রেদওয়ানুল হক
প্রকাশ : ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১১:১৭ এএম
আপডেট : ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১১:৪৪ এএম
খেলাপি ঋণের রেকর্ডের ফলে গ্রাহকের আমানতের নিরাপত্তায় রাখা সঞ্চয়েও বিপুল ঘাটতি দেখা দিয়েছে। ব্যাংক খাতে প্রভিশন নামে এ হিসাবে ঘাটতির অঙ্ক এখন ২৪ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। যা মূলত এসব ব্যাংকের ভঙ্গুর আর্থিক অবস্থার প্রতিচ্ছবি।
চলতি বছরের জুন শেষে সরকারি ও বেসরকারি খাতের ১০টি ব্যাংক সঞ্চিতি ঘাটতিতে রয়েছে। এগুলো হলো- ন্যাশনাল ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, বিডিবিএল, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক ও সাউথইস্ট ব্যাংক।
এসব ব্যাংকে মোট ঘাটতির পরিমাণ ৩১ হাজার ৫৪৮ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। তবে কিছু ব্যাংক প্রভিশন উদ্বৃত্ত রাখায় দেশের ব্যাংক খাতে সার্বিক সঞ্চিতি ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২৪ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
তথ্য অনুযায়ী, প্রভিশন ঘাটতিতে প্রথমে বেসরকারি ব্যাংক থাকলেও দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, করপোরেট সুশাসন এবং ব্যাংকিং ব্যবসার ভিত্তি মজবুত না হওয়ার কারণে এ সংকটের উৎপত্তি হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, সরকারি বেসরকারি ব্যাংক মিলিয়ে মোট ১০টি ব্যাংকের মোট সঞ্চিতি ঘাটতির পরিমাণ ৩১ হাজার ৫৪৪ কোটি টাকা। কয়েকটি ব্যাংক তাদের লক্ষ্যমাত্রার বেশি সঞ্চিতি রেখেছে। ফলে ব্যাংক খাতে সার্বিক প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২৪ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বরে ব্যাংক খাতের সার্বিক প্রভিশন ঘাটতি ছিল ১৯ হাজার ২৬১ কোটি টাকা। অর্থাৎ মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে প্রভিশন ঘাটতি বেড়েছে ৫ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা।
নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোকে পরিচালন মুনাফার শূন্য দশমিক ৫ থেকে ৫ শতাংশ সাধারণ ক্যাটাগরির ঋণের বিপরীতে প্রভিশন হিসেবে রাখতে হয়, নিম্নমানের খেলাপি ঋণের বিপরীতে ২০ শতাংশ এবং ৫০ শতাংশ সন্দেহজনক খেলাপি ঋণের বিপরীতে রাখতে হয়। এ ছাড়া, প্রতিটি ব্যাংকের জন্য মন্দ বা লোকসান ক্যাটাগরির খেলাপি ঋণের বিপরীতে ১০০ শতাংশ প্রভিশনিং আলাদা করে রাখার বিধান রয়েছে। প্রভিশন ঘাটতি ব্যাংকিং খাতের জন্য একটি অশনিসংকেত, কারণ এটি ব্যাংকগুলোর দুর্বল আর্থিক অবস্থার চিত্র তুলে ধরে, যা মূলত উচ্চ খেলাপি ঋণের ফল।
তথ্য মতে, ২০২৪ সালের জুন শেষে দেশের ব্যাংক খাতে সবচেয়ে বেশি প্রভিশন ঘাটতিতে রয়েছে বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক। নানা অনিয়মের কারণে বেশ আলোচিত এ ব্যাংকটি। তাই অন্যদের তুলনায় আমানত সংগ্রহ এবং ঋণ আদায়ে বেশ পিছিয়ে তারা। ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকের মোট প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ৭০৩ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বরেও তাদের সঞ্চিতি ঘাটতি ছিল ১১ হাজার ৬৯৮ কোটি টাকা। ছয় মাসের ব্যবধানে তাদের সঞ্চিতি ঘাটতি বেড়েছে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা।
ঘাটতির তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংক। জুন শেষে ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৩১১ কোটি টাকা। গত বছরের ডিসেম্বরেও ব্যাংকটির সঞ্চিতি ঘাটতি ছিল ৪ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা। তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে আরেক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক বেসিক ব্যাংক। এই সময়ে ব্যাংকটির ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ২৪১ কোটি টাকা। আর রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ৪ হাজার ৪০১ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বরে ইতিবাচক ধারায় থাকলেও চলতি বছরের জুনে বাংলাদেশে ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেডের (বিডিবিএল) সঞ্চিতি ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২৪ কোটি টাকা।
এ ছাড়াও বেসরকারি খাতের মধ্যে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ৪৪৩ কোটি, ঢাকা ব্যাংকের ৩২৭ কোটি, আইএফআইসি ব্যাংকের ৫০৫ কোটি, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ৩৯১ কোটি ও সাউথইস্ট ব্যাংকের ১৯৮ কোটি টাকা প্রভিশন ঘাটতিতে রয়েছে।
এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ মিশনের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘সাধারণত প্রভিশন করলে লাভ কমে যায়। লাভ কমলে ডিভিডেন্ট (লভ্যাংশ) দেওয়া যায় না। মালিকদের তো একটা ডিভিডেন্টের আগ্রহ থাকে। সে কারণেই প্রভিশন ঘাটতিটা হয়। সেটা করে পার পাওয়ার কথা না, যদি নিয়ন্ত্রণ সংস্থা তাদের কাজটা করে। ব্যাংকগুলোর জন্য নিয়ম বেঁধে দেওয়া আছে কোন ক্যাটাগরির জন্য কত প্রভিশন করতে হবে। সরকারি ব্যাংক হোক আর বেসরকারি হোক, প্রভিশন অবশ্যই রাখতে হবে।’
এদিকে চলতি বছরের জুন মাস শেষে ব্যাংক খাতের মোট ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ৮৩ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। যা বিতরণকৃত ঋণের ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ। গত মার্চ শেষে ঋণ স্থিতি ছিল ১৬ লাখ ৪০ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা। তখন খেলাপি ছিল ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা। সে হিসেবে তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৯ হাজার ৯৬ কোটি টাকা। যেখানে ঋণ বিতরণ বেড়েছে ৪২ হাজার ৫৪১ কোটি টাকা।