আরমান হেকিম
প্রকাশ : ৩০ অক্টোবর ২০২৪ ১০:১৬ এএম
আপডেট : ৩০ অক্টোবর ২০২৪ ১১:০৩ এএম
পিবি গ্রাফিক্স
সরকারের একজন যুগ্ম সচিব (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক)। ২০১৮ সালের দিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পান। প্রকল্পটিতে বিদেশি ঋণ সহায়তা ছিল। ঋণদাতা সংস্থাটির একজন প্রতিনিধি মেইলে এবং সরাসরি তার অফিসে এসে প্রকল্পে সাতজনকে পরামর্শক নিতে চাপ দেন। কিন্তু তিনি রাজি হননি। এরপর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মাধ্যমে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তবু তিনি রাজি না হলে পরবর্তী সময়ে তাকে বিদেশ সফরসহ নানা ধরনের প্রলোভন দেখানো হয়। সবশেষ প্রকল্প থেকে ইস্তফা দেন তিনি।
বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (বাপবিবো) বিদেশি ঋণের একটি প্রকল্পে এখনও বিদেশি ঋণ প্রাপ্তির বিষয়টি চূড়ান্ত হয়নি। তার আগেই বাপবিবো ওই ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করে পরামর্শক খাতে ব্যয় ধরে রেখেছে। অথচ নিয়ম অনুযায়ী ঋণসহ যাবতীয় বিষয়ে বিদেশি সংস্থার সঙ্গে আলোচনা করতে পারে একমাত্র অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)। আর প্রকল্পটিতে কোনো পরামর্শক প্রয়োজন নেই বলেও মতামত দিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন।
শুধু এই দুটি উদারহণ নয়, বিদেশি ঋণের প্রকল্পে পরামর্শক নিয়োগের এমন ঘটনা অহরহ ঘটছে। ইআরডি সূত্রে জানা গেছে, বিদেশি ঋণের প্রায় সব প্রকল্পেই পরামর্শক খাত রাখা হয়। অনেক উন্নয়ন সহযোগীর ঋণের শর্ত হিসেবেই এগুলো থাকে। পরামর্শক প্রয়োজন না হলেও নিতে হয়। পরিকল্পনা কমিশন ও প্রকল্পের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ঋণ সহায়তার প্রকল্পের মোট ব্যয়ের ৭ থেকে ১২ শতাংশ পর্যন্ত পরামর্শক ব্যয়েই চলে যাচ্ছে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বিদেশি ঋণের লক্ষ্য ধরা হয়েছে এক লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে যদি সর্বনিম্ন সাত শতাংশ পরামর্শকে ব্যয় হয় তাহলে সাত হাজার কোটি টাকা ব্যয় হতে পারে পরামর্শক খাত বা বিদেশিদের নিয়োগে।
ওই যুগ্ম সচিব যখন প্রকল্পের দায়িত্ব পান তখন তিনি উপসচিব পদে ছিলেন। তিনি প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই ঋণদাতা সংস্থার ওই প্রতিনিধি আমাকে নানাভাবে পরামর্শক নিয়োগ দেওয়ার জন্য বলতে থাকেন। প্রকল্পের ডিপিপিতেও পরামর্শক খাত রাখা হয়েছে। আমি চাইলে নিতে পারতাম। এটি বৈধ ছিল। কিন্তু আমি দেখলাম এই ধরনের কাজের জন্য বিদেশি কোনো পরামর্শক না নিলেও হয়। তাহলে কেন আমি অনর্থক পরামর্শক নিয়ে সরকারের অর্থ অপচয় করব। এজন্য আমি তার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিই।’
