জাতীয় যুব দিবস আজ
ফারহানা বহ্নি
প্রকাশ : ০১ নভেম্বর ২০২৪ ০০:০৪ এএম
আপডেট : ০১ নভেম্বর ২০২৪ ১০:৫০ এএম
নিজের অফিসে কাপড়ের রঙ পর্যবেক্ষণ করছেন সায়েম হোসেন শান্ত। প্রবা ফটো
১৯৯৬ সালে ঢাকায় এসে নটর ডেম কলেজে ভর্তি হন সায়েম হোসেন শান্ত। কিছুই ছিল না তখন। তবে স্বপ্ন ছিল বড় কিছু করার। সেই স্বপ্নের প্রতি বিশ্বাস রেখেই গড়ে তুলেছেন নিজের প্রতিষ্ঠান পাতাবন। মাত্র ১ হাজার টাকা খরচ করে কাজ শুরু করেন তিনি। এখন সেখানে কাজ করেন হাজারেরও বেশি কর্মী। কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে গ্রামীণ নারীদেরও। নারী-পুরুষের কর্মসংস্থানের বৈষম্য দূর করতে চান তিনি। শান্তর মতো মানুষদের স্বপ্নকে এগিয়ে নিতে আজ সারা দেশে পালিত হচ্ছে জাতীয় যুব দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য ‘দক্ষ যুব গড়বে দেশ, বৈষম্যহীন বাংলাদেশ’।
পুরুষদের মতো নারীরাও যেন নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে, সেটাই প্রত্যাশা করেন শান্ত। তিনি বলেন, আমি যখন কন্ট্রাক্টে কাজ করতাম, ডেলিভারি দিতে একটু দেরি হলে আমার পাওনা থেকে ১০ শতাংশ বা ৫ শতাংশ কেটে নিত। এখন আমি যখন কাজ দিই, কেউ দেরি করলে টাকা কেটে রাখি না। নিজে পরিশ্রম করে একটু একটু করে ওপরে উঠেছি। তাই শ্রমজীবী মানুষের কষ্টগুলো বুঝি।
পাবনার চাটমোহর থানার হান্ডিয়াল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। পরিবারের দুই ভাইয়ের মধ্যে তিনিই বড়। বাবা মীর গোলাম মোস্তফা ছিলেন গ্রামের একজন ডাক্তার। মা লতা বেগম গৃহিণী। গ্রাম থেকে আসা সায়েম প্রথম ঢাকায় পা রেখে কিছুই চিনতেন না। সেখান থেকে তার এই স্বপ্নপূরণের পথটাও সহজ ছিল না। বারবার ধাক্কা খেয়েছেন, তবু হাল ছাড়েননি।
১৯৯৭ সালে যুব উন্নয়নে অধিদপ্তরে প্রশিক্ষণ নেন ব্লক-বাটিকের ওপর। সেখানে প্রথমস্থান অধিকার করেন, তারপর আরও এক দফা প্রশিক্ষণ নেন। সে সময় কাজ করার জন্য টেবিলও ছিল না। পরে খালার বাসায় একটি টেবিলে ব্লকের কাজ শুরু করেন। একাই প্রতিদিন ২০ থেকে ২৫টা কাপড়ে ব্লক করা শুরু করেন। সাড়াও পান বেশ। সকাল থেকে শুরু করে রাত পেরিয়ে গেলেও দুই হাতে ব্লকের কাজ করে গেছেন তিনি। কিছুদিন পরই অর্ডার আসতে শুরু করে। সে সময় যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে ২০ হাজার টাকা ঋণ নেন। তারপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি। উদ্যোক্তা হিসেবে ২০০২ সালে জাতীয় যুব পুরস্কার পান। তারপর শহীদ সোহরাওয়ার্দী পুরস্কার, সফল ব্যবসায়ী পুরস্কার এমন অসংখ্য পুরস্কার লাভ করেন তিনি।
পাতাবনে কাজ করছেন কর্মীরা। প্রবা ফটো
তবে সায়েম হোসেন শান্ত তার কাজ নিয়ে শুধু ঢাকাই বসে ছিলেন না। শহর ছেড়ে পৌঁছে যান গ্রামীণ নারীদের কাছেও। শুরু করেন নিজ গ্রাম থেকে। প্রথমে পাঁচ দিনের একটি কর্মশালা করেন। এতে অনেক সাড়া পেলে তাদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। তারপর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৮০০ নারীর কর্মসংস্থান এখন পাতাবন। পাবনা থেকে এ কাজে যুক্ত হয়েছে আর ৭টি জেলার মানুষ। কক্সবাজার, যশোর, সাতক্ষীরা, বগুড়া, গাইবান্ধায়ও নারীরা কাপড়ের বিভিন্ন কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন।
