বাণিজ্য সম্মেলন
প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ৩০ নভেম্বর ২০২৪ ২০:৩৭ পিএম
আপডেট : ৩০ নভেম্বর ২০২৪ ২০:৩৭ পিএম
রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে শনিবার ডিসিসিআই আয়োজিত বাণিজ্য সম্মেলনে বক্তব্য দেন সংগঠনের সভাপতি আশরাফ আহমেদ। প্রবা ফটো
ব্যবসা পরিচালন ব্যয় হ্রাস, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন, জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, শিল্প-কারখানায় নিরবচ্ছিন্ন উৎপাদন অব্যাহত রাখা, সুশাসন, রাজস্ব ব্যবস্থাপনার অটোমেশন ও সংস্কার এবং সহায়ক বাণিজ্যনীতি সহায়তার জন্য সরকারকে আরও উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত ‘প্রাইভেট সেক্টর আউটলুক; প্রত্যাশা ও অগ্রাধিকার’ শীর্ষক বাণিজ্য সম্মেলনে তারা এ আহ্বান জানান।
শনিবার (৩০ নভেম্বর) রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে অনুষ্ঠিত এ সম্মেলনে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ এবং বাণিজ্য উপদেষ্টা সেখ বশির উদ্দিন যথাক্রমে প্রধান অতিথি ও বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
বাণিজ্য সম্মেলনের স্বাগত বক্তব্যে ঢাকা চেম্বারের সভাপতি আশরাফ আহমেদ বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আগামী বছরের শুরুতেই নীতি সুদহার এবং সুদহার ক্রমান্বয়ে হ্রাসকরণের পাশাপশি সরকারি ব্যয় হ্রাস, বাজার ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন, পণ্য ব্যবস্থাপনায় চাঁদাবাজি রোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।’
মুদ্রাবাজারে স্থিতিশীলতা আনতে ডলারের বিনিময় হারকে বাজারে বিদ্যমান হারের কাছাকাছি রাখার ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, ব্যাংকঋণ প্রাপ্তির প্রক্রিয়া সহজীকরণের মাধ্যমে বিশেষ করে এসএমইদের ঋণ প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। ব্যবসা প্রক্রিয়া সহজতরের লক্ষ্যে সামগ্রিক শুল্ক ব্যবস্থা সংস্কারের পাশাপাশি ব্যবসা নিবন্ধন ও নবায়ন প্রক্রিয়ায় অটোমেশনের দাবি জানান ঢাকা চেম্বার সভাপতি।
পণ্য উৎপাদান অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে শিল্পকারখানায় নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহের ওপর জোরারোপ করেন আশরাফ আহমেদ। তিনি বলেন, ‘বৈশ্বিক বাণিজ্যের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্তকরণের জন্য এখনও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন না হলে আমাদের পক্ষে ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।’
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘গত ১৫ বছরে বিশেষ করে অর্থনৈতিক খাতে যে ধরনের দুর্নীতি হয়েছে, তা অকল্পনীয় এবং সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়েছে।’
তিনি বলেন, ‘ব্যাংক থেকে ডিপোজিট নিয়ে চলে গেছে, যার দৃষ্টান্ত বাংলাদেশে বিরল, তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সেটার উত্তরণের প্রচষ্টা অব্যাহত রেখেছে, তবে এক্ষেত্রে কিছুট সময় লাগতে পারে।’
তিনি উল্লেখ করেন, ‘মূল্যস্ফীতি একটা বড় চ্যালেঞ্জ, তবে রিজার্ভ স্থিতিশীলতা ও সুদের হার সন্তোষজনক পর্যায়ের মাধ্যমে এ অবস্থার উত্তরণ হবে।’
তিনি জানান, এনবিআর নিয়ে বেসরকারি খাতের অভিয়োগ রয়েছে, তবে সকল আইনই ব্যবসা সহায়ক হওয়া প্রয়োজন বলে তিনি মত প্রকাশ করেন। উপদেষ্টা জানান, এনবিআরের কার্যক্রমে অটোমেশন করার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে ট্যাক্স পলিসি ও ট্যাক্স অ্যাডমিনিস্ট্রেশনকে আলাদা করার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। তবে বেসরকারি খাতে বিশেষ করে এসএমই খাতে ঋণসহায়তা যেন কোনোভাবেই হ্রাস না পায় সেটার প্রতি লক্ষ রাখতে হবে বলে মত দেন তিনি।