তিনি আরও বলেন, ‘এরপরে অনেকের মাধ্যমে ওই প্রতিনিধি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কিন্তু আমি তার কথায় সায় দেইনি। সবশেষ তিনি আমাকে বলেন অন্তত একজন যেন পরামর্শক নিয়োগ দেই। কিন্তু আমি অনড় ছিলাম। পরবর্তী সময়ে দেখলাম ঋণদাতা সংস্থার প্রতিনিধি প্রকল্প বাস্তবায়নে নানা ধরনের ঝামেলা আছে। পরামর্শক নিয়োগ না দেওয়ায় অনেকের বিরাগভাজনে পরিণত হই। তাই প্রকল্প পরিচালকের পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে চলে আসি। আমি আসার পরে শুনেছি প্রকল্পটিতে পরামর্শক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।’
তিনি পরামর্শক নিয়োগ না দিলেও বাপবিবোর বিদ্যমান শিল্পসমৃদ্ধ এলাকার ৩৩/১১ কেভি আউটডোর উপকেন্দ্রের আধুনিকায়ন ও ক্ষমতাবর্ধন শীর্ষক প্রকল্পে ঠিকই পরামর্শক নিয়োগের সুযোগ রাখা হয়েছে। জার্মান উন্নয়ন ব্যাংকের (কেএফডাব্লিউ) ঋণ সহায়তার প্রকল্পটিতে বিধিবহির্ভূতভাবে ৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ে পরামর্শক রাখা হয়েছে। এই ব্যয়ের মধ্যে সরকারি অর্থায়নও রয়েছে ১৮ কোটি টাকা।
সম্প্রতি প্রস্তাবিত এই প্রকল্পের মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় পরিকল্পনা কমিশনের শিল্প ও শক্তি বিভাগের প্রধান মো. ইউনুছ মিয়া পরামর্শক খাতের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন করলে সভা থেকে জানানো হয় পরামর্শক খাতের কোনো প্রয়োজন নেই; এ কাজে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের সক্ষমতা রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাপবিবোর সদস্য (বিতরণ ও পরিচালন) দেবাশীষ চক্রবর্তী বলেন, ‘উন্নয়ন সহযোগীর সঙ্গে আলোচনা করেই এ খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী ইআরডির মাধ্যমে ঋণদাতা সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। এ বিষয়ে ইআরডি কোনো কিছু জানে না বলে সভায় জানানো হয়।’
এরপর সভায় পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) ড. মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘প্রকল্পে অর্থায়ন ও এর মডালিটির বিষয়ে সংস্থার সরাসরি উন্নয়ন সহযোগীর সঙ্গে আলোচনার কোনো সুযোগ নেই। তা ছাড়া আলোচ্য প্রকল্পে বৈদেশিক সহায়তা প্রকল্প ঋণ হওয়ায় ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে উন্নয়ন সহযোগীর চাপিয়ে দেওয়া শর্তে পরামর্শক ব্যয়ের সংস্থান রাখায় সভায় অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়।
তিনি আরও বলেন, ‘বৈদেশিক সহায়তা অনুসন্ধান ও এ সংক্রান্ত আলোচনার জন্য ইআরডি মেন্ডেট প্রাপ্ত। যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে তা ইআরডির মাধ্যমে সম্পন্ন করা সমীচীন। এ প্রকল্পে বৈদেশিক অর্থায়নের অগ্রগতির বিষয়ে ইআরডির মতামত সংবলিত পত্র পুনর্গঠিত ডিপিপিতে সংযুক্ত করতে তিনি পরামর্শ প্রদান করেন।
অভিনব পরামর্শক ব্যয়ের যত প্রকল্প
