প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২৬ নভেম্বর ২০২৪ ২১:১৬ পিএম
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের কর্মকর্তাদের পদোন্নতিতে ভিন্ন নীতি অনুসরণের কারণে বঞ্চিত হচ্ছেন অনেক যোগ্য কর্মকর্তা। একই ব্যাচের কর্মকর্তা ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হয়ে যাচ্ছেন আবার যোগ্যতা থাকার পরও কেবল নীতিমালার কারণে জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) হতে পারছেন না অনেকে। আর এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকে পদায়নের নিয়মের কারণে সিনিয়র কর্মকর্তার বস হয়ে যাচ্ছেন অনেক জুনিয়র। এতে ব্যাংক খাতে ব্যাপক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি বিরাজ করছে। বিগত সরকারের আমলে করা এসব বৈষম্যমূলক নীতিমালা পরিবর্তনের দাবি জানিয়েছেন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের কর্মকর্তারা। তবে এটি সমাধান না করেই পদোন্নতি প্রক্রিয়া শুরু হওয়ায় গভীর উদ্বিগ্ন বহু দক্ষ কর্মকর্তা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকারি ব্যাংকগুলোর পদোন্নতি বৈষম্য বেশ দীর্ঘদিনের। বিশেষ করে যেসব ব্যাংকে দ্রুত পদোন্নতি হয় এবং বিলম্বে পদোন্নতি হয় সেইসব ব্যাংকের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করছে। এমন পরিস্থিতিতি সেই বঞ্চনার মাত্রায় কাটা ঘায়ে নূনের ছিটার মত কাজ করে যখন জিএম থেকে তদোর্ধ পদগুলো ভিন্ন ব্যাংক থেকে পূরণ করা হয়। এমন নীতিমালার পরিবর্তন করে বৈষম্য দূর করতে দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছিলেন বিলম্বে পদোন্নতি হয় এমন ব্যাংকের কর্মকর্তারা। কিন্তু কর্তৃপক্ষ তাদের দাবির বিষয়ে বরাবরের মত উদাসীনতা দেখিয়ে আসছে। এমন পরিস্থিতি বৈষম্য রোধে আগের নীতিমালা বাতিল করে পদোন্নতি প্রক্রিয়া শুরু করার দাবি জানান ব্যাংকাররা। আর যদি পদোন্নতি দেওয়াও হয় তাহলে পদোন্নতিপ্রাপ্তদের স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানে পদায়নের দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, ব্যাংকিং খাতে বৈষম্য সৃষ্টিকারী প্রজ্ঞাপন বাতিলের জন্য সোনালী, জনতা ও অগ্রণী ব্যাংকের করা আবেদন অগ্রাহ্য করে গত ৪ নভেম্বর থেকে জিএম পদে পুনঃ সাক্ষাৎকার গ্রহণের জন্য পত্র জারী করে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। এর ভাইভা ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। এতে পদোন্নতি বঞ্চিত হতে যাচ্ছেন অনেক যোগ্য নির্বাহী কর্মকর্তাগণ। পূর্ববর্তী সরকারের আমলে উদ্দেশ্যমূলকভাবে করা প্রজ্ঞাপনটি এখনো বহাল আছে।
ব্যাংকাররা বলছেন, এত আন্দোলন এত রক্তপাতের পরও আওয়ামী সরকারের করা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে যা জুলাই আন্দোলনের মূল উদ্দ্যেশের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। তারা মনে করেন, প্রজ্ঞাপনটিতে প্রচুর সীমাবদ্ধতা থাকায় তা বাস্তবায়িত হলে ব্যাংকিং খাতে অনেক অব্যবস্থাপনা দেখা দিবে, ব্যাংকি খাতে গভীর অসন্তোষ সৃষ্টি হবে এবং জাতীয় অর্থনীতির উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। পাশাপাশি বর্তমান সরকারের অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রচেষ্টাকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করবে।
রাষ্ট্র মালিকানাধীন সোনালী, জনতা ও অগ্রণী ব্যাংক পিএলসির মহাব্যবস্থাপক পদে পদোন্নতি পূর্বের ন্যায় স্ব স্ব ব্যাংকের মাধ্যমে দেওয়ার জন্য এবং অর্থমন্ত্রণালয়ের (আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ) জারীকৃত বৈষম্যমূলক নীতিমালা বাতিলের জন্য ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তরা অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান গভর্নরের কাছে আবেদন করেন। এতে ব্যাংকগুলোর এমডিরাও স্বাক্ষর করেছেন।
জানা গেছে, ১৯৯৮ সালে বিআরসির (ব্যাংকার্স রিক্রুটমেন্ট কমিটি, বাংলাদেশ ব্যাংক) মাধ্যমে সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী ব্যাংকসহ বিভিন্ন সরকারী ব্যাংকে একটি বৃহৎ ব্যাচকে নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু একই সঙ্গে নিয়োগ পাওয়া রূপালী ব্যাংকের কর্মকর্তারা বর্তমানে বিভিন্ন ব্যাংকে এমডি, ডিএমডি ও জিএম পদে নিয়োজিত আছেন অথচ সোনালী, জনতা ও অগ্রণী ব্যাংকের বেশীর ভাগ কর্মকর্তাই এখনও পর্যন্ত জিএম পদে পদোন্নতি পাওয়ার যোগ্য হননি। এতে চরম বৈষম্যের সৃষ্টি হওয়ায় সোনালী, জনতা ও অগ্রণী ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মধ্যে হতাশার সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে স্বাভাবিক ব্যাংকিং কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।