বাণিজ্য উপদেষ্টা সেখ বশির উদ্দিন বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়নে সরকারের সঙ্গে বেসরকারি খাতের সমন্বয় আবশ্যক এবং বিদ্যমান অবস্থার দ্রুত উন্নতি হবে বলে আশা প্রকাশ করেন। একই পণ্যের একাধিক বাণিজ্য সংগঠন আছে বলে তিনি জানান।
এলডিসি উত্তরণপরবর্তী সময় ছাড়াও আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের বাণিজ্য সম্প্রসারণে নিজেদের সক্ষমতা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই বলে তিনি উল্লেখ করেন।
অনুষ্ঠানে ইনসেপটা ফার্মাসিউটিক্যালসের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল মোক্তাদির বলেন, ‘সম্প্রতি বাংলাদেশ কঠিন সময় পার করলেও কিছু ভালো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে, যার সুফল আসবে।’
তিনি বলেন, ‘শিল্পকারখানায় অস্থিরতা কোনোভাবেই কাম্য নয়, তাই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়ন সুনির্দিষ্ট সময়সীমাসহ রোডম্যাপ থাকতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিভিন্ন পণ্যের উচ্চ আমদানি শুল্ক হারের কারণে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি এবং ছোট ব্যবসায়ীরা কঠিন পরিস্থিতি পার করছে। আমাদের বেশ কয়েকটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে, তাই কয়লার মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদনে জোর দিলেই শিল্প খাতে আরও বেশি হারে গ্যাস সরবরাহ সম্ভব হবে।’
প্রাণ আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান ও সিইও আহসান খান চৌধুরী বলেন, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন হলে ব্যবসার উন্নয়ন আসবে। ব্যবসায়ীদের প্রয়োজনের নিরিখে এলসি খুলতে না পারলে উৎপাদন ও কর্মসংস্থান দুটোই ব্যাহত হবে। নতুন প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষি খাতের উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি তিনি পার্শিয়াল বন্ড ইস্যুর প্রস্তাব করেন। এ ছাড়া তিনি বিদ্যমান পরিস্থিতি বিবেচনায় ঋণের সুদের হার হ্রাস করা প্রয়োজন বলে মত দেন।
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ লিমিটেডের (এবিবি) চেয়ারম্যান সেলিম আর এফ হোসেন বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়ন সরকারের পক্ষ হতে এখনও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের বিষয়টি পরিলক্ষিত হয়নি, তবে দ্রুতই এটি নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। তবে অর্থনৈতিক খাতে সরকার বেশ ভালো করেছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে শুধু সংকোচনমূলক মুদ্রানীতিই যথেষ্ট নয়, বরং পণ্যের সাপ্লাই চেইনে চাঁদাবাজি বন্ধসহ বাজার ব্যবস্থাপনায় কঠোর নজরদারি নিশ্চিত করতে হবে।’ আর্থিক খাতের মামলার জট নিরসনে তিনি আরও বেশি হারে আদালত ও বিচারপতি নিয়োগের আহ্বান জানান।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন বা বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘২০২৬ সালে আমাদের এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন স্থগিত করতে হবে, কারণ আমরা এখন বেঁচে থাকার প্রচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছি। তা ছাড়া এ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়েছিল বেশ কিছু ভুল তথ্যের ভিত্তিতে।’
তিনি উল্লেখ করেন, আমাদের আমদানি ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে, পাশাপাশি কমেছে উৎপাদিত পণ্যের মূল্যসংযোজন। গ্যাসের সংকটের অভাবে আমরা ফেব্রিক্স তৈরি করতে পারছি না, ফলে এ ধরনের পণ্য আমদানিতে অতিরিক্ত টাকা ব্যয় হচ্ছে। পাশপাশি তিনি বাণিজ্য সংগঠনগুলোকে রাজনীতির বাইরে রাখার আহ্বান জানান।
মুক্ত আলোচনায় ব্যাংক এশিয়ার চেয়ারম্যান রোমো রউফ চৌধুরী, ডিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি হোসেন খালেদ, রিজওয়ান রাহমান অংশগ্রহণ করেন। বক্তারা ব্যবসায়ীদের হয়রানি রোধ, ভোটের স্বার্থে পকেট অ্যাসোসিয়েশন তৈরি বন্ধ করা এবং হোল্ডিং ট্যাক্স না বাড়ানোর ওপর জোরারোপ করেন।