রেদওয়ানুল হক
প্রকাশ : ১৪ জুলাই ২০২৪ ০৯:০২ এএম
আপডেট : ১৪ জুলাই ২০২৪ ০৯:০৪ এএম
দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তির অন্যতম একটি খাত রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়। কিন্তু এ মূল্যবান সম্পদ যাদের মাধ্যমে অর্জিত হয়, তাদের অভিবাসনে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাব ব্যাপক। বিদেশে কর্মসংস্থান বাড়াতে সরকার উদ্যোগী হলেও নানা সমস্যার বেড়াজালে পদে পদে হয়রানির শিকার হন অভিবাসনপ্রত্যাশীরা। বৈধ-অবৈধ উপায়ে তাদের কাছ থেকে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হয়। এতে একজন কর্মীর বিদেশে যেতে স্বাভাবিকের চেয়ে ৪ থেকে ৫ গুণ বেশি অর্থ খরচ করতে হয়। এর ফলে ঋণের বৃত্তে আটকা পড়ে বেশিরভাগ প্রবাসীর পরিবার। জমিজমা বিক্রি করে নিঃস্ব হয়ে পড়েন অনেকে। সামান্য দুর্ঘটনায় পথে বসে যায় পুরো পরিবার। তাই দেখা যায়, ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রবাসে গিয়ে অনেকেই তাদের জীবনে চরম দুর্ভাগ্য ডেকে আনেন। আবার বিদেশে গিয়ে উপার্জিত অর্থ পরিবারের কাছে পাঠাতেও তাদেরকে দুর্ভোগ পোহাতে হয়। গুনতে হয় অন্য দেশের চেয়ে অনেক বেশি ফি।
জানা গেছে, কাজের সন্ধানে বিদেশে যেতে প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের মানুষের কয়েকগুণ বেশি অর্থ খরচ করতে হয়। এই অতিরিক্ত খরচের কারণেই ঋণের চক্রে আটকা পড়ে যায় প্রবাসে গমনেচ্ছুদের পরিবার। যদিও রেমিট্যান্সের চাহিদা বিবেচনায় সরকারি ব্যবস্থাপনায় বিদেশে কর্মী পাঠানো সহজ ও সাশ্রয়ী হওয়া কথা ছিল; কিন্তু হয়েছে ঠিক উল্টো। অভিবাসনপ্রত্যাশীদের কাছ থেকে নানাভাবে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেন সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর একশ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারী। দালাল, এজেন্সি ও সরকারি লাইসেন্সধারী সিন্ডিকেটের খপ্পরে পড়ে নিঃস্ব হন অনেকেই।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নওগাঁর আত্রাই উপজেলার তিন শ্রমিক ধারদেনা করে সৌদি আরবে যান। চলতি বছরের ৩ জুলাই সেখানে সোফা তৈরির কারখানায় আগুনে পুড়ে তারা নিহত হয়েছেন। মৃত ওই তিন ব্যক্তি হলেনÑ আত্রাই উপজেলার তেজনন্দি গ্রামের মজিবর রহমানের ছেলে ফারুক হোসেন, শিকারপুর গ্রামের সাহাদ আলীর ছেলে এনামুল হোসেন এবং দিঘা স্কুলপাড়া গ্রামের কবেজ আলীর ছেলে শুকবর আলী। তাদের মৃত্যুর সঙ্গে থেমে গেছে পরিবারগুলোর ভাগ্যের চাকাও। কারণ এরা সবাই জমিজমা বিক্রি করে এবং মোটা অঙ্কের ঋণ নিয়ে বিদেশে গেছেন। পরিবারের হাল ধরতে বিদেশে গিয়ে দুর্ঘটনায় প্রাণও গেছে, পরিবারও নিঃস্ব হয়েছে। স্বজনরা জানিয়েছেন, জমি বিক্রি করে যে টাকা পাওয়া গেছে তা দিয়ে পুরো খরচ মেটানো যায়নি। তাই বাধ্য হয়ে ঋণ করতে হয়েছিল। বিদেশ যাওয়ার পথে ধাপে ধাপে খরচ এতটাই বেড়েছে, যা কল্পনাও করেনি ওইসব পরিবার।
