হুমায়ুন মাসুদ, চট্টগ্রাম
প্রকাশ : ২৩ অক্টোবর ২০২৪ ২২:০৯ পিএম
আপডেট : ২৩ অক্টোবর ২০২৪ ২২:৩২ পিএম
ছয় দিন আগে ১৭ অক্টোবর চট্টগ্রাম নগরীর হালিশহর থানাধীন
রমনা আবাসিক এলাকার একটি ভবনে অভিযান চালিয়ে সাড়ে তিন লাখ স্ট্যাম্পসহ নকল সিগারেট
তৈরির বিভিন্ন উপকরণ জব্দ কুরে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। সংস্থাটির কর্মকর্তাদের
ধারণা, ওই দিন সেখানে সিগারেটের যেসব সরঞ্জাম পাওয়া গেছে, সেগুলো দিয়ে বেনসন, ব্ল্যাক,
ওরিস, ইজি লাইটসহ বিভিন্ন বিদেশি ব্র্যান্ডের নকল সিগারেট বানানো হতো।
এ থেকে প্রমাণিত হয়, বাজারে যেসব বিদেশি সিগারেট পাওয়া
যায় তার কিছু অংশ এভাবে দেশে তৈরি করে বাজারে ছাড়ছে একটি চক্র। কারণ বাজারে যে পরিমাণ
বিদেশি সিগারেট পাওয়া যায়, সেই পরিমাণ বিদেশি সিগারেট আমদানির তথ্য নেই জাতীয় রাজস্ব
বোর্ডের (এনবিআর) কাছে। তার মানে বাজারে যেসব বিদেশি সিগারেট পাওয়া যাচ্ছে তার বেশিরভাগই
আসছে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে।
শুধু এভাবে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে বিদেশি সিগারেট বাজারে আসছে
তা নয়। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস এবং শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের
সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আরও তিন মাধ্যমে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে বাজারে আসছে বিদেশি সিগারেট।
এর মধ্যে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে সবচেয়ে বেশি বিদেশি সিগারেট আসছে মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানির
মাধ্যমে। কারণ মাঝে মাঝে অন্য পণ্যের নাম দিয়ে আমদানি করা পণ্যের কন্টেইনার খুলে তাতে
মিলছে বিদেশি সিগারেট। এর বাইরে ব্যাগেজ রুলসের আওতায় বিমানযাত্রীদের মাধ্যমে এবং বিদেশি
জাহাজের নাবিকদের কাছ থেকে কম দামে কিনে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে বাজারে আসছে বিদেশি সিগারেট।
আর তাতে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।
কাস্টমস কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ১০০ টাকা সমমূল্যের বিদেশি সিগারেটে শুল্ক
কর পরিশোধ করতে হয় ৫৯৬ টাকা। এ হিসাবে কেউ অবৈধভাবে এক কোটি টাকার বিদেশি সিগারেট বাজারজাত
করতে পারলে সরকার রাজস্ব হারায় প্রায় ৬ কোটি টাকা।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে অক্সফোর্ড ইকোনমিকসের এক গবেষণায়
বলা হয়েছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশে অবৈধ সিগারেটের ব্যবহার বা ভোগের পরিমাণ ২০১৫-১৬
অর্থবছরের চেয়ে পাঁচগুণ বেড়েছে। এর ফলে সরকারের রাজস্ব ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৮০০ কোটি
টাকা।
বিদেশি সিগারেট আমদানিতে শুল্ক-কর ৬০০ শতাংশের কাছাকাছি
হওয়ায় ঘোষণা দিয়ে বিদেশি সিগারেট আমদানি খুব একটা হয় না। কিন্তু চট্টগ্রাম নগরীর রিয়াজউদ্দিন
বাজারসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় দোকানপাট, রাস্তার ধারের স্টলে মিলছে বিদেশি সিগারেট।
এমনকি গ্রামগঞ্জের বাজারেও পাওয়া যাচ্ছে। যার অধিকাংশই আসছে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে আমদানির
মাধ্যমে। মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে আমদানি করা সিগারেটের খুব সামান্য অংশ ধরা পড়লেও কাস্টমস