ইতোমধ্যে জনতা, অগ্রণী ও কৃষি ব্যাংকে বেশ কিছু জিএম পদ শূন্য থাকায় এই পদগুলো রূপালী ব্যাংকের কর্মকর্তাদের দ্বারা পূরণ করার জন্য তৎকালীন ফ্যাসিবাদী সরকারের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সহায়তায় স্ব স্ব ব্যাংকের জিএম পদোন্নতি দেওয়ার ক্ষমতা বাতিল করে একটি সার্কুলার জারি করে। ব্যক্তিগত স্বার্থে এমন প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছিল বলে ব্যাংকাররা অভিযোগ করেছেন। প্রশ্নবিদ্ধ এ প্রজ্ঞাপন অনুসরন করে বর্তমানে জিএম পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে। তৎকালীন ফ্যাসিবাদী সরকারের দূর্নীতিবাজ সচিব (আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ) ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর অপসারিত হলেও তাঁদের কুচক্রী সহযোগিরা এটি বাস্তবায়ন করে ব্যাংক খাতে বৈষম্যের দেয়াল নির্মাণ করতে যাচ্ছে।
ব্যাংকারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ (এফআইডি) এবার সরকারি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় উপ-মহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) থেকে মহাব্যবস্থাপক (জিএম) পদে পদোন্নতির জন্য ২৫৮ জনের প্যানেল চূড়ান্ত করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। গত ৪ নভেম্বর থেকে পদোন্নতির জন্য সাক্ষাৎকার নেওয়া শুরু হয় এবং আজ বুধবার শেষ হতে যাচ্ছে। যদিও একই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নিয়োগ প্রাপ্ত ১৯৯৮, ২০০০ এবং ২০০৪ ব্যাচের কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎকারের জন্য ডাকা হয়েছে। সেখানে রূপালী ব্যাংকের সর্বাচ্চ ৭১ জন এবং জনতা ব্যাংকের মাত্র ৯ জনকে ভাইভার জন্য ডাকা হয়েছে। এটা স্পষ্ট বৈষম্য। এমন বৈষ্যমের কারণে ব্যাংকে রকর্মকতাদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। যদি এবারো রূপালী কিংবা সোনালী ব্যাংকের পদন্নোতিপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের জনতাসহ অন্যান্য ব্যাংকের জিএম পদ পুরণ করা হয়।
তবে যেসব ব্যাংকে নিচের দিকে বিলম্বে পদোন্নতি হয় সেসব ব্যাংকের কর্মকর্তাদের পদোন্নতিজনিত বৈষম্য আরও উস্কে যাবে। শুধু নীতিমালার ত্রুটির কারণে সমান যোগ্যতা সত্বেও এই ব্যচের কোন ব্যাংকের কর্মকর্তা জিএম, ডিএমড এবং এমডি হবেন। আর নিচের দিকে বিলম্বে পদোন্নতি পাওয়া কিছু ব্যাংকের কর্মকর্তারা কখনো জিএম হওয়ার সুযোগ পাবেন না। এমনকি নিচের দিকের পদোন্নতিও বাধাগ্রস্ত হবে। যা নিয়ে পদোন্নতি বঞ্চিত ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মধ্যে হতাশা বাড়বে এবং কাজের পরিবেশ বিঘ্নিত হওয়ার শঙ্কা দেখা যাবে।
জিএম পদে ভাইভা দেওয়া এক ডিজিএম নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, চলতি নভেম্বরে সাক্ষাৎকার শেষে জিএম পদে পদোন্নতিতে জারিকৃত বিদ্যমান নীতিমালা বাস্তবায়িত হলে অনেক যোগ্য, অভিজ্ঞ ও ত্যাগী কর্মকর্তা পদোন্নতি পাবেন না। আবার ব্যাংকভেদে অনেক সহকর্মী পদোন্নতি বঞ্চিত হবেন। ইতোমধ্যে ১৯৯৮ ব্যাচের কর্মকতাদের মধ্যে দ্রুত পদোন্নতি হওয়া একটি ব্যাংক থেকে ৪ জন এমডি এবং ৮ জন ডিএমডি হয়েছেন। তাদের অধীনে কাজ করতে হয়েছে। এবার তো জুনিয়রদের অধীনে কাজ করতে হবে। এজন্য দায়ী ব্যাংকের পদোন্নতি নীতিমালা, কোন যোগ্যতার ঘাটতি না।
অপর এক পদোন্নতি প্রত্যাশী ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন, শুধুমাত্র একটি বিশেষ গোষ্ঠিকে সুবিধা দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার এসব আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নেন। সেই সময় জারি করা নীতিমালার জন্য ব্যাংকের অনেক কর্মকর্তাদের মেধা, অভিজ্ঞতা ও জ্যেষ্ঠতার মূল্যায়ন লঙ্ঘিত হচ্ছে। যা সার্বিকভাবে ব্যাংকিং খাতে সংকট সৃষ্টি করবে। আবার অন্য ব্যাংক থেকে পদায়ন হওয়ায় সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের অভিজ্ঞতা না থাকায় কাজ যথাযথবাবে সম্পন্ন হতে সমস্যা হয়।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক হুসনে আরা শিখা গণমাধ্যমকে বলেন, ব্যাংকারদের পক্ষ থেকে নীতিমালাকে চাপানো আখ্যায়িত করে বাতিল চেয়ে গভর্নর বরাবর চিঠি দেওয়া হয়েছে। তাদের দাবি যাচাই-বাছাই এবং পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণে কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির সুপারিশ পেলে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।