প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২৬ নভেম্বর ২০২৪ ২০:৩৮ পিএম
দেশের আর্থিক সংকট, উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও চড়া সুদহারের অজুহাত দেখিয়ে খেলাপির বোঝা বাড়াচ্ছেন বড় ব্যবসায়ীরা। কিন্তু সংকটের মধ্যেও সময়মতো ঋণ ফেরত দিচ্ছেন গরিব কৃষকরা। ফলে বছরের ব্যবধানে ঋণ ফেরতের অঙ্ক উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। তবে ঋণ বিতরণে এখনও ভাটা চলছে। যদিও সাম্প্রতিককালের খরা কাটিয়ে কিছুটা ইতিবাচক হয়েছে কৃষিঋণ বিতরণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, সংকোচনমুখী মুদ্রানীতিসহ বিভিন্ন কারণে কমছিল কৃষিঋণ বিতরণ। অবশেষে তা বাড়তে শুরু করেছে। এক মাসের ব্যবধানে কৃষিঋণ বিতরণ বেড়েছে ৫০০ কোটি টাকার বেশি। আদায় বেড়েছে সাড়ে ৮০০ কোটিরও বেশি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ব্যাংকগুলো কৃষি খাতে ঋণ বিতরণ করেছে ২ হাজার ৫৮৭ কোটি টাকা। তার আগের মাস আগস্টে ব্যাংকগুলো বিতরণ করেছিল ২ হাজার ৮০ কোটি টাকা। সে হিসাবে এক মাসের ব্যবধানে কৃষিঋণ বিতরণ বেড়েছে ৫০৭ কোটি টাকা। তবে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় কৃষিঋণ বিতরণ ব্যাপক কমেছে। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে এই খাতে ঋণ বিতরণ ছিল ৩ হাজার ৫১৬ কোটি টাকা। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে ঋণ বিতরণ কমেছে ৯২৯ কোটি টাকা।
তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাস জুলাই, আগস্ট, সেপ্টেম্বরে ব্যাংকগুলো কৃষিঋণ বিতরণ করেছে ৬ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময় বিতরণ করা হয়েছিল ৮ হাজার ৮২৪ কোটি টাকা। সে হিসাবে বিতরণ কমেছে ২ হাজার ৩৬৬ কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কৃষিঋণে বিশেষ সুবিধা প্রত্যাহার করার কারণে বিতরণ কমছে। এত দিন সার্বিক খাতে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অনুসরণ করা হলেও কৃষি খাতের জন্য বিশেষ সুদহার নির্ধারণ করা হতো। তবে সবশেষ প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী সুদহার বাজারভিত্তিক করা হয়। এতে কৃষিঋণের জন্য কোনো আলাদা ছাড় ঘোষণা করা হয়নি। তাই বড় শিল্প গ্রুপের চেয়েও বেশি সুদ দিয়ে ঋণ নিতে হচ্ছে কৃষককে। তাই প্রয়োজনীয় ঋণ নিতে পারছেন না কৃষক। আবার উচ্চ সুদে ঋণ নিলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। চাহিদামতো দাম না পাওয়ায় লোকসান গুনতে হচ্ছে কৃষককে। ঋণ পরিশোধ করে পুঁজি হারাচ্ছেন অনেকে।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, এবার কৃষকদের জন্য আলাদা কোনো সুদহার নির্ধারণ করে দেয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক। তাই অন্য সাধারণ ঋণের মতোই সুদহার আরোপ করা হচ্ছে। ক্ষেত্রবিশেষে কৃষকদের বেশি সুদ দিতে হচ্ছে। কারণ বড় ব্যবসায়ীরা মোটা অঙ্কের ঋণ নেওয়ার কারণে ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে সুদ কিছুটা কম নির্ধারণ হয়। অপরদিকে কৃষকদের ছোট অঙ্কের ঋণ হওয়ায় এবং চাহিদামাফিক গ্যারান্টি না থাকায় অপেক্ষাকৃত বেশি সুদ আরোপ করা হয়।
কৃষিঋণ বিতরণের পাশাপাশি বেড়েছে আদায়ও
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ব্যাংকগুলো কৃষকদের কাছ থেকে বিতরণকৃত ঋণ আদায় করেছে ৩ হাজার ৭৬৪ কোটি টাকা। তার আগের মাসে আদায় ছিল ২ হাজার ৯১১ কোটি টাকা। সে হিসাবে আদায় বেড়েছে ৮৫৩ কোটি টাকা। তবে এক বছরের ব্যবধানে আদায় বেড়েছে ১ হাজার কোটি টাকা। গত বছরের সেপ্টেম্বরে কৃষকদের কাছ থেকে ব্যাংকগুলো বিতরণকৃত ঋণ আদায় করেছিল ২ হাজার ৭৬৩ কোটি টাকা। এ ছাড়া চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে ব্যাংকগুলোর আদায় ৯ হাজার ২০৯ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময় আদায় ছিল ৮ হাজার ১৪ কোটি টাকা। সে হিসাবে আদায় বেড়েছে ১ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা।
