রেদওয়ানুল হক
প্রকাশ : ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৮:৩০ এএম
আপডেট : ১০ ঘণ্টা আগে
রুগ্ণ আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাগজে-কলমে বেশ এগিয়ে আইডিএলসি। নানা কলাকৌশলে বাংলাদেশ ব্যাংকের টেকসই রেটিং বাগিয়ে নিলেও বাস্তবতা ভিন্ন। ফলে প্রতিনিয়ত মন্দ পরিণতির দিকে ধাবিত হচ্ছে অপেক্ষাকৃত ভালো এই প্রতিষ্ঠানটি। ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি এবং অপচয়ের কারণে এমন পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে বলে জানা গেছে।
প্রতিষ্ঠানটিতে খেলাপি ঋণের ক্রমাগত বৃদ্ধির পাশাপাশি অন্তত ৯টি সূচকে উচ্চ ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। ফলে আমানতকারীদের মধ্যে আস্থাহীনতা দেখা দিয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের বেশিরভাগ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দুর্দশার কারণে অপেক্ষাকৃত ভালো ফল দেখিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে আইডিএলসি। বাস্তবে সম্ভাবনাময় প্রতিষ্ঠানটি দুর্বল ব্যবস্থাপনা আর ভুল নীতির কারণে দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে।
আইডিএলসির আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটি ৯টি সূচকে উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। এগুলো হলোÑ ক্রেডিট রিস্ক, খেলাপি ঋণ, সুদহার, ইকুইটি প্রাইস, তারল্য ব্যবস্থাপনা, ব্যবস্থাপনা ত্রুটি, তারল্য প্রবাহ, নীতি প্রণয়ন এবং প্রয়োগ, প্রযুক্তিগত দিক। এর মধ্যে ক্রেডিট রিস্ক বেশি চিন্তার কারণ। খেলাপি ঋণের সম্ভাব্য ঝুঁকি ২০২৩ সালে উচ্চতর পর্যায়ে পৌঁছেছে, যা এক বছর আগে ২০২২ সালে নিম্নস্তরে ছিল। যদিও আগে থেকেই খেলাপি ঋণের প্রভাব উচ্চমাত্রায় ছিল। প্রতিষ্ঠানটির বিতরণকৃত ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রেও উচ্চ ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। এক বছর আগে এটি মধ্যম পর্যায়ে ঝুঁকিতে ছিল। ফলে দিন দিন খেলাপি ঋণের অঙ্ক বাড়ছে।
কোম্পানিটির মার্কেট রিস্ক দিন দিন খারাপ হচ্ছে। এর মধ্যে উচ্চতর অবস্থানে রয়েছে সুদহার সংক্রান্ত ঝুঁকি। এ ছাড়া ইকুইটি প্রাইসও রয়েছে উচ্চ ঝুঁকিতে। তা ছাড়া প্রতিষ্ঠানটির অন্যতম ঝুঁকি হলো ‘ফান্ডিং লিকুইডিটি রিস্ক’ বা তারল্য ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত ঝুঁকি। এ ছাড়া ‘মার্কেট লিকুইডিটি’ ঝুঁকিও বড় দুশ্চিন্তার কারণ প্রতিষ্ঠানটির জন্য। তা ছাড়া ব্যবস্থাপনাগত উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে আইডিএলসি। অর্থাৎ ব্যবস্থাপনা ত্রুটি দিন দিন বাড়ছে। প্রতিষ্ঠানটির নীতি প্রণয়ন এবং প্রয়োগও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। এ ছাড়া প্রযুক্তিগত দিক থেকেও রয়েছে উচ্চ ঝুঁকি। বিশেষ করে তথ্যের নিরাপত্তা বিধানে আগের চেয়ে বেশি ঝুঁকিতে পড়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে তথ্যের নিরাপত্তা তথা সাইবার হামালা থেকে সুরক্ষিত থাকা খুবই জরুরি। কিন্তু গ্রাহক এবং কোম্পানির নিজস্ব তথ্যের নিরাপত্তা দেওয়ার প্রয়োজনীয় সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি আইডিএলসি। তাই নিজেরাই উচ্চ ঝুঁকির বিষয়টি বিনিয়োগকারীদের জানিয়েছে। তবে অধিকাংশ বিনিয়োগকারীই এসব রিপোর্ট ক্ষতিয়ে দেখেন না বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
