আরমান হেকিম
প্রকাশ : ০২ অক্টোবর ২০২৪ ২২:০৬ পিএম
আপডেট : ০২ অক্টোবর ২০২৪ ২২:৩৭ পিএম
রাজনৈতিক বিবেচনায় বহু প্রকল্প গ্রহণ করা হয় বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। যেগুলো দেশের অর্থনীতিতে খুব একটা অবদান না রাখলেও ঋণের চাপ বাড়াতে সহায়তা করেছে। এমন সব অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পে অর্থছাড় কমিয়ে দিয়েছে সরকার। যার প্রভাব পড়েছে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম দুই মাস জুলাই ও আগস্টে ৬ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন অর্থছাড় হয়েছে। যার প্রভাবে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন হার এক যুগের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে চলে গেছে। অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাদ দেওয়ার চিন্তা-ভাবনাও করছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। যার ফলে এডিপির আকারও এক লাখ কোটি টাকা কমে যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীন বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) জুলাই-আগস্টের এডিপি বাস্তবায়ন অগ্রগতির প্রতিবেদনের তথ্য বলছে,
দুই মাসে এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে ২ দশমিক ৫৭ শতাংশ। এর চেয়ে কম এডিপি বাস্তবায়নের তথ্য সংস্থাটির ওয়েবসাইটে নেই। সেই আলোকে গত এক যুগে এত কম এডিপি বাস্তবায়ন হয়নি। এ সময় অর্থছাড় হয়েছে ৭ হাজার ১৪৩ কোটি টাকা; যা ২০১৮-১৯ অর্থবছরের পর সর্বনিম্ন। গত অর্থবছরে ১০ হাজার ৫৪১ কোটি টাকা ছাড় হয়েছিল এ সময়ে। শুধু আগস্ট মাসে অর্থছাড় হয়েছে ৪ হাজার ২২০ কোটি টাকা। যেখানে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের আগস্টে ছাড় হয়েছিল ৭ হাজার ৫২ কোটি টাকা।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের এডিপি থেকে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা কাটছাঁট হতে পারে। তাই বেশি প্রয়োজনীয় প্রকল্পগুলোতে অর্থছাড় করা হচ্ছে। প্রকল্পের অগ্রাধিকার যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের এডিপির আকার ধরা হয় ২ লাখ ৭৮ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা।
এডিপি বাস্তবায়ন কম হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে আইএমইডি সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থছাড় কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। কোন প্রকল্পটি বেশি প্রয়োজনীয়, কোনটির প্রয়োজনীয়তা কমÑ তা যাচাই-বাছাই চলছে। প্রকল্পগুলো পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা বলছেন, এডিপির বাস্তবায়ন বর্তমানে শুরুর পর্যায়ে রয়েছে। এক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় বাদ দিয়ে এডিপি বড় ধরনের কাটছাঁট করলে তেমন কোনো অর্থের অপচয় হবে না। চলতি অর্থবছরে এডিপির আওতায় ১ হাজার ৩২৬টি প্রকল্প আছে। এর মধ্যে অনেকগুলো ২০২৩ সালে অন্তর্ভুক্ত হলেও এখন পর্যন্ত কোনো ব্যয় দেখা যায়নি।
যেমনÑ স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন ১০২টি প্রকল্পে চলতি অর্থবছরে ১৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৩০টি প্রকল্প নতুন হওয়ায় এখন পর্যন্ত কোনো খরচ হয়নি। তা ছাড়া গত নির্বাচনের আগে দুই শতাধিক প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। যার মধ্যে অনেক অপ্রয়োজনীয় ও কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প আছে। এসব প্রকল্পের জন্য এডিপিতে আলাদা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদও সম্প্রতি বলেছেন, মেগা প্রকল্পের বদলে জীবন-জীবিকা ও ব্যবসা-বাণিজ্য সচল রাখার প্রকল্পে গুরুত্ব দেওয়া হবে। বড় বা মেগা প্রকল্পের অর্থছাড় বড় হয়। তাই এ বিষয়ে পরে মিটিং করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। বাংলাদেশের অর্থ অপচয় বন্ধ করতে হবে। স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা ছাড়া কিছু চলবে না।
জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘রাজনৈতিক বা প্রশ্নবিদ্ধ প্রকল্পগুলো পুনরায় বিবেচনা করা উচিত। কারণ সরকার আর্থিক সংকটে আছে, রাজস্ব আদায়েও ঘাটতি রয়েছে। সরকারকে ব্যয় কমাতে হবে। ব্যয় কমানোর বড় জায়গা এডিপি। প্রকল্পের গুরুত্ব বিবেচনায় বরাদ্দ দিতে হবে। কারণ এ প্রকল্পের বাস্তবায়ন অনেক এগিয়েছে। যেসব মেগা প্রকল্পের অগ্রগতি ভালো সেগুলো শেষ করা ভালো হবে। তবে যেসব মেগা প্রকল্পের কাজ শুরু হয়নি বা প্রাথমিক ধাপে আছে সেগুলো বাদ দেওয়া ভালো হবে।’
চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে সবচেয়ে বেশি ১ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা অর্থ খরচ করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ। এর পর সর্বোচ্চ খরচ করেছে স্থানীয় সরকার বিভাগ ১ হাজার ৭৪২ কোটি টাকা। সড়ক মহাসড়ক বিভাগ খরচ করেছে ৫৭৮ কোটি টাকা। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা খরচ করছে ৪২৬ কোটি টাকা। ৮৮৫ কোটি টাকা খরচ করেছে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়।
অন্যদিকে এক টাকাও খরচ করতে পারেনি পাঁচটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ। এর মধ্যে রয়েছে, স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ, ভূমি মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আইন ও বিচার বিভাগ এবং জাতীয় সংসদ সচিবালয়।
আইএমইডির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের ১৩টি প্রকল্পের বিপরীতে এডিপিতে বরাদ্দ ছিল ৪ হাজার ৯৩৬ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। ভূমি মন্ত্রণালয়ের ৬টি প্রকল্পের বিপরীতে বরাদ্দ ছিল ৬৬৬ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। আইন ও বিচার বিভাগের ৪টি প্রকল্পের আওতায় বরাদ্দ ছিল ১৪৯ কোটি ১১ লাখ টাকা। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ৭টি প্রকল্পের বিপরীতে বরাদ্দ ছিল ১৪৩ কোটি ১৬ লাখ টাকা। এবং বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের ১টি প্রকল্পের আওতায় বরাদ্দ ছিল ১ কোটি ২৫ লাখ টাকা।
অন্যদিকে পাঁচ শতাংশের নিচে এডিপি বাস্তবায়ন করেছে ৪৪টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ। এই ক্যাটাগরিতে রয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়, সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ, লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগ, বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশন, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়, পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ, সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগসহ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় ও বিভাগ।