অর্থনীতির শ্বেতপত্র
আরমান হেকিম
প্রকাশ : ৩০ নভেম্বর ২০২৪ ২২:২৪ পিএম
আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১৫ বছরে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতেই এক লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে। যা দিয়ে তিন-চারটি পদ্মা সেতু করা যেত। অর্থনীতির শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদনে এ তথ্য ওঠে এসেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
রবিবার (১ ডিসেম্বর) শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে এ প্রতিবেদক হস্তান্তর করবেন। আগামী সোমবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ের এনইসি সম্মেলন কক্ষে সংবাদ সম্মেলন করে প্রতিবেদনের বিস্তারিত তুলে ধরবেন কমিটির প্রধান ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। এছাড়া প্রতিবেদনটি ওয়েবসাইটেও আপলোড করা হবে। ইংরেজি ভাষায় লেখা এ প্রতিবেদনের নাম দেওয়া হয়েছে ‘হোয়াইট পেপার অন দ্য স্টেট অব ইকোনমি’। পরবর্তীতে এটি বাংলা অনুবাদ করা হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
প্রতিবেদনে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের লুটপাটের ফিরিস্তির পাশাপাশি অর্থ পাচারের তথ্য উঠে এসেছে। এ ছাড়া ব্যক্তি স্বার্থে কর অব্যাহতি, মূল্যস্ফীতি ও জিডিপির প্রবৃদ্ধিতে সরকারি পরিসংখ্যানের বিকৃতি এবং সরকারের ঋণের চিত্র তুলে ধরা হবে শ্বেতপত্রে। একই সঙ্গে মেগা প্রকল্প, ব্যবসার পরিবেশ, দারিদ্র্য ও সমতা, পুঁজিবাজার, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারী ও জলবায়ু ইস্যুসহ ৪০০ পৃষ্টার ২২টি অধ্যায় রয়েছে।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অর্থনীতির ক্ষত ও পরিস্থিতি পরিমাপ করতে একটি কমিটি করে অন্তর্বর্তী সরকার। সরকারের সচিব, ব্যবসায়ী, নাগরিকসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান এবং সংগঠনের সঙ্গে তিন মাস আলোচনা, পর্যালোচনা, তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও যাচাই-বাছাইয়ের পর এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রস্তুত করতে সক্ষম হয়েছে অর্থনীতির শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি।
এলওসি ঋণ ছিল দেশের স্বার্থবিরোধী
উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য নেওয়া ভারতের এলওসি ঋণ (লাইন অব ক্রেডিট) দেশের স্বার্থের পরিপন্থি বলে শ্বেতপত্র কমিটির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশ এলওসির আওতায় এখন পর্যন্ত ৭৩৬ কোটি ডলার ঋণ নিয়েছে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, প্রথম এলওসি হয় ২০১০ সালে। এতে ৮৬ কোটি ডলার ঋণ চুক্তি হয়। দ্বিতীয় এলওসি হয় ২০১৬ সালে এতে ঋণ চুক্তি হয় ২০০ কোটি ডলার। তৃতীয় এলওসি হয় ২০১৭ সালে এই এলওসিতে ঋণ চুক্তি হয় ৪৫০ কোটি ডলার। তিনটি এলওসিতে মোট ঋণ চুক্তি হয় ৭৩৬ কোটি ডলার। এর বাইরে ৫০ কোটি ডলারের সামরিক কেনাকাটার চুক্তিও হয় ভারতের সঙ্গে।
এলওসির ঋণের শর্ত হলো, প্রকল্পে কেনাকাটার ৭৫ শতাংশই ভারত থেকে কিনতে হবে। বিশেষ করে নির্মাণ প্রকল্পের ৬৫ শতাংশ কেনাকাটা ভারত থেকেই করতে হয়। এ ধরনের প্রকল্পের আরেকটি শর্ত হলো- কমপক্ষে ১০ শতাংশ কেনাকাটা করতে হবে বাংলাদেশের অভ্যন্তর থেকে। এছাড়া প্রতিটি ধাপে ভারতের এক্সিম ব্যাংকের অনুমোদন নিতে হয়। আর প্রকল্পের কাজ পাবেন শুধু ভারতীয় ঠিকাদারেরা। আবার প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত করা থেকে শুরু করে ঠিকাদার নিয়োগের প্রতিটি ধাপেই এক্সিম ব্যাংকের সম্মতি নিতে হয়।
ইআরডির কর্মকর্তারা জানান, এলওসি চুক্তি অনুযায়ী ভারতীয় ঋণের প্রকল্পে শুধুমাত্র ভারতের ঠিকাদাররাই অংশ নিতে পারে। যার ফলে অনেক নির্মাণ কাজের দরপত্রে ভারতীয় ঠিকাদাররা অনেক বেশি দর প্রস্তাব করে।
ছয়টি বিষয় অন্তর্ভুক্ত
সূত্র জানায়, দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে প্রকাশ হতে যাওয়া শ্বেতপত্রটিতে ছয়টি বিষয় অন্তর্ভুক্ত। সেগুলো হলো- সরকারি আর্থিক ব্যবস্থাপনা, মূল্যস্ফীতি ও খাদ্য ব্যবস্থাপনা, বাহ্যিক ভারসাম্য, জ্বালানি-বিদ্যুৎ, বেসরকারি বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান।
