প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ৩১ জুলাই ২০২৪ ১৬:৫৫ পিএম
অফসোর ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বিদেশি ঋণ আকর্ষণে আইনি সুরক্ষা যেমন ইতিবাচক ফল দিচ্ছে; একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাজারে সুদের হার এবং বিভিন্ন সংস্থার নেতিবাচক রেটিং বড় চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড় করিয়েছে। তাই আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আকর্ষণীয় সুদহার নির্ধারণ করা কঠিন। তবে কান্ট্রি রেটিংয়ের উন্নতি করার বিকল্প নেই। সম্ভাবনাময় অফসোর ব্যাংকিং কার্যক্রমের সর্বনাশ করতে পারে এই রেটিং। তাই নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে রেটিং উন্নতিতে জোরালো পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি সংশ্লিষ্টদের।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, অফশোর ব্যাংকিংয়ের তহবিল আনার জন্য আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংকের ওপর নির্ভর করতে হয়। বাংলাদেশে অপেক্ষাকৃত বেশি সুদ পাওয়ায় ওই প্রতিষ্ঠানগুলো তহবিল দিত। কিন্তু গত দুই বছরে আন্তর্জাতিক বাজারে সুদহার বেশ চড়া। এ কারণে অফশোর ব্যাংকিংয়ের জন্য পর্যাপ্ত তহবিল সংগ্রহ করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
এক্ষেত্রে ‘কান্ট্রি রেটিং’ বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মুডিস, পিচ, এসঅ্যান্ডপির মতো আন্তর্জাতিক ক্রেডিট রেটিং প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশের রেটিং অবনমন করেছে। অথচ বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো তহবিল দেওয়ার ক্ষেত্রে কান্ট্রি রেটিং দেখে। এজন্য অফশোর ব্যাংকিংকে জনপ্রিয় করতে হলে অবশ্যই কান্ট্রি রেটিংয়ে উন্নতি ঘটানোর পরামর্শ দিয়েছেন তারা। যার উন্নতির জন্য সরকারকেই মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে।
জানা গেছে, আশির দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো সীমিত পরিসরে অফশোর ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি বিস্তৃতি হয়েছে গত এক দশকে। তবে শঙ্কার কারণ হচ্ছে, প্রবাসী ও বিদেশিদের মধ্যে বাংলাদেশের অফশোর ব্যাংকিং খুব বেশি আকর্ষণীয় করা যাচ্ছে না। বরং ডলার সংকটের প্রভাবে গত দুই বছরে অফশোর ব্যাংকিংয়ের সম্পদের আকার সংকুচিত হয়েছে। ২০২১ সাল নাগাদ দেশের ব্যাংকগুলোর অফশোর ব্যাংকিংয়ের সম্পদের আকার ছিল প্রায় ১১ বিলিয়ন ডলার। এখন তা ৭-৮ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। আবার এই যখন পরিস্থিতি তখন বড় শঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে আন্তর্জাতিক বাজারে চড়া সুদহার।
বর্তমানে বেসরকারি খাতে অফশোর ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে শীর্ষ ১০ দেশ থেকে আসছে বিদেশি ঋণ। ব্যবসার প্রয়োজনে করোনার আগে-পরে ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগের অংশ হিসেবে এ ঋণ নিয়েছেন। তালিকায় থাকা শীর্ষ দেশগুলো হলোÑ সংযুক্ত আরব আমিরাত, সিঙ্গাপুর, হংকং, চীন, ভারত, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, স্পেন ও জাপান।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, দেশে বেসরকারি খাতে সবচেয়ে বেশি বিদেশি ঋণ রয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাতের। দেশটি গত মে মাস পর্যন্ত এ খাতে ঋণ দিয়েছে ২ দশমিক শূন্য ২ বিলিয়ন বা ২০২ কোটি ডলার। গত এপ্রিলে এ ঋণের পরিমাণ ছিল ১ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন বা ১৯৮ কোটি ডলার। অর্থাৎ এক মাসের ব্যবধানে দেশটির বাংলাদেশের বেসরকারি খাতের ঋণ বেড়েছে ৪ কোটি ডলার বা ২ শতাংশ।