কর্মকর্তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে অধিকাংশ বিদেশি সিগারেট চলে যাচ্ছে খুচরা বাজারে। সর্বশেষ
গত ২৭ জুন মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে থাইল্যান্ড থেকে আনা ৫০ লাখ শলাকা মন্ড ব্র্যান্ডের সিগারেট
জব্দ করেন কাস্টমস কর্মকর্তারা। ঢাকার হ্যামকো করপোরেশনের নামে আমদানি করা ওই চালানটিতে
পাওয়া সিগারেটগুলোর বাজারমূল্য ছিল ৫ কোটি টাকা। কিন্তু সেখানে রাজস্ব ফাঁকির পরিমাণ
ছিল প্রায় ৩০ কোটি টাকা।
এনবিআরের সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেলের (সিআইসি) এবং
কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের (সিআইআইডি) তথ্য অনুযায়ী, দেশের অবৈধ সিগারেট
বাণিজ্যের বৃহৎ অংশ নিয়ন্ত্রণ করে চট্টগ্রামভিত্তিক বিজয় ইন্টারন্যাশনাল টোব্যাকো,
তারা ইন্টারন্যাশনাল টোব্যাকোসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। গত মে মাসে কক্সবাজার জেলার চকরিয়ায়
অভিযান চালিয়ে প্রতিষ্ঠান দুটির নকল সিগারেট কারখানার সন্ধান পাওয়া যায়। এরপর
গত ১৭ অক্টোবর চট্টগ্রাম নগরীর হালিশহর থানাধীন রমনা আবাসিক এলাকার একটি বাসায় অভিযান
চালিয়ে ওই ভবনের নিচতলার দুটি কক্ষ থেকে ৩ কোটি ৩৭ লাখ ৫০ হাজার পিস সিগারেটের স্ট্যাম্প,
স্ট্যাম্প তৈরির ১৪৮টি সাদা বড় রোল, ৪২৫টি সাদা ছোট রোল, ১২৬টি কালো বড় রোল, ১ হাজার
৩৭টি কালো ছোট রোল এবং একটি ভিভিআর মেশিন জব্দ করে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর।
এই ঘটনার সঙ্গেও প্রতিষ্ঠান দুটির মালিকের সম্পৃক্ততা থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এর বাইরে ব্যাগেজ রুলসের আওতায় আনা হচ্ছে বিদেশি সিগারেট।
ব্যাগেজ বিধির আওতায় একজন এয়ার ট্রাভেলার বাংলাদেশে এক কার্টন (২০০ শলাকা) সিগারেট
আনতে পারে। বিদেশ থেকে আসা অনেক যাত্রী এভাবে সিগারেট এনে খোলাবাজারে বিক্রি করে
দিচ্ছে। আবার অনেকে ২০০ শলাকা আনার অনুমোদনকে কাজে লাগিয়ে অনেক বেশি সিগারেট নিয়ে আসছে।
সর্বশেষ গত ২৭ ফেব্রুয়ারি শারজাহ থেকে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে আসা এয়ার অ্যারাবিয়ার
দুই যাত্রীর কাছ থেকে ৭৩৫ কার্টন বিদেশি সিগারেট জব্দ করেছে কাস্টমস কর্মকর্তারা।
এ সর্ম্পকে জানতে চাইলে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের
যুগ্ম পরিচালক মো. সাইফুর রহমান প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘অবৈধ সিগারেট বাণিজ্যের
মাধ্যমে শুল্ক ফাঁকির বিষয়টি তদন্ত করার জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে একটি তদন্ত কমিটি
গঠন করা হয়েছে। ওই কমিটি অবৈধ সিগারেট কীভাবে বাজারজাত হচ্ছে, এর সঙ্গে কারা জড়িত সেগুলো
অনুসন্ধান করছে। তদন্তকাজ খুব শিগগিরই শেষ হবে। তখন এ বিষয়ে বিস্তারিত আপনাদের জানাতে
পারব। তবে প্রাথমিকভাবে আমাদের কাছে যে তথ্য আছে তাতে চারটি মাধ্যমে বাজারে বিদেশি
সিগারেট বাজারজাত হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের কাছে তথ্য আছে কিছু অসাধু চক্র
দেশের অভ্যন্তরে নকল বিদেশি সিগারেট তৈরি করে বাজারে ছাড়ছে। আবার কেউ কেউ অন্য পণ্যের
নাম দিয়ে বিদেশি সিগারেট নিয়ে আসছে। কয়েক দিন আগেও আমরা এ ধরনের একটি চালান আটক করেছি।
আবার বিমানযাত্রীরা ব্যাগেজ রুলসের আওতায় এনে খোলাবাজারে বিক্রি করে দিচ্ছে। আমাদের
কাছে আরেকটি তথ্য আছে চট্টগ্রাম বন্দরের অভ্যন্তরে যেসব বিদেশি জাহাজ আসে, ওই জাহাজগুলো
থেকে বিদেশি সিগারেট সংগ্রহ করে সেগুলো বাজারে সরবরাহ করা হচ্ছে।’