প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১৯ নভেম্বর ২০২৪ ২২:০২ পিএম
ব্যাংক লুটেরা এস আলম গ্রুপের সহযোগী ৪৫৬ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে ইউনিয়ন ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক। এর মধ্যে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে এস আলমের নিয়োগ দেওয়া ইউনিয়ন ব্যাংকের ২৬২ কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। অন্যদিকে এস আলম গ্রুপকে নামে-বেনামে ঋণ দেওয়ার সঙ্গে যুক্ত ১৯৪ কর্মকর্তাকে কর্মস্থল থেকে প্রত্যাহার করেছে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক (এফএসআইবি)। শাস্তি পাওয়া কর্মকর্তাদের ২৪ জনই চট্টগ্রামের বিভিন্ন শাখার ব্যবস্থাপক (ম্যানেজার) ছিলেন। তাদের মধ্যে অন্যতম চট্টগ্রামের খুলশী শাখার ব্যবস্থাপক খুরশিদ আলম। তিনি এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলমের (এস আলম) ব্যক্তিগত সচিব আকিজ উদ্দিনের ভাই। ব্যাংক দুটি গত সোমবার এ সিদ্ধান্তের কথা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জানিয়ে দিয়েছে।
ইউনিয়ন ও এফএসআইবি দীর্ঘদিন এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে ছিল। গত আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী সরকার পতনের পর ব্যাংক দুটিকে এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তার আগেই ব্যাংক দুটির বেশিরভাগ অর্থ নামে-বেনামে সরিয়ে নিয়েছে গ্রুপটি। এর ফলে ব্যাংক দুটি এখন তারল্য সংকটে ভুগছে। ব্যাংক দুটির নথিপত্র ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য পাওয়া গেছে। তবে এসব বিষয়ে কেউ কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
জানা গেছে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ২৭ আগস্ট ইউনিয়ন ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেওয়া হয়। এরপর নতুন স্বতন্ত্র পর্ষদ দায়িত্ব নিলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরিদর্শন করে জানায়, ব্যাংকটির ঋণের ১৮ হাজার কোটি টাকা বা ৬৪ শতাংশই নিয়েছে এস আলম গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যখন এই পরিদর্শন করে, তখন ইউনিয়ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ছিলেন এবিএম মোকাম্মেল হক চৌধুরী। তিনি এস আলমের ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তাদের একজন, তার সময়ই ব্যাংকটি থেকে বিপুল অর্থ বের করে নেয় এস আলম গ্রুপ।
ব্যাংকের তারল্য পরিস্থিতি খারাপ হয়ে পড়লে সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে নিজের হিসাবে থাকা পুরো টাকা তুলে নেন এবিএম মোকাম্মেল হক চৌধুরীও। গত ৮ অক্টোবরের পর তিনি আর ব্যাংকে যাননি, পদত্যাগপত্রও জমা দেননি। কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকায় তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
এমন প্রেক্ষাপটে গত ১৭ নভেম্বর ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভায় খরচ কমাতে ২৬২ কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুতির সিদ্ধান্ত হয়। জানা যায়, চাকরিচ্যুত ব্যক্তিদের সবাই গত ফেব্রুয়ারিতে নিয়োগ পেয়েছেন। এই নিয়োগ দিতে ব্যাংকটি কারও কোনো পরীক্ষা নেয়নি। এস আলম গ্রুপের দেওয়া তালিকা থেকে এই নিয়োগ দেওয়া হয়। চাকরিচ্যুত ব্যক্তিদের সবাই ট্রেইনি অ্যাসিস্ট্যান্ট অফিসার ও ট্রেইনি অ্যাসিস্ট্যান্ট ক্যাশ অফিসার পদের কর্মকর্তা। তাদের অধিকাংশই চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলার।
এ বিষয়ে ব্যাংকটির মানবসম্পদ বিভাগ থেকে দেওয়া চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘ব্যাংক থেকে আপনার চাকরি সমাপ্ত হলেও কর্মকালে আপনার কর্মকাণ্ড, অবহেলা বা অন্য কোনো দোষের কারণে ভবিষ্যতে ব্যাংকের কোনো ক্ষতি হলে তার জন্য আপনি দায়ী থাকবেন।’
অপর দিকে এফএসআইবির চেয়ারম্যান ছিলেন বিতর্কিত ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম নিজেই। তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অতি ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী হিসেবে দেশে পরিচিত ছিলেন। আওয়ামী সরকারের পতনের পর ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদকে এস আলম গ্রুপের হাত থেকে মুক্ত করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানানো হয়, ব্যাংকটি থেকে নামে-বেনামে ৩৫ হাজার কোটি টাকা নিয়ে গেছেন এস আলম। ব্যাংকটির আমানত ৪৫ হাজার কোটি টাকা হলেও ঋণ ৬০ হাজার কোটি টাকা। অন্য ব্যাংক ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ধার নিয়ে সেই টাকাও লুট করেছে এস আলম গ্রুপ।
