প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ০৪ নভেম্বর ২০২৪ ২২:১২ পিএম
অবৈধ অভিবাসীদের বৈধতাসহ জিএসপি নীতি সংশোধন চায় বাংলাদেশ। যাতে করে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের পরও ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশ জিএসপি সুবিধা পেতে পারে। বহুপাক্ষিক উদ্যোগের মাধ্যমে মিয়ানমারে রোহিঙ্গারা যাতে তাদের নিজ দেশে ফিরে যেতে পারে সে বিষয়েও বাংলাদেশ-ইউরোপীয় ইউনিয়ন যৌথ কমিশন সভায় আলোচনা হয়।
সোমবার (৪ নভেম্বর) রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে এনইসি সভাকক্ষে দিনব্যাপী বাংলাদেশ-ইউরোপীয় ইউনিয়ন যৌথ কমিশনের ১১তম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব মো. শাহরিয়ার কাদের ছিদ্দিকী এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় বিভাগের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক পাওলা পাম্পালোনি বৈঠকে নেতৃত্ব দেন।
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, ইইউ ট্যালেন্ট পার্টনারশিপ প্রোগ্রামের আওতায় আরও দক্ষ শ্রমিক চায় ইউরোপ। ইউরোপের দেশগুলো প্রায় ১০টি খাতে বাংলাদেশ থেকে লোক নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। ইইউভুক্ত ওই দেশগুলোতে বৈধপথে দক্ষ জনশক্তি পাঠানোর জন্য একটি রোডম্যাপ তৈরি করছে সরকার। সবকিছু ঠিক থাকলে দুইপক্ষের সম্মতিতে রোডম্যাপটি প্রকাশ করা হবে। বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে জার্মানি, ইতালি, গ্রিস ও রুমানিয়া লোক নিতে আগ্রহী। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে যে খাতগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে সেগুলো হচ্ছেÑ আইসিটি, কেয়ারগিভিং, নির্মাণশিল্প, ট্যুরিজম ও হসপিটালিটি, কৃষি ও কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাত, জাহাজ নির্মাণ ও তৈরি পোশাক শিল্প।
বৈঠক সূত্র জানায়, জিএসপি নিয়ে বাংলাদেশ ইইউ প্রতিনিধিদের কাছে কিছু দাবি তুলে ধরেছে। তার মধ্যে অন্যতমÑ ইইউ নতুন (খসড়া) জিএসপি স্কিম, বিশেষ করে সুরক্ষা ধারাগুলো সংশোধন করার কথা বিবেচনা করা। যাতে করে বাংলাদেশের সব পণ্য, যার মধ্যে তৈরি পোশাক (আরএমজি) পণ্যগুলো জিএসপি+ সুবিধা পেতে পারে। বাংলাদেশের পণ্য যাতে করে শুল্কমুক্তভাবে ইউরোপের বাজারে প্রবেশ করতে পারে সেই জন্য কিছু নীতি সংশোধন করার অনুরোধ করা হয়েছে। নতুন ইইউ জিএসপি ব্যবস্থা এবং এর সুরক্ষা বিধানগুলো স্থগিত করার কথা বলা হয়েছে। এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের দোহাই দিয়ে বাংলাদেশের পোশাক খাতকে যাতে করে ইইউ বাজার শাস্তি না দেয় সেই বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
বৈঠক সূত্র জানায়, তৈরি পোশাকসহ বাংলাদেশি পণ্যের সবচেয়ে বড় ক্রেতা ইইউ। স্বল্পোন্নত (এলডিসি) দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে ইউরোপের বাজারে জিএসপি সুবিধার আওতায় ইবিএ (অস্ত্র ছাড়া বাকি সব পণ্য) ক্যাটাগরিতে পণ্য রপ্তানিতে কোনো শুল্ক দিতে হয় না। ২০২৪ সালে বাংলাদেশ যদি উন্নয়নশীল দেশে উন্নীতও হয়, তারপরও ২০২৭ সাল পর্যন্ত এই সুবিধা অব্যাহত থাকবে। জিএসপি সুবিধা হারালে শূন্য শতাংশের বদলে বাংলাদেশকে রাতারাতি ১২ শতাংশ শুল্ক দিয়ে ইইউভুক্ত দেশগুলোতে পণ্য রপ্তানি করতে হবে। এ বিষয়গুলো নিয়ে বাংলাদেশ-ইইউ যৌথ কমিশন সভায় আলোচনা হয়েছে। জিএসপি সুবিধা সময়সীমা বৃদ্ধির সুপারিশ করা হয়েছে। তবে কারখানার কমপ্লায়েন্স বা উন্নত কর্মপরিবেশ ও শ্রমিকদের নানা বিষয়গুলো দেখে জিএসপি সুবিধার সময় বৃদ্ধির বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হবে বলে জানায় ইইউ প্রতিনিধি।