অর্থপাচরের বিষয়ে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরের শাসনামলে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ১৪ বিলিয়ন ডলার অর্থ পাচার হয়েছে। তবে সময় স্বল্পতার কারণে অর্থ পাচারের প্রকৃত পরিমাণ নির্ধারণ করা যায়নি বলে কমিটি সূত্রে জানা গেছে। সরকারি নথি ও বৈশ্বিক প্রতিবেদন ব্যবহার করে অর্থ পাচারের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
শ্বেতপত্র কমিটির একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, এস আলম গ্রুপের মতো প্রভাবশালী শিল্প প্রতিষ্ঠানের বড় অঙ্কের ঋণ খেলাপি হওয়া সত্ত্বেও খেলাপিদের শ্রেণীবদ্ধকরণ বা ক্লাসিফিকেশন করতে বাধা দিয়েছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার। এ ধরনের হস্তক্ষেপের কারণে এস আলম গ্রুপ ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলো সন্দেহজনক পরিস্থিতিতেও বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়ে গেছে।
কমিটির আরেক সদস্য নাম প্রকাশ না করে জানিয়েছেন, শ্বেতপত্র হিসাব অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জুন শেষে ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের পরিমাণ ছুঁতে পারে প্রায় ৮ লাখ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে ডিসট্রেসড অ্যাসেট বা ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৫ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা।
তবে শ্বেতপত্র কমিটির সদস্য ও বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেনের কাছে শ্বেতপত্রের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে তিনি বলেন, ‘এটি একটি টিমওয়ার্ক। কোনো একটি খাত ধরে কাজ করা হয়নি, বিষয়বস্তু ধরে ধরে প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। একেকজন একেক বিষয় নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করেছে। সেগুলো আবার তিন দফায় নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে যাচাই-বাছাই করে ফাইনাল ড্রাফট প্রস্তুত করা হয়েছে। শ্বেতপত্র তৈরিতে নিজেদের মধ্যে বৈঠক করা ছাড়াও অংশীজনের মতামত নেওয়া হয়েছে।’
চাঁদাবাজি, ঘুষে বিপুল অর্থ
শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি সূত্রে জানা গেছে, গত ১৫ বছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি)-সহ বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে বিনিয়োগ করা ৬.৬ লাখ কোটি ডলারের মধ্যে ১.৫৪ লাখ থেকে ২.৬৪ লাখ কোটি টাকা রাজনৈতিক চাঁদাবাজি, ঘুষ বাণিজ্যে হারিয়েছে।
শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির সদস্য এম আবু ইউসুফ বলেন, ‘অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা, কী কী সমস্য ছিল ইত্যাদি বিষয়ের বেঞ্চমার্ক শ্বেতপত্রে আলোচনা করা হয়েছে।’
ঠিক কী কী থাকছে শ্বেতপত্রে- এমন প্রশ্ন তিনি এড়িয়ে গেলেও শুরু থেকেই ধারণা দিয়েছেন কমিটি প্রধান ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। গত ২৯ আগস্ট কমিটির প্রথম বৈঠক শেষে তিনি জানান, কমিটি কোনো দুর্নীতি ধরবে না, দুর্নীতির মাত্রা মূল্যায়ন করবে।
উল্লেখ্য, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। তারপর সেই মাসের শেষ সপ্তাহে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থা তুলে ধরতে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে ১২ সদস্যের শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটিকে ৯০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়।
শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির বাকি ১১ সদস্য হলেন, বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন, বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান, সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান, ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এ কে এনামুল হক, বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্টের (বিল্ড) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফেরদৌস আরা বেগম, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) নির্বাহী পরিচালক ইমরান মতিন প্রমুখ।