এদিকে ফ্রি ভিসায় ওমানে যান পিরোজপুরের বানিয়ারি এলাকার দিপঙ্কর। নিজের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বিক্রি করে দেন। এছাড়া জায়গা-জমিও বন্ধক রাখেন। একই সঙ্গে কাঁধে তুলে নেন মোটা অঙ্কের ঋণের বোঝা। দালালের মাধ্যমে বিদেশে পাড়ি দিয়ে পড়েন বেকায়দায়। এক বছরে তাকে দেওয়া হয়নি কোনো কাজ। কখনও কখনও না খেয়ে দিন পার করতে হয়েছে। বিদেশের মাটিতে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ ও প্রতারণার শিকার হয়ে সম্প্রতি কোনো রকমে জীবন নিয়ে দেশে ফিরে এসেছেন তিনি। এসেই পড়ে গেছেন পাওনাদারদের চাপের মুখে। সর্বস্ব হারিয়ে দেশে এসে এখন ঋণের টাকা পরিশোধে শেষ সম্বল ভিটেমাটিও হারানোর ভয়ে আছেন দিপঙ্কর। তার মতো দেশের লাখ লাখ শ্রমিক প্রতিবছর মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কাজের উদ্দেশ্যে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে ফিরে আসছেন। ফিরেও রক্ষা নেই। টানতে হচ্ছে দেনা পরিশোধের ঘানি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও সানেমের গবেষণা পরিচালক সায়মা হক বিদিশা প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘প্রবাসীদের খরচ কমাতে সরকার দুটি কাজ করতে পারে। লাইসেন্সপ্রাপ্ত এজেন্সিগুলো যৌক্তিক খরচ নিচ্ছে কি নাÑ সেটি তদারকি করা এবং জনসাধারণকে সচেতন করার মাধ্যমে অবৈধ পথে বিদেশযাত্রা বন্ধ করা। এছাড়া বিশেষ তহবিল গঠনের মাধ্যমে কম সুদে ঋণ দেওয়া এবং বিশেষ বিমান ও টিকিটের মূল্য কমানোর মাধ্যমে খরচ কমিয়ে আনা যেতে পারে।’
জানা যায়, দক্ষ কর্মী বিদেশে পাঠালে খরচ কম হয়। কারণ দক্ষ কর্মীর ভিসার দাম কম। কিন্তু বাংলাদেশের অধিকাংশ জনশক্তি রপ্তানি হয় লেবার, হেলপার ও ক্লিনার ভিসায়। এসব ভিসার চাহিদা বেশি, দামও বেশি। অথচ অন্য দেশে এসব ভিসা কিনতেই হয় না, কিনলেও দাম খুব কম। পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে যে ভিসা ৩ হাজার রিঙ্গিতে পাওয়া যায়, বাংলাদেশের এজেন্সিগুলোকে সেটি কিনতে ৬ থেকে ৮ হাজার রিঙ্গিত খরচ করতে হয়। বর্তমানে প্রবাসীরাও ভিসা কেনে। এরপর এজেন্সি কিংবা আত্মীয়-স্বজনের কাছে চড়া দামে বিক্রি করে। এর কারণে খরচ বেড়ে যায়। ভিসার দাম ছাড়াও কয়েক দফায় খরচ বাড়ে।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, ‘ভিসা সংগ্রহের পর বাংলাদেশ এম্বাসি থেকে ছাড়পত্র নিতে হয়। সেখানে প্রক্রিয়াটি এত জটিল যে, দালাল ছাড়া কাজ হয় না। দালালেরা নির্ধারিত সময়ে ছাড়পত্র দিতে মোটা অঙ্কের অর্থ নেয়। এরপর জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো থেকে ছাড়পত্র (এজেন্সির ভাষায় ম্যানপাওয়ার করানো) নিতে যেতে হয় সিন্ডিকেটের কাছে। ই-ভিসা করতে ৪ হাজার এবং ম্যানপাওয়ারের জন্য ৫ হাজার টাকা খরচ হওয়ার কথা। কিন্তু সিন্ডিকেটকে দিতে হয় ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা। এর আগে কোটা নিতেও দিতে হয় ২ হাজার ৬০০ টাকা। এটিই শেষ নয়, মেডিকেল করতেও যেতে হয় সিন্ডিকেটের কাছে। তাদের নির্ধারিত মেডিকেল সেন্টারে ১ হাজার টাকার মেডিকেলে খরচ গুনতে হয় ১০ হাজার টাকা। আর ছোটখাটো সমস্যা দেখা গেলে তো কথাই নেই। গলাকাটার মতো ২০ থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করে নিয়ে দেওয়া হয় মেডিকেল সার্টিফিকেট। এর আগে পাসপোর্ট করতে নির্ধারিত খরচের চেয়ে ২ থেকে ৩ গুণ গুনতে হয়। সবশেষে চলে বিমানের টিকিট নিয়ে নৈরাজ্য। ২২ থেকে ৩০ হাজার টাকার টিকিট কিনতে খরচ হয় দেড় লাখ টাকার বেশি। এর বাইরে দালালরা টাকা নেয় পদে পদে। সব মিলিয়ে প্রবাসে যেতে নির্ধারিত অঙ্কের চেয়ে ৪ থেকে ৫ গুণ টাকা খরচ হয়। আর এ টাকা জমিজমা বিক্রি করে জোগাড় করতে হয়। যাদের জমি নেই, তারা ঋণ করেন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জরিপে দেখা যায়, দেশের মোট অভিবাসীর মধ্যে ঋণ করে প্রবাসে যাওয়ার সংখ্যা ৫৮ দশমিক ২৪ শতাংশ। এর মধ্যে গ্রামের মানুষ ঋণ করে প্রবাসে যায় ৬০ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ এবং শহর এলাকার ৫১ দশমিক ৮৩ শতাংশ। লৈঙ্গিক দৃষ্টিতে দেখা যায়, ৫৮ দশমিক ৭৪ শতাংশ পুরুষই ঋণ করে প্রবাসে যায়। আর নারীর ক্ষেত্রে এ সংখ্যা ৩৭ দশমিক ৯৮ শতাংশ।
বেসরকারি সংস্থাÑ রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারপারসন অধ্যাপক ড. তাসনিম সিদ্দিকী প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, আমরা অদক্ষ শ্রমিক পাঠাচ্ছি বেশি। এ খাতে চাহিদা বেশি থাকার কারণে এজেন্সিগুলো ফায়দা নিচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে ব্যয় বেঁধে দিয়ে খরচ কমানো সম্ভব নয়। সরকারের উচিত দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে দক্ষ শ্রমিক পাঠানোর ব্যবস্থা করা। দেশে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি এজেন্সিকে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। কঠোরভাবে এদের তদারকি হয় না। প্রতারিত হয়ে ফিরে আসার ঘটনায় ওই এজেন্সিগুলোকে কেন শাস্তির আওতায় নেওয়া হয় নাÑ এ প্রশ্নও রাখেননি তিনি।
আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে দক্ষ জনশক্তি সরবরাহ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে প্রশিক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনেক অভিবাসী আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে নিজেকে যোগ্য করার জন্য বিদেশ যাওয়ার আগে তার কর্মসংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে থাকেন। যারা দক্ষ হয়ে বিদেশে যেতে চান, তাদের খরচ শুরু হয় ভিসা প্রক্রিয়া শুরুর আগেই। প্রশিক্ষণ নিতে মোটা অঙ্কের অর্থ খরচ হয়ে যায়। এমনকি অনেকের সেই প্রশিক্ষণের টাকাও জোগাড় হয় ঋণ থেকে।
বর্তমানে সরকারি, বেসরকারি অনেক সংস্থা এ ধরনের প্রশিক্ষণ কোর্স পরিচালনা করছে। আন্তর্জাতিক অভিবাসীদের মধ্যে বিদেশ যাওয়ার আগে কর্মসংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণকারী এবং প্রশিক্ষণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান-সংক্রান্ত উপাত্ত পল্লী-শহর ও বিভাগভিত্তিক উপস্থাপন করা হয়েছে বিবিএসের প্রতিবেদনে।
