প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১২ আগস্ট ২০২৪ ১৩:৩৬ পিএম
আপডেট : ১২ আগস্ট ২০২৪ ১৮:১৮ পিএম
ছবি : সংগৃহীত
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে বাংলাদেশের অর্জন বাড়লেও অনেক চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে মানুষের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দিতে হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, এ ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জ অভ্যন্তরীণ, আবার কিছু বৈশ্বিক। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া দরকার। এ খাতে সব ধরনের সিন্ডিকেট সমূলে উৎপাটন করা দরকার বলেও প্রত্যাশা করেন তারা।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন উন্নয়ন বিকল্পের নীতিনির্ধারণী গবেষণা (উবিনীগ) প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক ফরিদা আখতার। তার কাছে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের ব্যক্তিদের প্রত্যাশা কেমন তা জানতে মন্ত্রণালয়টির খাত সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করা হয় প্রতিদিনের বাংলাদেশের পক্ষ থেকে। সেখানে বিভিন্ন ব্যক্তি তাদের প্রত্যাশা জানিয়েছেন।
পোলট্রি খাতের সিন্ডিকেট ভাঙনে ইতঃপূর্বে আমরা যেসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নাম প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছিলাম, তাদের বিরুদ্ধে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যথাযথ ব্যবস্থা নেবে বলে প্রত্যাশা করেন বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএ) সভাপতি মো. সুমন হাওলাদার। তিনি বলেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূস দীর্ঘদিন ধরে উদ্যোক্তাদের নিয়ে কাজ করেন। তার নেতৃত্বে ফরিদা আখতার মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন। তার কাছে আমাদের প্রত্যাশা, ইতঃপূর্বে যেসব সিন্ডিকেটের নাম প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ের কাছে জমা দিয়েছিলাম, তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পোলট্রি খাতে সিন্ডিকেট ভেঙে দিলে মাংস ও ডিম উৎপাদনে ব্যয় কমে যাবে। তাতে করে ভোক্তারা ন্যায্যমূল্যে মুরগি ও ডিম কিনতে পারবেন। এখন যেমন ডিমের হালি ৫৫-৬০ টাকা পর্যন্ত উঠে গেছে, তা আর হবে না। ব্রয়লার মুরগির কেজিও দেশে একসময় আড়াইশ টাকার ওপরে উঠে গিয়েছিল। যে বাচ্চার উৎপাদন খরচ ৩০ টাকা, আমাদের খামারিদের তা কিনতে হয় ৯০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত। এসব সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে হবে। সরকারি হ্যাচারিতে বাচ্চা উৎপাদন বাড়াতে হবে এবং প্রয়োজনে বিদেশ থেকে আমদানির অনুমতিও দিতে হবে। তাতে কোম্পানিগুলোর সিন্ডিকেট ভেঙে পড়বে।
সাগরে প্রতিবেশী দেশের ট্রলারের দস্যুতা বন্ধ করতে হবে উল্লেখ করে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ, অ্যাকুয়াকালচার অ্যান্ড মেরিন সায়েন্স অনুষদের সাবেক ডিন ও ফিশারিজ বায়োলজি অ্যান্ড জেনেটিক্স বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. কাজী আহসান হাবীব বলেন, সাগরে যে সময় মাছ ধরা বন্ধ রাখা হয়, সেসময় প্রতিবেশী দেশ ভারত তা বন্ধ রাখে না। তারা আমাদের সমুদ্রসীমায় ঢুকে প্রচুর মাছ ধরে নিয়ে যায়। তাদের বড় বড় ট্রলার দিয়ে আমাদের জেলেদের ট্রলারও অনেক সময় ডুবিয়ে দেয়। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, ভারতীয় জেলেরা আমাদের সাগরসীমায় অহরহ ঢুকে পড়ে মাছ ধরে; কিন্তু বাংলাদেশি জেলেরা ভুলেও যদি তাদের সীমায় ঢুকে পড়ে, তা হলে তাদের ধরে নিয়ে আটকে রাখে। এসব যেন না হয় সে ব্যাপারে নতুন উপদেষ্টাকে পদক্ষেপ নিতে হবে।