শান্ত মনে করেন অর্থের চেয়েও বেশি প্রয়োজন চেষ্টা আর ধৈর্যের, সঙ্গে মেধা। কাজের মধ্যেই তিনি আবিষ্কার করেন, গাড়িতে স্প্রে করার মেশিন দিয়ে কাপড়ে কাজ করা যায়। তিনি বলেন, আমি একদিন দেখলাম গাড়িতে রঙ স্প্রে করছে। কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এই মেশিনটা কোথায় পাওয়া যায়, কিন্তু তারা আমাকে বলে না। আমি পরদিনই নবাবপুরে চলে গেলাম কিছু টাকা নিয়ে। সেখান থেকে একটা স্প্রে মেশিন কিনলাম। তারপর বাসায় আনার পর দেখি এটা দিয়ে ভালোভাবে হচ্ছে না। আবার গেলাম দোকানে, বললাম, পরিবর্তন করে দেন, তারপর আরেকটা নিয়ে আসি, সেটা দিয়ে ১০ মিনিটে আমার কাপড়ে কাজ করে ফেলি। তখন একেকটা কাপড়ে কাজের জন্য ৩০০ টাকা করে পেতাম, এখন সেটা ১ হাজার। সেই সময় এই স্প্রে মেশিনের ব্যবহারের কথা কেউ ভাবেনি। শুধু তা-ই নয়, আরও অনেক কৌশল বের করেন শান্ত। কীভাবে স্বল্প সময় ও অল্প পরিশ্রমে দ্রুত কাজ করা যায়, সেসব নিয়ে ভাবতে থাকেন।
শান্ত আরও বলেন, আজকে ২৬ বছর ধরে পাতাবনের সঙ্গে আছি। এটার সঙ্গেই লেগে ছিলাম। যখন গ্রাম থেকে প্রথম ঢাকায় আসি, এক আত্মীয়র দোকানে বসতাম। ছোট থেকেই আঁকাআঁকির প্রতি ঝোঁক ছিল। ডিজাইন করতাম বিভিন্ন ব্যানারে, কার্ডে। আঁকতে আমার খুবই ভালো লাগত। সেখানেই আমার ভাই বললেন যুব উন্নয়নে প্রশিক্ষণ নিতে। সেখানে প্রশিক্ষণ নিয়ে থেমে থাকিনি, কাজ করা শুরু করি। প্রথমে ৭০০ টাকার রঙ ও ৩০০ টাকার সরঞ্জাম নিয়ে শুরু করি। নতুন ফ্যাক্টরিতে ২০টা শাড়ির অর্ডার এলো, কর্মীও ২০ জন। তারপর অর্ডার এত বাড়তে থাকল যে, সবাইকে সময়মতো ডেলিভারি দিতে পারছি না।
শান্ত যখন ব্লকের কাজ শুরু করেন তখন ব্যাপারটা এতটা সহজ ছিল না। প্রশিক্ষণ নিয়েও রঙ তৈরি করতে গিয়ে বিপাকে পড়েন। তারপর শিক্ষকের কাছে গেলে শিক্ষকও দেখতে পান রঙ ক্রিমের মতো হয়ে গেছে। তিনি চলে গেলেন রঙের দোকানে। একজন শিক্ষার্থীর আগ্রহ দেখে দোকানদার তাকে বসিয়ে শেখান। দোকানে বসেই খাতা-কলমে সবকিছু নোট করে নিয়ে আসেন। বাসায় সে অনুযায়ী রঙ তৈরি করেন।
পাতাবনে কাজ করছেন কর্মীরা। প্রবা ফটো
উদ্যোক্তা হতে হলে কী গুণ থাকতে হয়- এ প্রশ্নে শান্ত বলেন, ডিজাইনের মধ্যে ভিন্নতা থাকতে হবে, ঝোঁক থাকতে হবে। নতুন কিছু করতে পারার মানসিকতা লাগবে। ব্যবসায় মূলধন জরুরি কিছু না যদি স্বপ্ন ও মেধা থাকে। আমার খুব খারাপ লাগে যখন দেখি আমাদের দেশে কাজ করার লোক আছে, কিন্তু কেউ কাজটাকে ধরে রাখছে না। এই দেশে নারীরা সবচেয়ে বেশি বেকার, তাদের কাজের মধ্যে যুক্ত করতে চাই।
নতুন উদ্যোক্তাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আমি বলব সবসময় মনে রাখতে হবে, সায়েম ভাই পারলে আমিও পারব। তার মধ্যে আগ্রহ থাকলে সে সায়েম ভাইয়ের চেয়েও এগিয়ে যেতে পারবে। বাংলাদেশ কতটা সম্ভাবনাময় সেটা বুঝতে হবে। পথে অনেকেই আমাকে ঠকিয়েছে। কিন্তু আমার কাজটা আমি সততার সঙ্গে করে গেছি।’
যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে অনেকেই স্বাবলম্বী হচ্ছে আবার অনেকেই ঝরে পড়ে পুঁজির অভাবে। কথা হয় অধিদপ্তরের ব্লক-বাটিক স্ক্রিন প্রিন্টিংয়ের সিনিয়র প্রশিক্ষক দেওয়ান ফাতেমা নার্গিসের সঙ্গে। তিনি বলেন, সেলাইয়ের জন্য একটা মেশিন লাগে, কিন্তু ব্লক-বাটিক এমন একটা কাজ যেটাতে বেশি পুঁজি দরকার হয় না। কিন্তু বিক্রির ঝামেলা এড়ানোর জন্য অনেকে ঝরে যায়।