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের বাস্তবায়নাধীন ‘আরবান ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড সিটি গভর্ন্যান্স প্রকল্প’। এ প্রকল্পে মোট ব্যয় ৩ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২ হাজার ২১৫ কোটি টাকা দেবে জাইকা আর সরকার দিচ্ছে ১ হাজার ১৮২ কোটি টাকা। প্রকল্পটিতে শুধু পরামর্শক বাবদ ব্যয় করা হচ্ছে ৩৭২ কোটি টাকা, যা মোট প্রকল্প ব্যয়ের ১১ শতাংশ। প্রকল্পটির আওতায় সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার অবকাঠামো উন্নয়ন এবং অবকাঠামো উন্নয়ন সংশ্লিষ্ট বিষয়ে নগর প্রশাসনের দক্ষতা বৃদ্ধি ও নগর জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন করা হবে। এ কাজে পরামর্শকের কী প্রয়োজন তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
একই ধরনের প্রকল্প রিজিলিয়েন্ট আরবান অ্যান্ড টেরিটোরিয়াল ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (আরইউটিডিপি)। সম্প্রতি প্রকল্পটি অনুমোদন দেয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। প্রকল্পটির মোট ব্যয় ৫ হাজার ৯০১ কোটি ২২ লাখ টাকা। যার মধ্যে ৪ হাজার ২৫৯ কোটি ৬০ লাখ টাকা দেবে বিশ্বব্যাংক। বাকি ১ হাজার ৬৪১ কোটি ৬২ লাখ টাকা দেবে সরকার। প্রকল্পটিতে পরামর্শক খাতে ব্যয় রাখা হয়েছে ৩১৬ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের প্রায় সাড়ে সাত শতাংশ। অবকাঠামো উন্নয়নে ৬০ বছরের অভিজ্ঞতা থাকার পরেও এ প্রকল্পে এলজিইডি কেন পরামর্শক নিয়োগ দেবে সেটা নিয়েও দেখা দিয়েছে প্রশ্ন।
বাংলাদেশ সড়ক নিরাপত্তা শীর্ষক প্রকল্পটির প্রস্তাবিত ব্যয় ছিল ৪ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা। তখন প্রকল্পটিতে বিশ্বব্যাংকের ঋণ ছিল ৩ হাজার কোটি টাকা। বাকি ১ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা দেবে সরকার। প্রকল্পটিতে পরামর্শক খাতেই ৪৪০ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছিল, যা মোট প্রকল্প ব্যয়ের ১০ শতাংশের বেশি।
২০২০ সালের শেষ দিকে প্রস্তাব করা হয় ‘সাসেক ঢাকা-সিলেট করিডোর সড়ক উন্নয়ন’ প্রকল্পের। এটির মোট ব্যয় ধরা হয় ১৭ হাজার ১৬১ কোটি ৯২ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে তিন হাজার ৫৫০ কোটি ২৮ লাখ টাকা এবং এডিবির ঋণ থেকে দেখানো হয় ১৩ হাজার ৬১১ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। এ প্রকল্পে পরামর্শক ব্যয় প্রস্তাব করা হয় ৩২৪ কোটি ৯৪ লাখ টাকা।
এডিবির ঋণের মহাসড়কের একই ধরনের ‘সাসেক সড়ক সংযোগ প্রকল্প-২ এলেঙ্গা-হাটিকামরুল-রংপুর মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ’ প্রকল্পে পরামর্শকের জন্য খরচ করা হচ্ছে ৫৩৫ কোটি ৬৭ লাখ ৩ হাজার টাকা। বিশ্বব্যাংকের ঋণে ‘বাংলাদেশ আঞ্চলিক অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন প্রকল্প-১’ (চট্টগ্রাম-ঢাকা-আশুগঞ্জ ও সংযুক্ত নৌপথ খনন এবং টার্মিনালসহ আনুষঙ্গিক স্থাপনাদি নির্মাণ) (প্রথম সংশোধিত) প্রকল্প পরামর্শক খাতে খরচ করা হচ্ছে ২৭৬ কোটি ৫২ লাখ টাকা। বিশ্বব্যাংকের ঋণে ‘ওয়েস্টার্ন ইকোনমিক করিডোর অ্যান্ড রিজিওনাল