রেদওয়ানুল হক
প্রকাশ : ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ২২:৪৮ পিএম
আপডেট : ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ২২:৫০ পিএম
বালাদেশ ব্যাংক। ফাইল ফটো
তারল্য সংকটে ভূগছে দেশের বেশ কয়েকটি ব্যাংক। তারা গ্রাহকের চাহিদামতো আমানত ফেরত দিতে পারছে না। ফলে প্রতিদিনই এসব ব্যাংকের শাখায় ভীড় করছেন শত শত গ্রাহক। বিপাকে পড়েছেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা, যারা এসব ব্যাংকের হিসাবে থাকা বেতনের টাকা তুলতে পারছেন না। এছাড়া চিকিৎসা ও ভ্রমণসহ বিভিন্ন জরুরি প্রয়োজনে টাকা তুলতে না পেরে হতাশা জানিয়েছেন অনেক গ্রাহক।
তবে সংকট উত্তরণে তড়িৎ পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন নবনিযুক্ত চেয়ারম্যানরা। অগ্রাধিকারভিত্তিতে গ্রাহককে টাকা দেওয়ার নির্দেশনাও দেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে জরুরী প্রয়োজন ছাড়া টাকা না তোলার আহ্বান জানানো হয়েছে গ্রাহকদের প্রতি। কেননা ব্যাংকগুলো আগে থেকেই আমানতের তুলনায় বেশি পরিমাণে ঋণ দিয়ে রেখেছে। তাই নগদ টাকার অভাব দেখা দিয়েছে। আন্তঃব্যাংক এবং ডিজিটাল লেনদেন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আতঙ্কিত হয়ে শাখাগুলোতে ভিড় করছেন আমানতকারিরা।
সরেজমিন দেখা যায়, কঠিন পরিস্থিতিতে আছে মানুষ। বেসরকারি চাকরিজীবি শাকিল হকের বেতন জমা হয়েছে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের হিসাবে। মতিঝিল শাখায় বেতনের টাকা তুলতে গেলে তাকে বলা হয় ১০ হাজারের বেশি দেওয়া যাবে না। প্রতিদিনের বাংলাদেশকে তিনি বলেন, ‘আমার বেতনে ৫০ হাজার টাকা তুলতে ৫ দিন ব্যাংকে আসতে হবে। এটা খুবই কষ্টসাধ্য।’
তিনি বলেন, ‘আমার বসের বেতন আড়াই লাখ টাকা। বেতন তুলতে তাকে ব্যাংকে আসতে হবে ২৫ দিন। এর মধ্যে সাপ্তাহিক ছুটি ও সরকারি বন্ধ আছে। সব মিলিয়ে এক মাস যাবে শুধু বেতন তুলতে। এ টাকা তুলতে তুলতে অন্য মাসের বেতন হবে। অর্থাৎ প্রতিদিনই ব্যাংকে আসতে হবে বেতনের টাকা তুলতে। তাহলে মানুষ কাজ করবে কখন। এর দ্রুত সমাধান দরকার। এভাবে চলতে পারেনা। এভাবে ১০ হাজার টাকা দিয়ে কোন কাজই ঠিক মতো করা যায় না।’
বেতন হয়েছে কিন্তু বাসা ভাড়া দিতে পারেননি মিরপুরের রেজাউল করিম। কারণ তিনি টাকা তুলতে পারছেন না। অনেক কষ্টে বাড়িওয়ালাকে বলে কিছু দিন সময় নিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘বাড়িওয়ালা ও দোকানদার কোন মতে বুঝেছে। কিন্তু গৃহকর্মী, গৃহশিক্ষক, মা-বাবার জন্য মাসিক ভিত্তিতে টাকা পাঠানো ইত্যাদি জোগান দেওয়া খুবই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে।’
সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের চরফ্যাশন (ভোলা) শাখায় ১৬ লাখ টাকা আমানত করেছেন ব্যবসায়ী মিরাজ। তিনি জানতে পারেন ব্যাংকটিতে মালিকানা পরিবর্তন হয়ে গেছে। তাই আমানতের নিরাপত্তার অভাব বোধ করে তা উত্তোলনের জন্য ব্যাংকের শাখায় ছুটে যান। গত মঙ্গলবার শাখায় গিয়ে দেখেন অধিকাংশ কর্মকর্তা উপস্থিত নেই। কাউকেই টাকা দেওয়া হচ্ছে না। এতে তিনি আরও ভিত হয়ে পড়েন। অনেক মানুষ আমানত তুলে নেওয়ার জন্য শাখা ব্যবস্থাপককে খুঁজে বেড়াচ্ছেন। তবে কর্মকর্তারা সবাইকে এই বলে আশ্বস্ত করছেন যে, এক সপ্তাহের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তারল্য সহায়তা পাওয়া যাবে, তখন সবার টাকা ফেরত দেওয়া হবে।’
ব্যাংকাররা বলছেন, এক সঙ্গে সব গ্রাহক টাকা তুলতে আসলে পৃথিবীর কোন ব্যাংকই সব টাকা ফেরত দিতে পারবে না। কারণ গ্রাহকের টাকা নিয়ে ব্যাংক ঋণ দেয়। ঋণের অর্থ রাতারাতি ফেরত পাওয়া যায় না। তাই ব্যাংকের প্রধান সম্পদ হলো আস্থা। গ্রাহক আস্থা হারিয়ে ফেললে ওই ব্যাংক শেষ হয়ে যায়। তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্যাংকগুলোকে ঘুরে দাঁড়ানো সুযোগ দিতে হবে। যাদের দরকার নেই তারা যেন টাকা না তুলে। কারণ তিনি টাকা নিয়ে অন্য ব্যাংকে জমা দেবেন যাদের এই মুহুর্তে টাকা দরকার নেই। সংকটে থাকা ব্যাংকগুলো আবার ওই ব্যাংক থেকে ধার করবে। তাই সহজ সমাধান হলো অপ্রয়োজনে টাকা না তোলা। নতুন ব্যবস্থাপকদের কিছু দিন সময় দেওয়া।