গত ৩০ আগস্ট কৃষিঋণের লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে কৃষি খাতে ৩৮ হাজার কোটি টাকা ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে যা প্রায় সাড়ে ৮ শতাংশ বেশি। গত অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৫ হাজার কোটি টাকা। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর জন্য ১২ হাজার ৬১৫ কোটি টাকা, বেসরকারি এবং বিদেশি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর জন্য ২৫ হাজার ৩৮৫ কোটি টাকা ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যাংকগুলো নিজস্ব নেটওয়ার্ক (শাখা, উপশাখা, এজেন্ট ব্যাংকিং, কন্ট্রাক্ট ফার্মিং, দলবদ্ধ ঋণ বিতরণ) এবং ব্যাংক-এমএফআই লিংকেজ ব্যবহার করতে পারবে। তবে নিজস্ব নেটওয়ার্কের মাধ্যমে অন্তত ৫০ শতাংশ বিতরণ করতে হবে। মোট লক্ষ্যমাত্রার ৬০ শতাংশ শস্য ও ফসল খাতে, ১৩ শতাংশ মৎস্য খাতে এবং ১৫ শতাংশ প্রাণিসম্পদ খাতে ঋণ বিতরণ করতে হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাস শেষে কৃষি খাতে মোট বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৫৪ হাজার ৯২৭ কোটি টাকা। গত আগস্ট মাসে স্থিতি ছিল ৫৫ হাজার ৮২২ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক মাসের ব্যবধানে এ খাতে বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি কমেছে ৮৯৫ কোটি টাকা। তবে এক বছরের ব্যবধানে বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি বেড়েছে ৭৬৩ কোটি টাকা। গত বছরের সেপ্টেম্বরে এ খাতে বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি ছিল ৫৪ হাজার ১১৬ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কৃষি নীতিমালা অনুযায়ী, ফসলের মৌসুমের ভিত্তিতে সারা বছর সমান হারে কৃষিঋণ দেওয়ার নির্দেশ রয়েছে। এরপরেও ঋণ বিতরণে পিছিয়ে রয়েছে ব্যাংকগুলো। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোকে মোট ঋণের মধ্যে ন্যূনতম ২ শতাংশ কৃষিঋণ বিতরণ করতে হয়। কোনো ব্যাংক লক্ষ্যপূরণে ব্যর্থ হলে ওই ব্যাংককে জরিমানা গুনতে হয়।
অপরদিকে কম সুদে কৃষকদের হাতে ঋণ পৌঁছাতে এবার ক্ষুদ্র ঋণদাতা সংস্থার (এমএফআই) ওপর বেসরকারি ব্যাংকের নির্ভরশীলতা আরও কমিয়ে আনা হচ্ছে। এজন্য ব্যাংকের নিজস্ব নেটওয়ার্কের মাধ্যমে অন্তত ৫০ শতাংশ কৃষিঋণ বিতরণ বাধ্যতামূলক করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক, যা এত দিন ছিল ৩০ শতাংশ। এ ছাড়া কৃষিঋণের কত অংশ কোন খাতে দিতে হবেÑ তা-ও নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে।
সবশেষ প্রণীত কৃষিঋণ নীতিমালায় বলা হয়, ভবনের ছাদে বিভিন্ন কৃষিকাজ করা একটি নতুন ধারণা। বর্তমানে শহরাঞ্চলে যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। মূলত বাড়ির ছাদে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে ফুল, ফল ও শাক-সবজির যে বাগান গড়ে তোলা হয়, তা ছাদবাগান হিসেবে পরিচিত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জনের জন্য যে হারে ঋণ বিতরণের কথা তা এবার হচ্ছে না। উচ্চসুদের কারণে এমন হচ্ছে বলে তাদের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে। তাই কৃষকের জন্য সুদহার কমানোর সুপারিশ করা হবে। শিগগিরই বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কাছে সুপারিশ পাঠাবে কৃষিঋণ বিভাগ।