চট্টগ্রাম অফিস
প্রকাশ : ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ২৩:১৪ পিএম
আপডেট : ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১০:০৪ এএম
ব্যাংক থেকে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে পরিশোধ করেননি। কেবল বছরে বছরে সেই ঋণ নবায়ন করে যেতেন। গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর চট্টগ্রামের বহুল আলোচিত এস আলম গ্রুপের সম্পদ নিয়ে যখন টানাহেঁচড়া শুরু হয়েছে, তখনই তিনি পালাচ্ছিলেন দুবাইয়ের পথে। কিন্তু বিধি বাম! শেষ রক্ষা হয়নি। ধরা পড়লেন ইমিগ্রেশন পুলিশের হাতে। দুবাইয়ের পরিবর্তে তার গন্তব্য হয়েছে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার। আলোচিত এই ব্যক্তির নাম আনছারুল আলম চৌধুরী। তিনি খাতুনগঞ্জের আনছার ট্রেডিংয়ের মালিক এবং এস আলমের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত।
সোমবার (২ সেপ্টেম্বর) সকাল সাড়ে ৮টার দিকে চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে আনছারুল আলম চৌধুরীকে আটক করে ইমিগ্রেশন পুলিশ। তিনি রাউজান উপজেলার কোয়াপাড়া গ্রামের মফিজুল আলম চৌধুরীর ছেলে। আটকের পর আনছারুলকে পতেঙ্গা মডেল থানায় হস্তান্তর করা হয়।
আনছারুল আলম চৌধুরীর নামে ইসলামী ব্যাংকে ১ হাজার ৬৩০ কোটি টাকা এবং জনতা ব্যাংকে ৩৪০ কোটি টাকার ঋণ রয়েছে জানা বলে গেছে।
গ্রেপ্তারের বিষয়ে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন পুলিশের পরিদর্শক (অ্যাডমিন ও প্রসিকিউশন) মো. তাহ্ইয়াতুল ইসলাম বলেন, আনছারুল আলম দুবাই যাওয়ার জন্য ইমিগ্রেশনে আসেন। এ সময় তার নামে বিপুল অঙ্কের ঋণ থাকার তথ্য জানার পর ইমিগ্রেশন পুলিশ তাকে আটক করে পতেঙ্গা থানায় সোপর্দ করে।
চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার (বন্দর) শাকিলা সুলতানা বলেন, আনছারুল আলমকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে। আদালত আসামিকে কারাগারে পাঠিয়েছেন। তিনি জানান, ‘ঋণ সংক্রান্ত বিষয়ে সাধারণত পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) মামলা করার কথা। সেই কারণে প্রাথমিকভাবে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। দ্রুতই পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
আনছারুল বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিনি দীর্ঘকাল ধরে এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মাসুদের ব্যক্তিগত সহকারী আকিজ উদ্দিনের সঙ্গে মিলে কাজ করতেন। তার নামে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সেই টাকা ব্যবহার করত এস আলম গ্রুপ। বিনিময়ে কিছু ভাগ দেওয়া হতো আনছারুলকে। তবে এস আলম গ্রুপের জালে জড়ানোর আগে তিনি নিজেও ব্যবসা করতেন।