সংকট কবে নাগাদ কাটবে জানতে চাইলে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আব্দুল মান্নান প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি দ্রুত সংকট কাটিয়ে উঠতে। দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে অনেক অব্যবস্থাপনা বন্ধ করেছি। পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি হচ্ছে। অনেক আমানতকারি, যারা টাকা তুলে নিয়েছিল; তারা আবার টাকা জমা দিচ্ছে। প্রতিদিনই নতুন হিসাব খুলছে মানুষ।’
তিনি বলেন, ‘প্রতি সপ্তাহে পরিস্থিতি ভাল হচ্ছে। এখন যেমন আছে আগামি ৩০ তারিখের পর ভাল কিছু হবে। পরবর্তী ১৫ দিনে আরও ভাল অবস্থানে যেতে পারব। গ্রাহকদের বলব- আমাদের ওপর আস্থা রাখেন আমরা শিগগিরই আপনাদের টাকা ফেরত দেব। এমনকি অন্য ব্যাংককে ধার দেব।’
তিনি আরো বলেন, ‘ব্যাংকের আইডিআর বা ইনভেন্সম্যান্ট অ্যান্ড ডিপোজিট রেশিও ১৪০ এর ওপরে কিভাবে গেল? এটা হতে দেওয়া ঠিক হয়নি। এজন্যই এখন গ্রাহক টাকা পাচ্ছে না। আমরা সব অব্যবস্থাপনা দূর করে ব্যাংকটিকে শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে যাব। এই ব্যাংকে আমাদের কোন শেয়ার নেই, আমরা জনগনের পক্ষ থেকে দায়িত্ব নিয়েছি। তাই জনগনের আমানত রক্ষা করাই আমাদের প্রধান দায়িত্ব।’
ইউনিয়ন ব্যাংকের চেয়ারম্যান মু. ফরীদ উদ্দীন আহমদও ব্যাংকটির দ্রুত উন্নতির ব্যাপারে আশা প্রকাশ করেন। তিনি প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘তারল্য পরিস্থিতি খুবই খারাপ অবস্থানে রয়েছে। সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। আমরা চেষ্টা করছি দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতে। আশাকরি সব ঠিক হয়ে যাবে।’
জানা গেছে, বিভিন্ন আর্থিক অনিয়ম ও ঋণ জালিয়াতির কারণে এস আলমের নিয়ন্ত্রণাধীন ৯টির মধ্যে আটটি ব্যাংক দীর্ঘদিন ধরেই তারল্য সংকটে ভুগছে। ব্যাংকগুলো হল- ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামি ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, বাংলদেশ কমার্স ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংক। এর বাইরে এক্সিম ব্যাংক, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক ও পদ্মা ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকেও নগদ টাকার সংকট চলছে।
সংকটে থাকা আরেকটি ব্যাংক হলো, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক। তবে এই ব্যাংকে কোনো তারল্য সংকট নেই। সম্প্রতি এসব ব্যাংকের পর্ষদ বাতিল করে নতুন পর্ষদ গঠন করে দেওয়া হয়েছে। এরপর থেকে ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক সব ধরনের আমানতকারীরা টাকা তোলার জন্য ব্যাংকগুলোতে ভিড় করছেন। কিন্তু সংকটের কারণে এসব ব্যাংক গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী টাকা দিতে পারছে না। এ ছাড়া চলতি হিসাবে বড় ধরনের ঘাটতি থাকায় বেশ কয়েকটি ব্যাংকের চেক ক্লিয়ারিং সুবিধা বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে এসব ব্যাংকের গ্রাহকরা এটিএম বুথ থেকেও টাকা উত্তোলন করতে পারছেন না।
সংকটের থাকা ব্যাংকগুলোর বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পদক্ষেপের বিষয়ে জানতে চাইলে
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র হুশনে আরা শিখা বলেন, ‘খেলাপি ঋণের অর্থ আদায় করতে পারলে পরিস্থিতি অনেটাই কেটে যাবে। টাস্কফোর্সের পরামর্শ মতো বাংলাদেশ ব্যাংক এবং সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো পদক্ষেপ নেবে। বর্তমান পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সংকটে পড়া ব্যাংকগুলোকে তারল্য সহায়তা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ কারণে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোকে তাদের সমস্যা তুলে ধরে প্রস্তাব আকারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জানাতে বলা হয়েছে। এরপর বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সেগুলো যাচাই-বাছাই করে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেবে। এক সপ্তাহের মধ্যেই এই কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হবে।’