এমতাবস্থায় নানা অনিয়মের সঙ্গে জড়িত থাকায় ব্যাংকটি এস আলমের ঘনিষ্ঠ ২৪ শাখা ব্যবস্থাপকসহ ১৯৪ কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করেছে। তাদের বিরুদ্ধে অর্থ পাচার ও নামে-বেনামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তৈরি করে এস আলমকে ঋণ দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে। ব্যাংকের চট্টগ্রাম অঞ্চলের সব শাখায় বিশেষ পরিদর্শন শেষে নিরীক্ষা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ব্যাংকটি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানা গেছে। শাখা ব্যবস্থাপকদের আগামী ২১ দিনের মধ্যে তাদের সময়ে দেওয়া ঋণ আদায়ের নির্দেশনা দিয়ে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে।
এর আগে ব্যাংকটির চট্টগ্রাম উত্তর জোনের প্রধান মো. হাফিজুর রহমানকে প্রত্যাহার করা হলে তিনি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন। এ ছাড়া ব্যাংকের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তফা খায়েরও স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন। ব্যাংকের নিরীক্ষা বিভাগের প্রধান রফিকুল আলমও পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন বলে জানা গেছে।
সম্প্রতি প্রত্যাহার করা ২৪ শাখা ব্যবস্থাপকের মধ্যে রয়েছেন আগ্রাবাদ শাখার ব্যবস্থাপক মোশাররফ হোসেন চৌধুরী, আন্দরকিল্লা শাখার মোরশেদুল আলম, খাতুনগঞ্জ শাখার মো. মোস্তফা, জুবিলি রোড শাখার মো. আনোয়ারুল আলম, বন্দরটিলা শাখার মো. সাইফুদ্দিন, চকবাজার শাখার আবু হাসান মোস্তফা কামাল, কদমতলী শাখার এসএম কফিল উদ্দীন, পাঁচলাইশ শাখার মো. মাহাবুল আলম, প্রবর্তক মোড় শাখার মোহাম্মদ উল্লাহ, কুমিরা শাখার মো. ফজলুল হক, পাহাড়তলী শাখার সুলতানা নাজনীন চৌধুরী, সদরঘাট শাখার আবু ইউসুফ মো. হেলাল উদ্দীন, বহদ্দারহাট শাখার মো. ওসমান, পটিয়া শাখার মো. বশির উল্ল্যাহ, পটিয়া মহিলা শাখার ফারাহ দিবা বানু, দোভাষী বাজার শাখার নাসির উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী, ফতেয়াবাদ শাখার মো. কামাল হোসেন, হালিশহর শাখার এসএম মোনসেফ আহমেদ, হাটহাজারী শাখার মো. আবদুল মাবুদ, রাহাত্তারপুল শাখার মো. হারুনার রশিদ, চন্দনাইশ শাখার মো. মোর্শেদুল আলম চৌধুরী, মোহড়া শাখার আরাফত উল্লাহ, বোয়ালখালী শাখার সেলিম উদ্দীন ও খুলশী শাখার ব্যবস্থাপক খুরশিদ আলম।
এদিকে এস আলমের ব্যাংক লুটের বিষয়ে তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের ১৩ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করেছে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটি। জানা গেছে, এস আলম গ্রুপ ও তার সহযোগীদের হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের তথ্য অনুসন্ধানে তাদের সহায়তা চাচ্ছে দুদক। একই সঙ্গে এ ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কোন কোন কর্মকর্তা জড়িত তাও খতিয়ে দেখা হবে।
জানা গেছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর বরাবর অনুসন্ধান কর্মকর্তা উপপরিচালক ইয়াছির আরাফাত সই করা তলবি চিঠিতে তাদের আগামী ২০ ও ২১ নভেম্বর দুদকে হাজির হয়ে বক্তব্য দিতে বলা হয়েছে। চিঠিতে কর্মকর্তাদের হাজির হওয়ার পাশাপাশি তাদের পরিচয়পত্র ও পাসপোর্টের সত্যায়িত ফটোকপি সঙ্গে নিতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া চিঠিতে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের চাকতাই শাখার গ্রাহক মেসার্স মুরাদ এন্টারপ্রাইজ, জুবিলি রোড শাখার গ্রাহক ইউনাইটেড সুপার ট্রেডার্স, খাতুনগঞ্জ শাখার গ্রাহক সেঞ্চুরি ফুড প্রোডাক্টস নামীয় ঋণ পরিদর্শন ও মনিটরিং সংক্রান্ত কর্মকর্তার ভূমিকার বিষয়ের বিস্তারিত তথ্যসহ হাজির হতে বলা হয়েছে।
দুদকের জিজ্ঞাসবাদের মুখে পড়া কর্মকর্তারা হলেন- বাংলাদেশ ব্যাংক পরিদর্শন বিভাগের যুগ্ম পরিচালক সুনির্বাণ বড়ুয়া, অনিক তালুকদার, অতিরিক্ত পরিচালক শংকর কান্তি ঘোষ, ছলিমা বেগম, উপপরিচালক মো. জুবাইর হোসেন ও রুবেল চৌধুরী। তাদের আজ (বুধবার) হাজির হতে হবে।
এ ছাড়া কাল ২১ নভেম্বর যাদের তলব করা হয়েছে তারা হলেনÑ বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংক পরিদর্শন বিভাগের যুগ্ম পরিচালক সৈয়দ মু. আরিফ-উন-নবী, অতিরিক্ত পরিচালক মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন, মো. শোয়েব চৌধুরী, মো. মঞ্জুর হোসেন খান ও মো. আব্দুর রউফ, উপপরিচালক লেনিন আজাদ পলাশ এবং পরিচালক মো. সরোয়ার হোসাইন। একই ঘটনায় এর আগে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের ২৩ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করেছিল সংস্থাটি।
অভিযোগ রয়েছে, মেসার্স মুরাদ এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী গোলাম সারওয়ার চৌধুরী, জুবিলি রোড শাখার গ্রাহক ইউনাইটেড সুপার ট্রেডার্স, খাতুনগঞ্জ শাখার গ্রাহক সেঞ্চুরি ফুড প্রোডাক্টসসহ অন্যরা ঋণের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা ইসলামী ব্যাংকে থেকে আত্মসাৎ করেছে।