দেশের বেসরকারি খাতকে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে সিঙ্গাপুর। দেশটি গত মে মাস পর্যন্ত এ খাতে ঋণ দিয়েছে ১৭১ কোটি ডলার বা ১ দশমিক ৭১ বিলিয়ন ডলার। এক মাস আগে এপ্রিলে ঋণের পরিমাণ ছিল ১৭৮ কোটি বা ১ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এক মাসের ব্যবধানে দেশটি থেকে ঋণ কমেছে প্রায় ৪ শতাংশ।
গত মে মাস পর্যন্ত তৃতীয় অবস্থানে থাকা হংকংয়ের বিনিয়োগের পরিমাণ ১১০ কোটি ডলার। আগের মাস এপ্রিলে ছিল ১১৩ কোটি ডলার। অর্থাৎ কমেছে ৩ কোটি ডলার বা ২ দশমিক ৬৫ শতাংশ।
দেশের বেসরকারি খাতে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে চীন। গত মে পর্যন্ত দেশটি এ খাতে ঋণ দিয়েছে ৯৩ দশমিক ৭৭ কোটি ডলার। আগের মাস এপ্রিলে ছিল ৮৯ দশমিক ৩৪ কোটি ডলার। অর্থাৎ ঋণ বেড়েছে প্রায় ৫ শতাংশ।
পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে প্রতিবেশী দেশ ভারত। গত মে পর্যন্ত ভারত বেসরকারি খাতে ঋণ দিয়েছে ৭২ কোটি ৫২ লাখ ডলার। আগের মাস এপ্রিলে যার পরিমাণ ছিল ৬৯ কোটি ১৬ লাখ ডলার। অর্থাৎ ঋণ বেড়েছে প্রায় ৫ শতাংশ।
এ ছাড়া দেশের বেসরকারি খাতে গত মে মাস পর্যন্ত ঋণ বিতরণে শীর্ষ দশে থাকা দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাজ্য ৭০ কোটি ৬০ লাখ, যুক্তরাষ্ট্র ৬৫ কোটি, জার্মানি ৬২ কোটি, স্পেন ২১ কোটি এবং জাপান ১৮ কোটি ডলার দিয়েছে।
তথ্য বলছে, প্রতি বছর বিদেশে অবস্থানকারী বাংলাদেশিরা ব্যাংক খাতের মাধ্যমে ২৩ থেকে ২৪ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স দেশে পাঠাচ্ছেন। এসব রেমিট্যান্স প্রবাসীদের নিজের হিসাব কিংবা স্বজনদের হিসাবে জমা হয়ে নগদ টাকায় রূপান্তর হয়। কোনো প্রবাসী চাইলেও দেশ থেকে রেমিট্যান্সের কোনো অর্থ প্রত্যাবাসনের সুযোগ থাকে না। এখন প্রবাসীদের জন্য ডলারে আমানত রাখার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আকর্ষণীয় মুনাফাও দেওয়া হচ্ছে। এতে ব্যাংকে সংশ্লিষ্টদের হিসাবে মিলিয়ন থেকে বিলিয়ন ডলারও জমা হচ্ছে। কারণ, দেশীয় ব্যাংকেই আন্তর্জাতিক হিসাব খোলার সুযোগ থাকায় বিদেশে অবস্থান করা সত্ত্বেও তার যদি ডলার প্রয়োজন হয়, তিনি এই হিসাব থেকে তার অর্থ তুলে নিতে পারছেন। আবার যত পরিমাণ খুশি তা জমাও রাখতে পারছেন। এর ফলে দেশীয় ব্যাংকগুলোর এই অফশোর ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে সঞ্চিত অর্থ বিদেশি মুদ্রার সংকট দূর করতেও সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানা যায়, অফশোর ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট নিয়ে দেশে বেশ কিছু প্রোডাক্ট আগে থেকেই চালু ছিল। সেখানে এখন নতুন করে আন্তর্জাতিক ব্যাংক হিসাব নামে একটি ডিপোজিট সেবা চালু হয়েছে, যা বিশ্বের যেকোনো স্থানে বসেই অফশোরের ব্যাংক হিসাব খোলার পাশাপাশি সেটি পরিচালনা করার সুযোগ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাশাপাশি বিদেশিরাও এ সুযোগ নিতে পারবেন। তা ছাড়া বর্তমানে এ ব্যাংক হিসাবে মুনাফার হার খুবই আকর্ষণীয়। ডলারের ক্ষেত্রে যা বার্ষিক সাড়ে ৮ শতাংশ পর্যন্ত হয়ে থাকে। আবার হিসাবধারীর অ্যাকাউন্টে এ সুদও মিলবে বৈদেশিক মুদ্রায়। অন্যদিকে আমানতের সুদকে সরকার সম্পূর্ণ করমুক্ত আয় ঘোষণা করেছে। বিশ্ববাজারের সুদহারের তুলনায় দেশে সরকারের এসব ঘোষণা নিঃসন্দেহে বেশ লাভজনক।
সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, অফশোর ব্যাংকিংয়ের সুবিধা নিয়ে বিশ্বের অনেক দেশই তাদের ডলার সংকটসহ আর্থিক খাতের সংকট দূর করতে সক্ষম হয়েছে। এক্ষেত্রে পাকিস্তান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রোশান ডিজিটাল অ্যাকাউন্টকে একটি যুগান্তকারী উদ্যোগ বলে বিবেচনা করা হয়। এর মাধ্যমে প্রবাসী পাকিস্তানিদের ডিজিটাল ব্যাংকিং সুবিধা দেওয়া হয়। দেশটির প্রবাসী জনগোষ্ঠী প্ল্যাটফর্মটি ব্যবহার করে দেশের ব্যাংকের সঙ্গে হিসাব পরিচালনা করতে পারে।
২০২০ সালে তাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক আটটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে এটি শুরু করেছিল। বর্তমানে ১৪টি ব্যাংক এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। তবে এর বিপরীতে বাংলাদেশে অফশোর ব্যাংকিংয়ের সম্ভাবনা সত্ত্বেও তার পরিপূর্ণ সুফল ঘরে তোলার কাঙ্ক্ষিত স্তরে এখনও পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। বিশেষ করে বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার কিছু সরকারি বন্ড চালু থাকলেও যথাযথ প্রচার ও অনলাইন লেনদেনের সুবিধার অভাবে খুব বেশি কার্যকর হয়নি। এখন অফশোর মাধ্যমে এই আন্তর্জাতিক ব্যাংক হিসাব দ্রুত জনপ্রিয় করা গেলে অল্প সময়ের ব্যবধানে ৫-৭ বিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করার সম্ভাবনা রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘অফশোর ব্যাংকের মাধ্যমে অনায়াসেই আমরা প্রতি বছর কয়েক বিলিয়ন ডলারের আমানত আনতে পারব। তবে এ ক্ষেত্রে ভালো ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে এ ব্যাংক ব্যবস্থাকে পরিচালিত করতে হবে। দুর্বল ব্যাংকগুলোকে এ ব্যবস্থা থেকে দূরে রাখা উচিত। যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা পেলে অফশোর ব্যাংক ব্যবস্থা সফল হবে।’
তিনি বলেন, ‘দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে অফশোর ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ঋণ নেওয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেননা এখন ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে স্বাভাবিকভাবেই ১৪ বা ১৫ শতাংশ সুদ দিতে হচ্ছে। কিন্তু অফশোর ব্যাংক ব্যবস্থায় যদি কম সুদে ঋণ পাওয়া যায়; তাহলে ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা উপকৃত হবেন। এতে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে। ডলার প্রবাহ বাড়বে। আমাদের আর্থিক হিসাব ঘুরে দাঁড়াবে। অর্থাৎ ইতিবাচক হবে, যেটি এই মুহূর্তে নেতিবাচক অবস্থানে আছে। আর্থিক হিসাব ইতিবাচক হলে রিজার্ভও বাড়বে। বাজার ব্যবস্থাপনা ও ডলার বিনিময়হার স্থিতিশীল থাকলে অফশোর ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া বেশি সুবিধাজনক হবে।’
ব্যাংকাররা বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর নানা উদ্যোগের ফলে আরএফসিডি (নিবাসী বৈদেশিক মুদ্রা সঞ্চয়) হিসাবের জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছে। তবে এ হিসাবকে আরও জনপ্রিয় করতে অনেক কিছু করার সুযোগ রয়েছে। যেমনÑ এ হিসাবের সুবিধাগুলোর ব্যাপক প্রচার এবং এ বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরি করা যেতে পারে। বিমানবন্দরসহ যেসব পথে নাগরিকরা দেশে প্রত্যাবর্তন করেন, সেখানে লিফলেট বিতরণ, ব্যাংকের বুথ খুলে আরএফসিডি হিসাব খোলা ও বৈদেশিক মুদ্রা জমা-গ্রহণের ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। আবার এফএমজে ফরমের ঘোষণা ছাড়া বৈদেশিক মুদ্রা আনার লিমিট বাড়ানোর উদ্যোগও নেওয়া যায়।