প্রদত্ত উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিদেশ যাওয়ার আগে প্রশিক্ষণ গ্রহণকারী মোট অভিবাসীর সর্বোচ্চ ৪৭ দশমিক ৬৬ শতাংশ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছে। এ হার পল্লী ও শহর এলাকায় যথাক্রমে ৪৫ দশমিক ৭৩ শতাংশ এবং ৫৩ দশমিক ৬৫ শতাংশ। এ ছাড়া প্রশিক্ষণ গ্রহণকারী মোট অভিবাসীর ৪০ দশমিক ৫৪ শতাংশ সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছে, যা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। এ হার পল্লী এলাকায় ৪২ দশমিক ৭৩ শতাংশ ও শহরাঞ্চলে ৩৩ দশমিক ৭০ শতাংশ। সাধারণত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণ নিতে খরচ অনেক বেশি হয়। আর সরকারি প্রতিষ্ঠানে খরচ কম হলেও বিভিন্ন অজুহাতে খরচ বাড়তে থাকে।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির (বায়রা) সাধারণ সম্পাদক আলী হায়দার চৌধুরী সম্প্রতি প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনা করলে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে যাওয়ার খরচ খুব বেশি নয়। কিন্তু মধ্যস্বত্বভোগী তথা কয়েকবার হাতবদলের কারণে ভিসার দাম বেড়ে যায়।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে জনশক্তি রপ্তানি খাতে যে দালালপ্রথা দীর্ঘ সময় ধরে চলে আসছে তা থেকে বের হয়ে আসা কঠিন। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে খরচ বেশি হচ্ছে।’
তবে নাম প্রকাশ না করে বায়রার একজন সদস্য প্রতিদিনের বাংলাদেশের কাছে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেছেন। সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্যের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করে তিনি বলেন, ‘দালাল আছে এটা ঠিক; কিন্তু এজেন্সির খরচই অন্য দেশের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। ভিসা কিনতে দ্বিগুণেরও বেশি খরচ হয়।’ এজেন্সিগুলোর ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই উল্লেখ করে বায়রার এ সদস্য বলেন, ‘প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। তাই ভিসার চাহিদা বেশি। অন্যান্য দেশে নির্ধারিত মূল্যের বেশি দাম নিলে লাইসেন্স বাতিল হয়ে যায়। কিন্তু আমাদের দেশে তদারকি হয় না।’
ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘বাস্তবতা হলো সব সিন্ডিকেটের সঙ্গে সরকার ও প্রশাসনের ওপর মহলও জড়িত। তাদের ভাড়াটে লোক দিয়ে পদে পদে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। জমিজমা বিক্রি কিংবা ঋণ করে টাকা দেয় গরিব মানুষ; আর গালি শোনে এজেন্সির লোকেরা। সরকার ও প্রশাসনের লোকেরা থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে।’
দালালের আধিপত্য
