বগুড়া অফিস ও হিলি (দিনাজপুর) প্রতিবেদক
প্রকাশ : ০২ নভেম্বর ২০২৪ ১৮:৩১ পিএম
আপডেট : ০২ নভেম্বর ২০২৪ ১৮:৩১ পিএম
ভারত থেকে সীমান্ত পথে মসলাজাতীয় পণ্য জিরার চোরাচালান বেড়েছে। মূলত বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), পুলিশসহ অন্যান্য বাহিনীকে চলতি বছরের জুলাইয়ের মাঝামাঝি সৃষ্ট বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন দমানোর কাজে ব্যস্ত থাকার সুযোগে চোরাকারবারিরা ওই সময় থেকে বড় ধরনের সুযোগ পেয়ে যায়। পরবর্তীতে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতন ঘটলেও ওই বাহিনীগুলোর সদস্যদের মধ্যে কর্তব্য পালনে শিথিলতা থাকায় চোরাকারবারিরা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে।
আমদানিকারক ও বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, চোরাই পথে আনা জিরায় বাজার সয়লাব হওয়ায় লোকসানের আশঙ্কায় ব্যবসায়ীরা পণ্যটির আমদানি কমাতে বাধ্য হচ্ছেন। দেশের উত্তরাঞ্চলে দিনাজপুরের হিলি সীমান্ত দিয়েই কেবল গত ৪ মাসে জিরার আমদানি গড়ে ৩১ শতাংশ কমেছে। এতে সরকার ৭০ কোটি টাকারও বেশি রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছে। তবে অন্যান্য বন্দর দিয়ে আমদানির হিসাব বিবেচনায় নিলে ৪ মাসে রাজস্ব ক্ষতি ১০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, ভারত থেকে আমদানি করা জিরার প্রায় ৯৫ ভাগই আমদানি হয় হিলি স্থলবন্দর দিয়ে। গত অর্থবছর অর্থাৎ ২০২৩ সালের ১ জুলাই থেকে চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত ওই বন্দর দিয়ে ২২ হাজার ৪১৫ মেট্রিক টন জিরা আমদানি করা হয়। আমদানিকারকরা জানান, ভারতে ১ মেট্রিক টন জিরার মূল্য ৩ হাজার ৫০ মার্কিন ডলার হলেও সরকারি নিয়ম অনুযায়ী ৩ হাজার ৫০০ টাকা নির্ধারিত দর ধরে শুল্ক নেওয়া হয়। বর্তমানে ভারতে প্রতি কেজি জিরার মূল্য ৩৬৬ টাকা। এর ওপর ৬৯ শতাংশ অর্থাৎ ২৫৩ টাকা শুল্ক আদায় করা হয়।
হিলি স্থলবন্দর সূত্রে প্রাপ্ত হিসাবে বলা হয়েছে, চলতি বছরের ১ মার্চ থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত ৪ মাসে ৮ হাজার ৫৭২ মেট্রিক টন জিরা আমদানি হয়েছে। পক্ষান্তরে ১ জুলাই থেকে ২৯ অক্টোবর পর্যন্ত ৪ মাসে আমদানি হয়েছে মাত্র ৫ হাজার ৮৪০ মেট্রিক টন। আগের ৪ মাসের চেয়ে পরের ৪ মাসে অর্থাৎ জুলাই মাসে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন শুরু হওয়ার পর থেকে আমদানি ২ হাজার ৭৩২ মেট্রিক টন বা ২৭ লাখ ৩২ হাজার কেজি কমেছে। প্রতি কেজি জিরায় সরকার ২৫৩ টাকা শুল্ক নেয়। ওই হিসাবে শুধু হিলি বন্দরেই সরকার ৪ মাসে ৭০ কোটি টাকা রাজস্ব হারিয়েছে। দেশের অন্যান্য বন্দরের হিসাব ধরলে তা ১০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
দিনাজপুরের হিলি সীমান্ত দিয়ে বগুড়ার অন্তত ১০ জন ব্যবসায়ী জিরা আমদানি করে থাকেন। তাদেরই একজন শহরের রাজাবাজারের ‘রাজ ভান্ডার’-এর স্বত্বাধিকারী পরিমল প্রসাদ রাজ জানান, চলতি বছরের জুলাইয়ের আগে তারা প্রতি মাসে গড়ে ৪০ ট্রাক (প্রতি ট্রাকে ৩০ মেট্রিক টন) জিরা আমদানি করতেন। কিন্তু বর্তমানে তারা মাসে ১০ থেকে ১২ ট্রাক জিরা আনছেন। আমদানি কমিয়ে দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা আমদানি করা জিরা ঢাকা, চট্টগ্রামসহ সারা দেশে সরবরাহ করে থাকি। কিন্তু সম্প্রতি আমরা লক্ষ করছি যে, যারা আমাদের থেকে জিরা কিনতেন তারা আর আগের মতো কিনছেন না। কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানতে পারি চোরাই পথে ভারত থেকে জিরা আনা হচ্ছে। অবৈধ পথে আনা ওই জিরায় যেহেতু কোনো ট্যাক্স ও ভ্যাট দিতে হয় না, তাই চোরাকারবারিরা সেগুলো আমাদের চেয়ে অনেক কম দামে বিক্রি করতে পারছেন।’ তার দেওয়া হিসাব অনুযায়ী আমদানির ক্ষেত্রে সরকারি শুল্ক পরিশোধের পর প্রতি কেজি জিরার মূল্য পড়ে ৬১৯ টাকা। খুচরা বাজারে তা ৬৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পক্ষান্তরে চোরাকারবারিরা অবৈধ পথে আনা জিরাগুলো পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে ৪০০ থেকে সাড়ে ৪০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছে। ওই দরে কেনা জিরা আবার খুচরা বাজারে আমদানি করা জিরার মতোই ৬৪০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। কেজিপ্রতি প্রায় ২০০ টাকা ব্যবধান হওয়ায় আমদানিকারকরা চোরাকারবারিদের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারছেন না বলেও তিনি জানান। পরিমল প্রসাদ রাজ চোরাচালান বন্ধের পাশাপাশি স্ল্যাবভিত্তিক শুল্ক প্রথার পরিবর্তে প্রকৃত আমদানি মূল্যের ওপর শুল্কায়নের দাবি জানিয়ে বলেন, ‘এখন প্রতি টন জিরার আমদানি মূল্য ৩ হাজার ৫০ ডলার হলেও আমাদের নির্ধারিত দর ৩ হাজার ৫০০ ডলারের ওপর শুল্ক গুনতে হচ্ছে। যদি প্রকৃত ক্রয়মূল্যের ওপর শুল্ক ধার্য করা হয় তাহলে সরকার ও জনগণ দুই পক্ষই লাভবান হবে।’
সুশাসনের জন্য প্রচারাভিযানের (সুপ্র) বগুড়া জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক কেজিএম ফারুক চোরাচালান বন্ধে সরকারকে এখনই কঠোর হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘বিপ্লবপরবর্তী পরিস্থিতিতে আমাদের অবশ্যই সজাগ ও সতর্ক হতে হবে। চোরাচালান দেশের অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। অতএব এটা বন্ধে সরকারকে অবশ্যই কঠোর হতে হবে।’