ড. হাবীব বলেন, ‘বিগত সরকার কোনো কারণ ছাড়াই মাছের উৎপাদন এক লাখ মেট্রিক টন বেশি দেখিয়েছে। প্রকৃত তথ্য তুলে ধরা দরকার। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা, মৎস্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা দেখাতে গিয়ে প্রতি বছর এসব কাজ করা হয়েছে। আবার ইলিশের উৎপাদন কমে গেছে। এজন্য ইলিশ ধরার ক্ষেত্রে নতুন চিন্তা করতে হবে। ইলিশ রপ্তানির উদ্যোগ নিতে হবে। তা ছাড়া অন্যান্য মাছ রপ্তানির ক্ষেত্রেও আমরা পিছিয়ে আছি। কেননা আমরা মানসম্পন্ন মাছ উৎপাদন করতে পারছি না। ভিয়েতনাম পাঙাশ রপ্তানি করছে। কিন্তু আমরা বিপুল পরিমাণ পাঙাশ ও তেলাপিয়া উৎপাদন করেও তা রপ্তানি করতে পারছি না। আসলে মানসম্পন্ন মাছ উৎপাদন করতে হবে।’
সামুদ্রিক মাছের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘সমুদ্রে আমাদের কোথায় কোথায় স্টক আছে, তা আরও ভালোভাবে চিহ্নিত করা দরকার। বিগত সরকার যদিও অনেকগুলো স্থান চিহ্নিত করেছে, তা আরও বাড়াতে হবে। বর্তমানে যেসব ফিশিং গ্রাউন্ড আছে সেখানে আবারও জরিপ চালিয়ে দেখা দরকার, সেখানে মাছের মজুদ কেমন, সেসব স্থান থেকে কী পরিমাণ মাছ ধরা সম্ভব।
তিনি আরও বলেন, ‘মাছের খাদ্যের দাম বেশি হওয়ায় মৎস্যচাষিরা লাভ করতে পারে না। এ খাতে প্রয়োজনে ভর্তুকি দিয়ে হলেও খাদ্যের দাম কমাতে হবে। এই খাতে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেট পুরোপুরি গুঁড়িয়ে দিতে হবে। বিগত সরকার সিন্ডিকেট ভাঙতে উদ্যোগী হয়নি। ফলে অনেক অর্জন থাকলেও ঘাটতি থেকে গেছে।’
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা থাকবে তারা সন্ত্রাসমুক্ত সমাজ গড়ে তুলবেÑবলেছেন বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতির মহাসচিব রবিউল আলম। তিনি বলেন, ‘বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এসব থেকে আমরা মুক্তি চাই। আমরা সন্ত্রাসমুক্ত নতুন দেশ চাই। প্রাণিসম্পদ খাত নিয়ে আমাদের সঙ্গে যদি উপদেষ্টা বসেন, তাহলে এর বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরা হবে।’
তিনি বলেন, ‘এই খাত বাংলাদেশের অর্থনীতিকে দ্রুত পরিবর্তন করতে পারে। আমরা আশা করছি, সরকার আমাদের সঙ্গে বসে আলাপ-আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবেন। আমরা এখনও বিশ্বাস করি, সরকার যদি একটি বছর পরিকল্পনামাফিক কাজ করে, তাহলে ৫০০ টাকা কেজিতে গরুর মাংস খেতে পারব।’
বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ডা. এস এম জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘আমরা নতুন উপদেষ্টা ও শিক্ষার্থীদের দিকনির্দেশনায় নতুন একটি দেশ গড়তে কাজ করব। উপদেষ্টা তার স্বপ্ন আমাদের কাছে তুলে ধরবেন। আমরা তা বাস্তবায়নে কাজ করব।’
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দর বলেন, ‘এ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে ফরিদা আখতার দায়িত্ব নিয়েছেন। তিনি একজন গবেষক। দীর্ঘদিন ধরে কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ নিয়ে তিনি কাজ করছেন। তার কাছে আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, প্রাণিসম্পদ খাতকে একেবারে প্রান্তিক মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য যাবতীয় দিকনির্দেশনা দেবেন। এর মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী ভাবে গড়ে তুলতে আমাদের মেধাকে কাজে লাগাবেন। হাঁস-মুরগি ও গরু-ছাগল তথা অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রাণিসম্পদ লালন-পালনের মাধ্যমে নারীদের অর্থনৈতিক শক্তি আরও মজবুত করতে উদ্যোগী হবেন।’
মৎস্য খাত সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের হারিয়ে যাওয়া বিভিন্ন প্রজাতির মাছকে ফিরিয়ে এনে বিল-ঝিল, খাল-নদী ও অন্যান্য স্থানগুলোকে মাছের অভয়ারণ্যে পরিণত করতে উদ্যোগ নেওয়া হবে। উপদেষ্টার সঙ্গে আমাদের প্রাথমিক কথাবার্তা হয়েছে। তিনি খুবই আন্তরিক। প্রত্যাশা করি, দেশের কল্যাণে এই মন্ত্রণালয়ের প্রতিটি ব্যক্তি মেধা ও মননকে কাজে লাগিয়ে দেশকে আরও সমৃদ্ধ করে তুলবেন।’