পশ্চিম পটিয়ার শিকলবাহা এলাকায় এহসান স্টিলের সঙ্গে একসময় ব্যবসায়িকভাবে যুক্ত ছিলেন আনছারুল। পরে এহসান স্টিলের নামেও ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ কৌশলে বের করে নেওয়া হয়। এস আলম গ্রুপ ঋণ নেওয়ার প্রয়োজনে যাদের ব্যবহার করত, তাদের মধ্যে কারও কারও নামে জমি-বাড়িও কিনত। পরে সেইসব বাড়ি ও জমি ব্যাংকে বন্ধক রেখে বিপুল পরিমাণ ঋণের টাকা হাতিয়ে নেওয়া হতো। সেই ফাঁদের অংশ হিসেবে আনছারুলের নামেও চট্টগ্রামের কালামিয়া বাজার এলাকায় একটি বড় বাড়ি কেনা হয়েছিল বলে জানা গেছে।
আনছারুল একসময় মূলত জমি বেচাকেনার ব্যবসা করতেন। চট্টগ্রাম এবং ঢাকায় এস আলম গ্রুপের হয়ে জমি কেনায় মধ্যস্থতা করতেন তিনি। এ কাজ করে টাকা উপার্জনের পাশাপাশি নিজের ব্যবসা বন্ধক রেখেও ব্যাংক থেকে অনেক টাকা ঋণ নেন আনছারুল। সেই ঋণের কিস্তি সময়মতো পরিশোধ না করে নবায়ন করে নিতেন। ‘আনছার ট্রেডিং’-এর নামে তার একটি টিনের দোকান ছিল। কিন্তু ব্যাংকঋণের ফরমে লেখা হয়েছিল এটি ঢেউটিন আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান।
ব্যাংকারদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, আনছারুল আলম চৌধুরী ২০২২ সালে জনতা ব্যাংকের আগ্রাবাদ করপোরেট শাখা থেকে ৩৪০ কোটি টাকা ঋণ নেন। এর আগে ইসলামী ব্যাংক চাক্তাই শাখা থেকে নেন এক হাজার ৬৩০ কোটি টাকা ঋণ।
ইসলামী ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, আনছারুল আলম চৌধুরী তার নিজ মালিকানাধীন ইনহেরেন্ট ট্রেডিং অ্যান্ড ইমপেক্স লিমিটেডের নামে ২০২১ সালে চাক্তাই শাখা থেকে ৬০০ কোটি টাকা ঋণ নেন। পরের বছর মার্চে তা বাড়িয়ে ১৬৩০ কোটি টাকা করা হয়। টাকা পরিশোধ ছাড়াই বছর বছর নবায়ন করে ‘নিয়মিত’ করে রাখা হচ্ছে এক বছর মেয়াদি এই ঋণ।
আনছারুল বিষয়ে আরও জানা গেছে, তার নামে দুটি প্রতিষ্ঠানের তথ্য ব্যাংক থেকে জানা গেলেও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তারা ডেটাবেজ সফটওয়্যারে আনছারুলের প্রতিষ্ঠানের নাম খুঁজে পাননি। প্রতিষ্ঠানটির নামে পণ্য আমদানির তথ্যও পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া ইসলামী ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার সময় ফরমে লেখা হয়েছিল তার মাসিক আয় দুই লাখ টাকা, আর সেই ব্যক্তিকেই ইসলামী ব্যাংক ঋণ দিয়েছিল হাজার কোটি টাকা।
আরও জানা যায়, ২০২২ সালের ৩ নভেম্বর ঢেউটিন আমদানিকারক পরিচয়ে আনছারুল জনতা ব্যাংকে একটি হিসাব চালু করেন। এই হিসাব চালুর তিন দিনের মধ্যেই এস আলমের মালিকানাধীন ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক এবং ইউনিয়ন ব্যাংকের কয়েকটি শাখায় কয়েকশ কোটি টাকার এফডিআর খোলা হয় আনসারুল আলমের প্রতিষ্ঠানের নামে। আর এফডিআর খোলার ১০ দিনের মাথায় ১৭ নভেম্বর জনতা ব্যাংক থেকে এক বছর মেয়াদি ৩৪০ কোটি টাকা ঋণ আবেদন করেন আনছারুল। এর বিপরীতে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংকে খোলা এফডিআরগুলো জমা দেওয়া হয়। আবেদনের পরের সপ্তাহে ঋণ অনুমোদন পান আনছারুল। এই ঋণ অনুমোদন দেন জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুস সালাম আজাদ। পরে এই টাকা কৌশলে এস আলমের কাছে চলে যায় বলে তথ্য পাওয়া গেছে।