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, ইইউ অতিরিক্ত তিন বছরের ট্রানজিশন পিরিয়ড দিয়েছে, ফলে ২০২৯ সালের নভেম্বরের শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের জন্য সুবিধাগুলো অ্যাক্সেস থাকবে। ২০২৯ সালে তিন বছরের ট্রানজিশন পিরিয়ড শেষ হওয়ার পরে, বাংলাদেশ কীভাবে এই সুবিধা আরও বৃদ্ধি করতে পারেÑ তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বিকল্পভাবে, বাংলাদেশ জিএসপি স্কিমের জন্য আবেদন করতে পারেÑ যা টেক্সটাইল ও পোশাকসহ ইইউ শুল্ক লাইনের ৬৬ শতাংশে শুল্কমুক্ত অ্যাক্সেস থাকবে। বাংলাদেশকে অবশ্যই দুটি মানদণ্ড পূরণ করতে হবেÑ দুর্বলতার মানদণ্ড এবং টেকসই উন্নয়নের মানদণ্ড।
যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, করোনা সংকট পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ যেসব সংকটে পড়েছে তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট, গাজায় ইসরায়েলের হামলায় বাংলাদেশে কী ধরনের প্রভাব পড়েছেÑ এসব বিষয়েও আলোচনা হয়েছে। এসব বিরূপ প্রভাবের মুখোমুখি হয়েছিল বাংলাদেশ, ফলে দেশে মুদ্রাস্ফীতি ও মূল্যবৃদ্ধির ওপর প্রভাব পড়ে বলে দাবি বাংলাদেশের। ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) জুলাই ২০২৪ সালে বিশ্ব অর্থনৈতিক আউটলুক প্রকাশ করে। এতে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ২০২৪ সালে ৩ দশমিক ২ এবং ২০২৫ সালে ৩ দশমিক ৩ হবে। এ বিষয়গুলোও আলোচনায় উঠে আসে। ফলে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা বাংলাদেশকে প্রভাবিত করেছে এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো এখানের উন্নয়নকেও শ্লথ করে দিয়েছে বলে জানায় বাংলাদেশ।
২০২২ সালে বাংলাদেশে জিডিপি বৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ১ শতাংশ দেখানো হয়। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৫ দশমিক ৭৮ শতাংশ এবং বর্তমান অর্থবছরের জন্য অনুমান করা হয়েছে ৫ দশমিক ৮২ শতাংশ। এসব বিষয় নিয়ে যৌথ কমিশন সভায় আলোচনা হয়। বাংলাদেশে বৈশ্বিক ঋণ, অনুদান ও ঋণ পরিশোধের সাম্প্রতিক চিত্র নিয়েও আলোচনা হয়েছে।
ইইউ জানায়, দেশের আর্থিক খাতে সঠিক নীতি এবং হস্তক্ষেপের মাধ্যমে মোকাবিলা করা প্রয়োজনÑ এমন চ্যালেঞ্জ রয়েছে। যেসব ক্ষেত্রে বড় ধরনের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন তার মধ্যে রয়েছেÑ সুশাসন, ব্যবস্থাপনা এবং আর্থিক ও ঋণ পরিস্থিতি পুনরুদ্ধার, পুঁজিবাজার ব্যবস্থাপনা, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, ভোগ ব্যয় নিয়ন্ত্রণ ও কর্মসংস্থান। দারিদ্র্য বিমোচন নিয়েও আরও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা দরকার। এখানে, দেশের আর্থিক খাতে ব্যাপক সংস্কার প্রয়োজন। বাংলাদেশকে ছাড়ের শর্তে ঋণ ও ক্রেডিট নিতে হবে।
বাংলাদেশ ও ইইউ উভয়পক্ষ বিভিন্ন বহুপাক্ষিক উদ্যোগের মাধ্যমে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের জন্য জবাবদিহি নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে। বাংলাদেশের মানুষ, সরকার, পাশাপাশি এনজিওসহ আন্তর্জাতিক মানবতাবাদী সম্প্রদায় যৌথভাবে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা সংকটের কারণে সৃষ্ট মানবিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। সরকার ও জনগণের উদার ও মানবিক ভূমিকা এবং কর্মের জন্য ইইউ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।
সভায় ইইউ ও বাংলাদেশ উভয়ই বাণিজ্য ও বিনিয়োগ প্রবাহ বৃদ্ধির মাধ্যমে অর্থনৈতিক সম্পর্ককে জোরদার করার লক্ষ্যে একমত হয়েছে। এভরিথিং বাট আর্মস (ইবিএ) নীতিতে দুই পক্ষ বাণিজ্য করবে বলে সিদ্ধান্ত হয়। ইইউ বর্তমানে বাংলাদেশের প্রধান বাণিজ্য অংশীদার, ইইউ-বাংলাদেশ জলবায়ু সংলাপকে আরও বাড়ানোর জন্য উভয় পক্ষ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বলে বিবৃতিতে জানানো হয়।
শ্রমের অধিকারসহ মানবাধিকারের সম্মানের ক্ষেত্রে ভবিষ্যতের যেকোনো বাণিজ্যিক সম্পর্ক শর্তযুক্ত। বাংলাদেশ সরকার শ্রম অধিকারের মানসম্পন্ন টেকসই সংস্কার এবং ত্রিপক্ষীয় সম্পর্কের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) কনভেনশনগুলো মেনে চলবে। ইইউ ও বাংলাদেশ শ্রম ও মানবাধিকারের সঙ্গে সম্মতি জোরদার করার কয়েকটি বিষয়ে একটি রোডম্যাপ তৈরি করতে সম্মত হয়েছে। এই বিষয়গুলো নিয়েও আলোচনা হয়েছে।