প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২৯ অক্টোবর ২০২৪ ২১:২৪ পিএম
আপডেট : ২৯ অক্টোবর ২০২৪ ২২:০৪ পিএম
অব্যবস্থাপনা আর ভুল নীতির কারণে দেশের রপ্তানি খাতে দীর্ঘদিন চলছে ভঙ্গুর দশা। কিন্তু এর প্রকৃত চিত্র আড়াল করে রপ্তানি খাতে ব্যাপক সাফল্য দেখিয়ে আসছিল আওয়ামী লীগ সরকার। নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে এবং বিভিন্ন সূচকে কারসাজি করতে এমন আত্মঘাতী কাজে লিপ্ত ছিল বিগত সরকার। তবে বর্তমানে প্রকৃত হিসাব তুলে আনার পর রপ্তানি খাতের আয়ে বড় পতন দেখা দিয়েছে। দেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি আয়ের উৎস তৈরি পোশাক খাতেই বড় ধস নেমেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিক বা এপ্রিল-জুন সময়ে রেডিমেড গার্মেন্টস (আরএমজি) থেকে মোট রপ্তানি আয় দাঁড়িয়েছে ৮৮৩ কোটি ৭১ লাখ ডলার; যা আগের প্রান্তিক বা জানুয়ারি-মার্চ সময়ে আসা রপ্তানি আয়ের তুলনায় ৩৬ দশমিক ০২ শতাংশ কম। এতদিন এসব হিসাব ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানো হতো।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, অর্থনৈতিক টানাপড়েনে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ (ইইউ) পশ্চিমা দেশগুলোতে। ব্যয় সংকোচনের অংশ হিসেবে পোশাক কেনা কমিয়েছে ওইসব দেশের নাগরিকরা। এই দেশগুলো বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির বড় বাজার হওয়ায় রপ্তানির নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে পুরো খাতে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে বাংলাদেশের আরএমজি রপ্তানির শীর্ষ গন্তব্য ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, স্পেন, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, ইতালি, কানাডা ও বেলজিয়াম। এই ৯টি দেশ থেকে বাংলাদেশ আরএমজি থেকে ৬৩৫ কোটি ৯২ লাখ মার্কিন ডলার আয় করেছে, যা মোট আরএমজি রপ্তানির ৭১ দশমিক ৯৭ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, তৈরি পোশাকের নিট রপ্তানি (আরএমজি রপ্তানি মূল্য থেকে কাঁচামাল আমদানি মূল্য বিয়োগ করে নির্ধারিত) ছিল ৫০৪ কোটি ডলার বা মোট আরএমজি রপ্তানির ৫৭ শতাংশ।
চলতি অর্থবছরের এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে যে আয় দেশে এসেছে, এর মধ্যে নিটওয়্যার এগিয়ে আছে। আলোচ্য সময়ে নিটওয়্যার থেকে রপ্তানি আয় এসেছে ৪৭৪ কোটি ৭৯ লাখ ডলার। অপরদিকে, ওভেন থেকে রপ্তানি আয় এসেছে ৪০৮ কোটি ৯১ লাখ ডলার। গত সোমবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে তৈরি পোশাক খাতের জন্য কাঁচামাল আমদানি করা হয়েছে ৩৭৯ কোটি ৬৮ লাখ ডলারের। এ সময় রপ্তানি করা হয়েছে ৮৮৩ কোটি ৭১ লাখ ডলারের পোশাক। অর্থাৎ আলোচ্য সময়ে তৈরি পোশাক খাতের কাঁচামাল আমদানি বাদ দিয়ে নিট রপ্তানি আয় হয়েছে ৫০৪ কোটি ২ লাখ ডলার। জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে নিট রপ্তানি আয়ের পরিমাণ ছিল ৫৮৯ কোটি ২৩ লাখ ডলার। আলোচ্য সময়ের ব্যবধানে নিট রপ্তানির পরিমাণও কমেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তৈরি পোশাক খাতের রপ্তানি আয় বাড়াতে সরকার নানা সুবিধা দিয়ে আসছে। এর মধ্যে রয়েছে প্রি-শিপমেন্ট ক্রেডিট সুবিধা। করোনা-পরবর্তী সময়ে রপ্তানি ঋণ সহায়তা দেওয়ার লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ৫ হাজার কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন তহবিল গঠন করে। এ তহবিল থেকে তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের জন্য ঋণ সুবিধাসহ সুদহার সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখা হয়েছে, যা ২০২৭ সাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। এ ছাড়া, তৈরি পোশাক রপ্তানি বাড়াতে রপ্তানির ওপর ৪ শতাংশ হারে নগদ সহায়তার সুবিধা দেয় সরকার। একই সঙ্গে রয়েছে ২ শতাংশ হারে বিশেষ নগদ সহায়তা।
রপ্তানিকারকদের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ৫ হাজার কোটি টাকার গ্রিন ট্রান্সফরমেশন ফান্ড রয়েছে, যা থেকে রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানগুলো ক্যাপিটাল মেশিনারিজ আমদানির জন্য অর্থায়ন করে। এ ছাড়াও আছে ১০ হাজার কোটি টাকার এক্সপোর্ট ফ্যাসিলিটেশন ফান্ড এবং এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ড। এসব সুযোগ-সুবিধা নিয়ে দেশের তৈরি পোশাক খাত দিনদিন রপ্তানি আয়ের ক্ষেত্রে শক্তিশালী খাত হিসেবে গড়ে উঠেছে। এর মধ্যেই চলতি অর্থবছরের এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে আগের প্রান্তিকের চেয়ে তৈরি পোশাক খাতে রপ্তানি আয় কমেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা জানান, এতদিন দেশের রপ্তানি আয়ে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি দেখিয়ে আসছিল সরকারি সংস্থা রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)। কিন্তু দেশের প্রকৃত রপ্তানি কত, তা নিয়ে গত কয়েক বছর ধরেই প্রশ্ন তুলে আসছেন ব্যবসায়ীসহ অর্থনীতি বিশেষজ্ঞরা। ইপিবি রপ্তানির যে হিসাব প্রকাশ করছে দেশে অর্থ আসছে তার চেয়ে অনেক কম। গত কয়েক বছরে পার্থক্য বেড়েই চলেছে। ইপিবি গত এপ্রিল পর্যন্ত আগের ১০ মাসে পণ্য জাহাজীকরণের ভিত্তিতে রপ্তানির যে তথ্য প্রকাশ করেছিল, প্রকৃত রপ্তানি তার চেয়ে প্রায় ১৪ বিলিয়ন ডলার কম। রপ্তানি আয় বেশি দেখানোয় বাণিজ্য ভারসাম্যের সঠিক হিসাবও পাওয়া যাচ্ছিল না। এর পরিপ্রেক্ষিতে ইপিবির পরিবর্তে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) রপ্তানি আয়ের হিসাব গ্রহণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গৃহীত হিসাবকেই প্রকৃত তথ্য হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।