সাক্ষাৎকার
মোসলেহ উদ্দীন আহমেদ
প্রকাশ : ৩১ জুলাই ২০২৪ ১২:১৮ পিএম
আপডেট : ৩১ জুলাই ২০২৪ ১৬:৪৫ পিএম
মোসলেহ উদ্দীন আহমেদ। প্রবা ফটো
শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংক বিশাল দক্ষ কর্মী বাহিনীর মাধ্যমে অফশোর ব্যাংকিং নিয়ে প্রবাসীদের মধ্যে সর্বদা প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন ব্যাংকটির এমডি মোসলেহ উদ্দীন আহমেদ। প্রতিদিনের বাংলাদেশকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এ বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন
প্রশ্ন : অফশোর ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট নিয়ে আপনারা কী ধরনের প্রোডাক্ট চালু করেছেন?
উত্তর : বাংলাদেশে অফশোর ব্যাংকিং ব্যবস্থা নিয়ে নতুন যে আইনটি চূড়ান্ত করা হয়েছে তাতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বৃদ্ধি, রিজার্ভ সংকট ও এলসি খোলার সংকট সমাধানসহ বিদেশি বিনিয়োগ আরও উৎসাহিত হবে বলে মনে করা হচ্ছে। কোনো ব্যক্তি নয়, বরং আন্তর্জাতিক অর্থব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে অফশোর ব্যাংকিং ব্যবস্থা ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলেই এই আইন জরুরি ছিল। নতুন যে বিষয়টি অফশোর ব্যাংকিং সেবায় যুক্ত হয়েছে, সেটি হলো আন্তর্জাতিক ব্যাংক হিসাব। এর ফলে বাংলাদেশে বিনিয়োগকারী অনিবাসী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের মনোনীত নিবাসীর নামে অফশোর অ্যাকাউন্ট খুলতে পারবে। অফশোর ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট নিয়ে আমাদের বেশ কয়েকটি প্রোডাক্ট যেমনÑ মুদারাবা সঞ্চয়ী হিসাব, মুদারাবা মেয়াদি হিসাব, আল-ওয়াদিয়াহ চলতি হিসাব ইত্যাদি আগে থেকেই চালু ছিল। নতুন করে আন্তর্জাতিক ব্যাংক হিসাব নামে একটি ডিপোজিট প্রোডাক্ট চালু করা হয়েছে। বর্তমানে এসব প্রোডাক্টের মুনাফার হার বেশ ভালো। মার্কিন ডলারের ক্ষেত্রে যা প্রায় বার্ষিক ৮.৪০ শতাংশ পর্যন্ত হয়ে থাকে।
প্রশ্ন : এখন পর্যন্ত প্রবাসীদের সাড়া কেমন পেলেন?
উত্তর : প্রবাসীদের ভালো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। তবে তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য একটু সময় নিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। এ বছর আমরা প্রবাসীদের কাছ থেকে ব্যক্তি হিসাবে প্রায় ০.২০ মিলিয়ন এবং বিদেশি প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় ৪৮.৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সংগ্রহ করেছি।
তবে এই সুবিধা আগেও ছিল। কিন্তু এটা নিয়ে তেমন কোনো প্রচার-প্রচারণা ছিল না। বর্তমানে সব ব্যাংকই এটা নিয়ে জোরালোভাবে কাজ করে যাচ্ছে। শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংকের ওপর গ্রাহকদের একটা আস্থা তৈরি হয়েছে। অনেকে এটা নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করছেন। বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে ভালো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। তা ছাড়া ইউরোপ, আমেরিকা ও কানাডা থেকেও ভালো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে।
প্রশ্ন : প্রবাসীদের কাছে অফশোর ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট জনপ্রিয় করে তুলতে আপনাদের পরিকল্পনা জানতে চাই?
উত্তর : শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংক বিশাল দক্ষ কর্মী বাহিনীর মাধ্যমে প্রবাসীদের মধ্যে সর্বদা প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছি। অভ্যন্তরীণ তহবিল সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে স্থানীয় গ্রাহকরা যেভাবে আমাদের ওপর আস্থা রেখে চলেছে ঠিক একইভাবে প্রবাসীরাও শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংকের প্রতি আস্থা রাখবে বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংক ইতোমধ্যে গ্রাহকদের কাছে আস্থার প্রতীক হয়ে উঠেছে। আশা করি বছরান্তে ব্যক্তি গ্রাহকদের কাছ থেকে ২০-২৫ মিলিয়ন ডলারসহ বিদেশি উৎস থেকে প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করা সম্ভব হবে।
প্রশ্ন : প্রবাসীদের মধ্যে দেশের ব্যাংক খাত নিয়ে আস্থার সংকট আছে। এ সংকট কাটাতে কী ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছেন?
উত্তর : সব ব্যাংকের ওপরই যে আস্থার সংকট আছে তা ঠিক নয়। তবে সার্বিকভাবে বলা যায়, দেশের ব্যাংক খাত নিয়ে কিছুটা আস্থার সংকট রয়েছে। নীতিনির্ধারক পর্যায়ে মূল সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিলে আশা করি এ সংকট অচিরেই কেটে যাবে। দুষ্টচক্রদের চিহ্নিত করে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারলে জনগণের অর্থ লুণ্ঠিত হতে পারবে না। অনিয়মিতভাবে গৃহীত ঋণের টাকা ফেরত আনার ব্যবস্থা করতে হবে। ব্যাংক আইনের কঠোর প্রয়োগ এক্ষেত্রে সুফল বয়ে আনতে পারে। সবার সমন্বিত উদ্যোগে প্রবাসীদের মধ্যে দেশের ব্যাংক খাত নিয়ে আস্থার সংকট কাটাতে সাহায্য করবে বলে মনে করি।
প্রশ্ন : আপনার ব্যাংকের আরএফসিডি হিসাবের স্থিতি কেমন?