এনহ্যান্সমেন্ট প্রোগ্রাম (উইকেয়ার) ফেজ-১ : রুরাল কানেক্টিভিটি, মার্কেট অ্যান্ড লজিস্টিক ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইম্প্রুভমেন্ট প্রজেক্টে’ (আরসিএমএলআইআইপি) পরামর্শক খাতে খরচ হচ্ছে ৯৯ কোটি ৩৫ লাখ ৩১ হাজার টাকা। আইডিএ ঋণে এক্সিলারেটিং অ্যান্ড স্ট্রেনদেনিং স্কিল ফর ইকোনমিক ট্রান্সফরমেশন প্রকল্পটিতে পরামর্শকের জন্য ব্যয় হচ্ছে ১৪৩ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। এআইআইবি ঋণে ময়মনসিংহের কেওয়াটখালী সেতু নির্মাণে পরামর্শকের জন্য ব্যয় হচ্ছে ৫৯ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। ঢাকা এনভায়রনমেন্টালি সাসটেইনেবল ওয়াটার সাপ্লাই প্রকল্পে পরামর্শকের জন্য ব্যয় হবে ২২৯ কোটি টাকা। ‘খুলনা পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা উন্নয়ন’ প্রকল্পে পরামর্শক খাতে ব্যয় হচ্ছে ৯৯ কোটি ১৩ লাখ ৮৫ হাজার টাকা।
পরামর্শ ব্যয় নিয়ে জানতে চাইলে সাবেক পরিকল্পনা সচিব মামুন-আল-রশীদ প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘উন্নয়ন সহযোগীরা আমাদের বললেই যে পরামর্শক নিতে হবে এমন কোনো কথা নেই। আমরা যদি যুক্তি দিয়ে দেখাতে পারি তাহলে এটা আরও কম হবে। কিছু কিছু প্রকল্পে সূক্ষ্ম কারিগরি বিষয় আছে। যেমনÑ মেট্রোরেল প্রকল্প। যেখানে পরামর্শক ব্যয় একটু বেশি প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু এমন অনেক প্রকল্প আছে যেখানে দুই শতাংশই যথেষ্ট। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের প্রথম থেকেই এ খাতে কম ব্যয় যেন হয় সেটা নিশ্চিত করা উচিত।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের দেশেরই কিছু লোক আছে যারা সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করে কিছু লোককে পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার সুযোগ তৈরি করার জন্য। পরামর্শক নেওয়ার জন্য উন্নয়ন সহযোগী যদি চাপ প্রয়োগ করে তাহলে তাকে বোঝাতে হবে কী কারণে আমাদের পরামর্শক প্রয়োজন নেই। তবে আমরা অনেক ক্ষেত্রেই ওগুলো বিশ্লেষণ করে দেখছি না, এটার প্রয়োজনীয়তাটা কী, নিয়মিত যে কর্মকাণ্ড আছে, প্রকৌশলী আছে তারা করতে পারবে কি না সেটা আগে পরীক্ষা করে দেখা উচিত। তাহলে উন্নয়ন সহযোগীরা চাপ প্রয়োগ করতে পারবে না।’
বিদেশি ঋণের প্রকল্পে পরামর্শকের অতিরিক্ত ব্যয় নিয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘মূলত বড় প্রকল্পগুলোতেই বিদেশি সংস্থাগুলো বিনিয়োগ করে। অনেক টেকনিক্যাল বিষয় থাকে, যেখানে পরামর্শক লাগে। তবে পরামর্শক লাগবে কি না সেটা নির্ভর করে প্রকল্পের প্রয়োজনের ওপর।
যেসব প্রকল্প আমরা অহরহ করছি সেগুলোতেও কেন পরামর্শক লাগে, সেটাই প্রশ্ন। প্রয়োজন না থাকলেও অনেক সময় পরামর্শক রাখা হয়। এটা কেন বা কার স্বার্থে রাখা হয়, সেটাই প্রশ্ন। দেখা যাচ্ছে কিছু প্রকল্পে এমন কাউকে পরামর্শক রাখা হচ্ছে, যাদের সে সম্পর্কে বিন্দুমাত্র যোগ্যতাও নেই।’