আরমান হেকিম
প্রকাশ : ১৪ অক্টোবর ২০২৪ ১১:০৪ এএম
আপডেট : ১৪ অক্টোবর ২০২৪ ১১:২২ এএম
বেকারত্ব কমাতে কারিগরি শিক্ষা সম্প্রসারণের মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টি করতে বেশ কয়েকটি প্রকল্প নেওয়া হলেও নানা জটিলতায় থমকে রয়েছে কারিগরির উন্নয়ন। অধিকাংশ প্রকল্পেই ভুমি অধিগ্রহণ ছাড়া তেমন কাজই হয়নি। ফলে কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমে সরকারের দক্ষ জনশক্তি তৈরির উদ্যোগ পিছিয়ে যাচ্ছে। ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশ জনশক্তিকে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত করার লক্ষ্য পূরণ নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এদিকে প্রকল্পগুলোতে ধীরগতির পেছনে প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের অদক্ষতা আর অবহেলায় দায়ী বলে মনে করছেন অনেকে।
পরিকল্পনা কমিশনের একাধিক কর্মকর্তা জানান, কারিগরি অধিকাংশ প্রকল্পই পরিকল্পনা অনুযায়ী এগোচ্ছে না। যার বড় কারণ অনেকের প্রকল্প সম্পর্কে জ্ঞান ও দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে। বেশিরভাগ প্রকল্পেই জমি অধিগ্রহণ জটিলতা আছে। দেখা যায়, প্রতিবছর বড় বরাদ্দ নিয়েও তারা খরচ করতে পারে না।
কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, কারিগরি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে নেওয়া ২৩টি জেলায় পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট স্থাপন ২০১৮ সালে ৩ হাজার ৬৯১ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প হাতে নেয় কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ না হওয়ায় এক বছর সময় বাড়িয়ে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়। কিন্তু বর্ধিত সময়ের মধ্যেও কাজ শেষ না হওয়ায় আরও তিন বছর বাড়িয়ে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়। এতে তিন বছরের প্রকল্প গিয়ে ঠেকেছে ৭ বছরে। কিন্তু প্রকল্পের কাজের যে অগ্রগতি তাতে সংশোধিত মেয়াদেও কাজ শেষ না হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
আলোচ্য প্রকল্পের আওতায় দেশের ৮ বিভাগের ২৩টি জেলায় পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট স্থাপনের কথা ছিল। কিন্তু তিন বছরের প্রকল্পে ৬ বছর পেরিয়ে গেলেও ভূমি অধিগ্রহণের কাজ শেষ হয়নি। এখন পর্যন্ত ১৬টি জেলায় শুধু ভুমি অধিগ্রহণের কাজ হয়েছে। বাকি ৭টি জেলায় এখনো ভুমি অধিগ্রহণের কাজই শুরু হয়নি। ১৬টি পলিটেকনিকের জন্য ভুমি অধিগ্রহণ হলেও অধিকাংশের ভূমি উন্নয়নের কাজই শেষ হয়নি। এমনকি ৫টি জেলার পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের নির্ধারিত স্থানে ভূমি উন্নয়ন কাজ এখনও শুরু হয়নি। বাকি যেগুলোর উন্নয়ন কাজ শুরু হয়েছে তাদের অগগ্রতিও খুবই কম। কোনোটিরই ভূমি উন্নয়নের কাজ শতভাগ শেষ হয়নি।
পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) নিবিড় পরিবীক্ষণ প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে এসব তথ্য। আইএমইডির প্রতিবেদনে ধীরগতির বিষয়ে বলা হয়েছে, নির্ধারিত সময়ে ভূমি অধিগ্রহণ করতে না পারার কারণে প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব হচ্ছে। প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণ শেষ না হওয়ায় এখনো শুরু করা যায়নি পূর্ত ও ক্রয় কাজ।
একই চিত্র কারিগরির ৩২৯টি উপজেলায় টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ স্থাপন প্রকল্পেও। প্রকল্পটির সাড়ে তিন বছর পেরোলেও মাত্র ১২টির জমি অধিগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। এছাড়া কোন কাজ হয়নি। এ বিষয়ে প্রকল্পটির পরিচালক ড. মশিউর রহমান বলেন, এ পর্যন্ত ১২টির ভুমি অধিগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। ৬টির ভুমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া প্রায় শেষ পর্যায়ে।
চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী ও রংপুর চার বিভাগে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ স্থাপনের প্রকল্পেও একই দশা। তিন বছরের প্রকল্পটিতে ভুমি অধিগ্রহণেই লেগেছে ৫ বছর। ৬ বছরে প্রকল্পটির অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ১৫ শতাংশ। ব্যয় হয়েছে ৮৬ কোটি টাকা। প্রতি বছর বড় ধরনের বরাদ্দ দিলেও খরচ করতে পারছে না প্রকল্প কতৃপক্ষ।
এ বিষয়ে প্রকল্পটির পরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ ফয়সাল মুফতী বলেন, ‘আমাদের সবগুলোর জমি অধিগ্রহণের কাজ শেষ হয়েছে। বর্তমানে প্রশাসনিক ভবনের বেজমেন্টের কাজ চলছে।
একই অবস্থা সিলেট, বরিশাল, ময়মনসিংহ ও রংপুর বিভাগীয় শহরে ৪টি মহিলা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট স্থাপন প্রকল্পে। ৬ বছরে প্রকল্পটির অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ৩০ শতাংশ।’
তিনি বলেন, ‘১০০টি উপজেলায় একটি টেকনিক্যাল স্কুল স্থাপন প্রকল্পের ১০ বছরে প্রায় ৭৬ শতাংশ কাজ হয়েছে বলে জানা গেছে। বেশকিছু ভবনের কাজ পুরোপুরি শেষ না হলেও শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। নারায়নগঞ্জ টেকনিক্যাল স্কুলের কাজ সম্প্রতি শুরু হয়েছে।’
তবে প্রকল্পটির পরিচালক আবুল কাশেম মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘সারাদেশে কাজ করতে হলে একটু সময় লাগবে। তারপরও আমার মনে হয় কাজের অগ্রগতি ভালো। প্রায় ৮০ শতাংশ কাজ হয়ে গেছে।’
সার্বিক প্রকল্পের অগ্রগতিতে বেহাল দশার পেছনে জমি অধিগ্রহণই বড় সমস্যা কি না জানতে চাইলে কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আজিজ তাহের খান বলেন, প্রকল্পের অগ্রগতি কম হওয়ার পেছনে জমি অধিগ্রহণই প্রধান সমস্যা বলা যাবে না। একেক জায়গায় একেক সমস্যা থাকতে পারে। জমি অধিগ্রহণে অর্থছাড় বন্ধ থাকলে কাজের কিছুটা ব্যাঘাত ঘটবে এটা স্বাভাবিক বলে তিনি উল্লেখ করেন। তবে প্রকল্প বাস্তবায়ন আরও গতিশীল করতে কাজ চলছে বলে জানান তিনি।
কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হলে নারী ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন জনগোষ্ঠীর কারিগরি শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি হবে, কারিগরি বিষয়ে দক্ষ জনবল তৈরী এবং কারিগরি শিক্ষা সম্প্রসারণের ফলে বেকারত্ব কমার পাশাপাশি দেশ ও বিদেশে আত্ন-কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে।
উল্লেখ্য, সরকারের ২০২০ সালের মধ্যে কারিগরি শিক্ষার হার ২০ শতাংশে উন্নীত করার ঘোষণা দিয়েছিল। তবে পরিকল্পনা অনুয়ায়ী কাজ না হওয়ায় সরকারের সে টার্গেট অর্জিত হয়নি। বর্তমানে কারিগরি শিক্ষার হার ১৭ শতাংশ। সরকার কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিতের হার ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশ এবং ২০৪০ সালের মধ্যে ৫০ শতাংশে উন্নীত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী চলমান উদ্যোগগুলো সফল না হলে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্টের সুবিধা হারাবে বাংলাদেশ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কর্মসংস্থান সম্প্রসারণের স্বার্থেই কারিগরি শিক্ষাকে শিক্ষার মূলধারায় পরিণত করা এখন সময়ের দাবি। এর জন্য শিক্ষা ব্যবস্থার গুণগত পরিবর্তন ও উন্নয়ন দরকার। দেশে একের পর এক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা প্রচুর অর্থ ব্যয় করে উচ্চতর ডিগ্রি নিচ্ছেন। কিন্তু নিশ্চিত হচ্ছে না তাদের কর্মসংস্থান। তাই কারিগরি শিক্ষার বিকাশ এবং এ শিক্ষাসংশ্লিষ্ট কর্মমুখী খাতে সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি জরুরি হয়ে পড়েছে।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল মান্নান বলেন, ‘আমাদের কারিগরি শিক্ষায় আরও গুরুত্ব দেওয়া উচিত। কর্মমূখী শিক্ষা না থাকায় অনেকেই লেখাপড়া শেষ করেও চাকরি পাচ্ছেন না। অথচ যারা কারিগরি শিক্ষা গ্রহণ করছে তারা বসে থাকছে না।’