আইনি দিক থেকেও ঝুঁকি আগের চেয়ে বেড়েছে। বিশেষ করে অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসী অর্থায়ন বিষয়ে উচ্চ ঝুঁকিতে পড়েছে। ২০২৩ সালে উচ্চ ঝুঁকি তৈরি হয়েছে; যা আগের বছরও মধ্যম মানের ঝুঁকিতে ছিল।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে আইডিএলসির মুখপাত্র মাসুদ করীম প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘২০২৩ সালে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা মোকাবিলা করতে হয়েছে। বিশেষ করে সুদহার বেড়ে যাওয়ার কারণে ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড খারাপ অবস্থার মধ্য দিয়ে গেছে। তা ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের বেশ কিছু ছাড়ের কারণে অনেক ঋণ একযোগে খেলাপি হয়ে পড়েছে। সার্বিকভাবে যে খারাপ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তা এ বছর কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করা হচ্ছে।’
নিট মুনাফা কমেছে ৩২ শতাংশ
আইডিএলসির নিট মুনাফায় উল্লেখযোগ্য পতন হয়েছে। ২০২২ সালের তুলনায় ৩২ দশমিক ৪৮ শতাংশ কম মুনাফা করেছে প্রতিষ্ঠানটি। আয়কর পরিশোধ শেষে ২০২৩ সালে কোম্পানিটির মুনাফা হয়েছে ১০৯ কোটি টাকা, যা ২০২২ সালে ছিল ১৬২ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে কোম্পানিটির নিট মুনাফা কমেছে ৫২ কোটি টাকা।
মুনাফা কমলেও কোম্পানিটির পরিচালন ব্যয় বেড়েছে। পরিচালন বাবদ ২০২৩ সালে ২৫৩ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। ২০২২ সালে খরচ হয়েছিল ২৪১ কোটি টাকা। অর্থাৎ পরিচালন ব্যয় বাড়িয়েও মুনাফা ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমান কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটির কারণে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। কোম্পানির প্রধান কার্যালয় পরিদর্শনে দেখা যায় কর্মকর্তাদের বিলাসিতা আর চাকচিক্যে ভরপুর। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অভিযোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ কোম্পানির স্বাস্থ্য ভালো করার চেয়ে নিজেদের আভিজাত্য ও বিলাসিতায় মগ্ন হয়ে বিপুল অর্থ অপচয় করছেন। দেশের সরকারি-বেসরকারি প্রতিটি খাতে কৃচ্ছ্রসাধন নীতি অনুসরণ করা হলেও উল্টো পথে হেঁটেছে আইডিএলসি। ব্যয় সংকোচন দূরে থাক উল্টো ব্যয় বেড়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের একজন কর্মকর্তা বিষয়টি ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ‘সার্বিক পরিস্থিতিতে কৃচ্ছ্রসাধন নীতি অনুসরণ করা দরকার ছিল। তবে যদি ধরেও নিই যে কর্মীদের সুযোগ-সুবিধা দিতে ব্যয় বাড়ানো হয়েছে; তাহলে নেতিবাচক ভাবার কারণ নেই। তবে যেসব কর্মীর সুবিধা বাড়ানো হলো, তারা কীভাবে এক বছরে ৫০ কোটি টাকার বেশি হাতছাড়া করে ফেলল। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানটিতে জবাবদিহির ঘাটতি তৈরি হয়েছে।’
