ক ইমাম আজম তালুকদার অভিযোগে উল্লেখ করেন, সরকারি কর্মচারী হাসপাতাল প্রকল্পে টেন্ডার প্রক্রিয়ায় স্বেচ্ছাচারিতা ও অনিয়ম হয়েছে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বিভিন্ন প্রকল্পের মতো এই প্রকল্পেও দুর্নীতি ও অনিয়মের ছাপ সুস্পষ্ট।
অভিযোগ করা হয়, বিশেষ করে হাইটেক মেডিকেল যন্ত্রপাতি কেনার ক্ষেত্রে একাধিক স্তরে নিয়ম লঙ্ঘন ও অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। প্রকল্প পরিচালক মো. সিদ্দিকুর রহমান উদ্দেশ্যমূলকভাবে দরপত্রে এমন শর্ত আরোপ করেছেন, যাতে তার পছন্দের ঠিকাদাররা সুবিধা পায়। বিশেষ করে এসকেএইচইউপি জিডি-১১, ১২ ও ১৩ নম্বর প্যাকেজের দরপত্রে শর্তগুলো এমনভাবে তৈরি করা হয় যে, যোগ্য প্রতিষ্ঠানগুলো অংশ নিতে পারেনি। শর্তের এই ফাঁদ পেতে নিম্নমানের যন্ত্রপাতি উচ্চমূল্যে সরবরাহের সুপারিশ করা হয়েছে।
অভিযোগে আরও বলা হয়, এই অনিয়মের কারণে ব্যবসায়ীদের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ ও ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। তারা সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন যে, রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষা, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং সরকারের ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ন রাখতে এসব প্যাকেজের দরপত্র বাতিল করে পুনরায় সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ টেন্ডার আহ্বান করা হোক।