কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন
প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১৪ অক্টোবর ২০২৪ ১০:৪৫ এএম
আপডেট : ১৪ অক্টোবর ২০২৪ ১০:৫২ এএম
বাংলাদেশ ব্যাংক। ছবি : সংগৃহীত
উচ্চ সুদের কষাঘাতে পিষ্ট ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা। বড় ব্যবসায়ীদেরও হাঁসফাঁস অবস্থা। অতি জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ ব্যাংক ঋণে আগ্রহী হচ্ছেন না। আবার কেউ কেউ প্রকল্প কাটছাঁটসহ নানা উপায়ে বিনিয়োগ কমাচ্ছেন। সব মিলিয়ে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবাহে বড় ধস নেমেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের আগস্ট মাসে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি কমে ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা ১১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর আগে গত বছরের সেপ্টেম্বরে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ। আবার চলতি বছরের জুলাইয়ে প্রবৃদ্ধি ছিল ১০ দশমিক ১৩ শতাংশ। সেই অনুযায়ী প্রবৃদ্ধি ২৭ বেসিস পয়েন্ট কমেছে।
খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, সরকার পতনের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গত জুলাই-অগাস্ট মাসে অস্থির ছিল শিল্প ও বাণিজ্য খাত। এর প্রভাব পড়েছে দেশের আমদানিতে। আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খোলা কমে যাওয়ায় বেসরকারি খাতের ঋণের চাহিদা তেমন ছিল না। তাই আগস্টে প্রবৃদ্ধি কমেছে। এছাড়া সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ও ঋণের সুদহার বেড়ে যাওয়ায় প্রবৃদ্ধি কমেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে পণ্য আমদানির এলসি খোলা ও নিষ্পত্তি উভয়ই কমেছে প্রায় ১৩ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, গত জুলাই ও অগাস্টে ১০ দশমিক শূন্য ৩ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানির এলসি খোলা হয়েছে, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ১ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার কম। যা ১২ দশমিক ৮৫ শতাংশ কম। ওই বছরের জুলাই-অগাস্টে এলসি খোলা হয়েছিল ১১ দশমিক ৫১ বিলিয়ন ডলার।
দেশে বিনিয়োগ পরিস্থিতি বোঝার অন্যতম একটি সূচক হলো মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি প্রবাহ। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানির এলসি খোলা কমেছে প্রায় ৪৪ শতাংশ। বছরের নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে পণ্য আমদানির এলসি খোলা কমার কারণ হিসেবে রাজনৈতিক অস্থিরতাকে কারণ বলে মনে করছেন মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, ‘দুই কারণে আমদানির এলসি খোলা কমেছে। প্রথমত, সম্প্রতি দেশে ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে। তখন যোগাযোগ ব্যবস্থায় ব্যাঘাত ঘটেছে। আবার সেসময় ব্যাংকও বন্ধ ছিল। তাতে আমদানি-রপ্তানি প্রক্রিয়া সরাসরি বাধাগ্রস্ত হয়েছে। ইন্টারনেট বন্ধ থাকার কারণেও সারাদেশে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, ফলে সরাসরি আমদানিতে প্রভাব পড়েছে। তখন বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদা কম ছিল। তাই আগস্টে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি কমেছে।’
এলসি কমার দ্বিতীয় কারণ হিসেবে বিনিয়োগকারীদের পিছুটান দেওয়ার কথা বলছেন এ ব্যাংকার। তিনি বলেন, ‘আগের মত তারা বিনিয়োগ করছেন না, তাতে আমদানি কমেছে। এটা কমে যাওয়ার কারণ ডলার দরে অস্থিতিশীলতা। তবে এখন ডলার দরে স্থিতিশীলতা আসছে। এটা বজায় থাকলে আবার বিনিয়োগ বাড়বে। তখন বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধিও বাড়বে।’
এদিকে দেশে কয়েক বছর ধরে চলছে উচ্চ মূল্যষ্ফীতি। অর্থের জোগান কমিয়ে এই মূল্যষ্ফীতির লাগাম টানতে চাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি বছরই পাঁচ দফা বাড়ানো হয়েছে নীতি সুদহার। এর প্রভাবে একদিকে গ্রাহক পর্যায়ে ঋণের খরচ বাড়ছে, অন্যদিকে বেসরকারি খাতে কমছে ঋণপ্রবাহ। ফলে চাপে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। সুদহার বাড়ার বিরূপ প্রভাব পড়ছে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগে।
এক বছর আগে ব্যাংক ঋণে সর্বোচ্চ সুদহার ছিল ৯ শতাংশ। এখন তা বেড়ে কোনো কোনো ব্যাংকে সাড়ে ১৪ শতাংশ হয়েছে। সব ব্যাংকের ঋণের গড় সুদহারও ক্রমশ বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২০ সালের জুলাইয়ে ব্যাংক ঋণের গড় সুদহার ছিল ৭ দশমিক ৭৯ শতাংশ। চলতি বছরের জুলাইয়ে তা বেড়ে হয়েছে ১১ দশমিক ৫৭ শতাংশ।
মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৯ দশমিক ৮০ শতাংশ নির্ধারণ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। প্রতিষ্ঠানটি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথমার্ধের মুদ্রানীতিতে এই ঘোষণা দিয়েছে। গত অর্থবছরের জুন পর্যন্ত প্রকৃত প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছিল ৯ দশমিক ৮০ শতাংশে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, ‘বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়াতে হলে অবশ্যই সরকারকে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ গ্রহণ কমাতে হবে।’
ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারি ঋণ গ্রহণের পরিমাণ সীমিত করার বিষয়ে সরকারকে অনুরোধ করা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘মূল্যষ্ফীতি ছয় থেকে সাত মাসের মধ্যে সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনা সম্ভব হলে নীতি সুদহার, ব্যাংকঋণের সুদহারসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব পরিলক্ষিত হবে।’