উত্তর : শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংকে বাংলাদেশে বসবাসকারী নাগরিকদের জন্য আরএফসিডি নামে বৈদেশিক মুদ্রায় হিসাব পরিচালনার সুযোগ রয়েছে। তাদের কার্ড প্রদানসহ অন্যান্য সুবিধা প্রদান করা হয়ে থাকে। মূলত বাংলাদেশি নাগরিকরা বিদেশ ভ্রমণ করে দেশে প্রত্যাবর্তনের সময় সঙ্গে বহন করা অনধিক ১০ হাজার মার্কিন ডলার বা সমমূল্যের বৈদেশিক মুদ্রা কোনো ধরনের ঘোষণা প্রদান ছাড়াই এবং তার বেশি হলে নির্ধারিত ফর্মে যথাযথ ঘোষণা প্রদানসাপেক্ষে এবং নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ব্যাংকে তার নামে আরএফসিডি অ্যাকাউন্টে জমা করতে পারেন এবং পরে মুনাফাসহ সমুদয় অর্থ বিদেশে প্রেরণ করতে অথবা ভ্রমণের সময় সঙ্গে নিয়ে যেতে পারেন। বর্তমানে আমাদের ব্যাংকের আরএফসিডি হিসাবের স্থিতি প্রায় ০.৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা সামনের দিনে আরও বাড়বে বলে আশা করছি।
প্রশ্ন : আরএফসিডি হিসাবকে জনপ্রিয় করতে আরও কী ধরনের উদ্যোগ নেওয়া উচিত?
উত্তর : কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ বাংলাদেশের কমার্শিয়াল ব্যাংকগুলোর নানামুখী উদ্যোগের ফলে আরএফসিডি হিসাবের জনপ্রিয়তা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে এ হিসাবকে আরও জনপ্রিয় করতে অনেক কিছুই করার সুযোগ রয়েছে যেমনÑ এই হিসাবের সুবিধাসমূহের ব্যাপক প্রচার ও এ বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরি করা। পোর্টসমূহে যে পথ দিয়ে নাগরিকরা দেশে প্রত্যাবর্তন করেন সেখানে লিফলেট বিতরণ, ব্যাংকের বুথ খুলে আরএফসিডি হিসাব খোলা ও বৈদেশিক মুদ্রা জমাগ্রহণ করার ব্যবস্থা করা। এফএমজে ফর্মের ঘোষণা ছাড়া বৈদেশিক মুদ্রা আনার লিমিট বাড়ানো ইত্যাদি।
প্রশ্ন : ‘রোশান ডিজিটাল অ্যাকাউন্ট’ নামে প্রবাসীদের জন্য অফশোর ব্যাংকিং হিসাব চালু করেছে পাকিস্তান। এরই মধ্যে প্রোডাক্টটির মাধ্যমে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার সংগ্রহ হয়েছে। বাংলাদেশে এটি জনপ্রিয় করে তুলতে পারলে কত বিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করার সম্ভাবনা দেখছেন?
উত্তর : ‘রোশান ডিজিটাল অ্যাকাউন্ট’ পাকিস্তান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি যুগান্তকারী উদ্যোগ বলে বিবেচনা করা হয়। এর মাধ্যমে প্রবাসীদের ডিজিটাল ব্যাংকিং সুবিধা প্রদান করা হয়। ওই দেশের প্রবাসী জনগোষ্ঠী এই প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে ব্যাংকের সঙ্গে হিসাব পরিচালনা করতে পারে। ২০২০ সালে তাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ৮টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে এটা শুরু করে। বর্তমানে ১৪টি ব্যাংক এই সুবিধার সঙ্গে যুক্ত। বাংলাদেশে এ রূপ কিছু সরকারি বৈদেশিক মুদ্রার বন্ড চালু থাকলেও যথাযথ প্রচারণা ও অনলাইন লেনদেনের সুবিধার অভাবে বেশি কার্যকর হয়নি। তবে বাংলাদেশেও এ ধরনের একটি উদ্যোগ জরুরি বলে মনে হয় এবং এটি জনপ্রিয় করে তুলতে পারলে ৫-৭ বিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করার সম্ভাবনা রয়েছে।
প্রশ্ন : এর মাধ্যমে দেশের ডলার সংকট কতটুকু কাটবে বলে মনে করছেন?
উত্তর : ডলার সংকট কাটাতে অফশোর ব্যাংকিংয়ের ভূমিকা অপরিসীম। অফশোর ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বহির্বিশ্ব থেকে প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রায় তহবিল সংগ্রহ করে বৈদেশিক মুদ্রাতেই কম মুনাফায় বিনিয়োগের মাধ্যমে দেশের তারল্যের চাহিদা হ্রাস করা সর্বোপরি দেশীয় মুদ্রার মুনাফার হার কমানো সম্ভব হয়। অফশোর ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রায় তহবিল সংগ্রহ করে দেশের রিজার্ভ বৃদ্ধিতেও ভূমিকা রাখা যায়। তাই বর্তমান বৈদেশিক মুদ্রার সংকট কাটাতে অফশোর ব্যাংকিংই সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করি।