গ্রুপভুক্ত হিসাবেও নিট মুনাফা কমেছে। আইডিএলসি গ্রুপের ২০২৩ সালে নিট মুনাফা হয়েছে ১৫১ কোটি টাকা। আগের বছর এ অঙ্ক ছিল ১৯১ কোটি টাকা। অর্থাৎ গ্রুপভুক্ত মুনাফা কমেছে ২১ শতাংশ।
প্রতিষ্ঠানটির মুখপাত্র বলেন, ‘সার্বিকভাবে শেয়ার মার্কেট খারাপ অবস্থার মধ্য দিয়ে গেছে। তাই আমরাও মুনাফা করতে পারিনি। শেয়ার মার্কেটে মুনাফা কমে যাওয়ার কারণে আমাদের সার্বিক মুনাফা কমে গেছে।’
নাম প্রকাশ না করে একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘সামগ্রিকভাবে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রাহকের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছে। যে কয়টি প্রতিষ্ঠান ভালো আছে তার মধ্যে অন্যতম আইডিএলসি। কিন্তু বর্তমান ব্যবস্থাপকদের হাত ধরে প্রতিষ্ঠানটি ক্রমাগত খারাপ অবস্থার দিকে যাচ্ছে।’
তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২০ সালে আইডিএলসির নিট মুনাফা ছিল ২৫৪ কোটি টাকা। ২০২৩ সালে তা ১০৩ কোটি টাকা বা ৪০ শতাংশ কমে গেছে। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানটি ক্রমেই দুর্দশাগ্রাস্ত প্রতিষ্ঠানের কাতারে চলে যাচ্ছে।
এদিকে আইডিএলসির খেলাপি ঋণ এখনও খারাপ অবস্থায় যায়নি। তবে দ্রুতগতিতে এটি বেড়ে চলেছে, যা বড় দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২০ সালে আইডিএলসির খেলাপি ঋণ ছিল বিতরণকৃত ঋণের ১ দশমিক ৭৯ শতাংশ। ২০২১ সালে সেটি এক লাফে ৩ দশমিক ০৫ শতাংশে ওঠে। ২০২২ সালে আরও বেড়ে হয় ৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ। আর ২০২৩ সালে আবারও বড় লাফ দেয় খেলাপি ঋণের হার। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির বিতরণ করা ৪ দশমিক ৪৬ শতাংশ ঋণ খেলাপি মানে শ্রেণিকৃত রয়েছে।
জানা গেছে, এসব কারণে প্রতিষ্ঠানটি ছেড়ে চলে যাচ্ছে বহু গ্রাহক। ২০২৩ সালে দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাত ছেড়ে চলে গেছেন ৯০ হাজার আমানতকারী। এর মধ্যে আইডিএলসির আমানতকারীই অনেক বেশি। জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটির ক্ষুদ্র আমানত স্কিমের প্রতি মানুষের অনাগ্রহ তৈরি হয়েছে। তাই অনেকেই তাদের হিসাব বন্ধ করে চলে গেছে।
এ বিষয়ে আইডিএলসি ফাইন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম জামাল উদ্দিন প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমানত বিবেচনায় হিসাব পরিচালনার খরচ বেশি হওয়ায় ক্ষুদ্র আমানত সংগ্রহে প্রচারণা কমিয়ে দিয়েছি। কারণ ব্র্যান্ডিং খরচের তুলনায় আমানত সংগ্রহের হার খুবই কম। তাই ক্ষুদ্র আমানত কমে গেছে।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের সাড়ে তিন লাখ ক্ষুদ্র হিসাবের বিপরীতে আমানত এসেছে মাত্র ১৬০ কোটি টাকা। অথচ কয়েকজন বড় আমানতকারী থেকেই সমপরিমাণ আমানত সংগ্রহ সম্ভব। তা ছাড়া ক্ষুদ্র আমানতকারী সংগ্রহ এবং হিসাব পরিচালনায় যে পরিমাণ অর্থ খরচ হয় তা লাভজনক নয়।
অর্থাৎ ভুল প্রকল্প হাতে নিয়ে পরিচালন ব্যয় বাড়িয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। ফলে খরচ বাড়লেও প্রতিষ্ঠানের আয় বাড়েনি। অপরদিকে প্রতিষ্ঠানটির প্রতি সাধারণ আমানতকারীদের আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে।’