প্রবাসীদের জন্য সরকারি ব্যবস্থাপনায় সহজ কোনো পদ্ধতি না থাকায় দালালের দ্বারস্থ হতে হয়। বিবিএসের প্রতিবেদনের উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায়, আন্তর্জাতিক অভিবাসীদের মধ্যে সর্বোচ্চ ৫২ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ অভিবাসন ব্যয় বাবদ অর্থ দালালকে দিয়েছে। যা পল্লী ও শহর এলাকার ক্ষেত্রে যথাক্রমে ৫৩ দশমিক ১০ শতাংশ এবং ৪৮ দশমিক ২৫ শতাংশ। অন্যদিকে দেশের ৪২ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ অভিবাসী এ-সংক্রান্ত ব্যয়ের অর্থ প্রাইভেট কোম্পানি অথবা এজেন্সিকে এবং মাত্র ৩ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ সরকারি প্রতিষ্ঠানকে প্রদান করেছে। অর্থাৎ গ্রাম কিংবা শহর কোথাও সরকারি প্রতিষ্ঠানের সেবা নেওয়ার বিষয়ে আগ্রহ দেখান না অভিবাসীরা। অব্যবস্থাপনা ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অসহযোগিতা এক্ষেত্রে প্রধান বাধা। ফলে কয়েকগুণ বেশি অর্থ খরচ করতে হয় অভিবাসীদের।
পদে পদে হয়রানি
শুধু ভিসা প্রক্রিয় নয়, বিমানবন্দরে প্রবেশের শুরু থেকেও নানাভাবে হয়রানির শিকার হন অভিবাসীরা। সংশ্লিষ্টদের অসহযোগিতা ও অসদাচরণ তাদের নিত্যসঙ্গী। ক্ষেত্রবিশেষে ঘুষ দিয়ে সেবা নিতে হয়। বহন করা বিভিন্ন পণ্য ছাড় করতেও ঘুষ দিতে হয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রবাসীরা দেশ থেকে ওষুধ এবং বিভিন্ন খাবার; যেমন হরেক পদের আচার, ফল ইত্যাদি সঙ্গে করে নেন। অনেকে নিজের ব্যবহার্য বিভিন্ন জিনিসও দেশ থেকে নিয়ে যেতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। কিন্তু কারণে অকারণে এসব জিনিসপত্র বিমানবন্দরে আটকে দেওয়া হয়। পরে ঘুষ দিলে আবার ঠিকই ছেড়ে দেওয়া হয়। তাছাড়া গ্রামের সাধারণ মানুষ বিভিন্ন নিয়মকানুন বুঝতে অসুবিধায় পড়ে। অনেকে ইংরেজি লেখা পড়তে পারেন না; তাই ভুল করে ফেলেন। এসব ক্ষেত্রে সহযোগিতার পরিবর্তে উল্টো হয়রানি ও অপমানের শিকার হন অভিবাসীরা। অনেক অভিবাসী তাদের মালামাল ঠিকমতো বুঝে পান না। প্রায়ই তাদের গুরুত্বপূর্ণ মালামাল হারিয়ে যায়। সেগুলো ফেরত পেতে যথাযথ সহায়তা না পাওয়ার অভিযোগও রয়েছে তাদের।
রেমিট্যান্স পাঠাতে গিয়েও হয়রানি
অনেক কষ্ট ও বাধাবিপত্তি পেরিয়ে বিদেশে যাওয়ার পর উপার্জিত অর্থ দেশে পাঠাতে গিয়েও নানা হয়রানির শিকার হন প্রবাসীরা। প্রথমত, দেশে থাকা তার আত্মীয়দের ব্যাংক হিসাব খুলতে যেসব কাগজপত্র লাগে, সেসব জোগাড় করতে নানারকম হয়রানি পোহাতে হয়। জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্ম নিবন্ধনসহ আনুষঙ্গিক কাগজপত্র জোগাড় করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়। আবার ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ পাঠাতে সময়ও বেশি লাগে। তাছাড়া বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে রেমিট্যান্স পাঠাতে বেশি খরচ হয় প্রবাসীদের।
তথ্য বলছে, বাংলাদেশে রেমিট্যান্স পাঠানোর ব্যয় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর তুলনায় অনেক বেশি। বিশেষত, গত বছরের শেষ প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) এ ব্যয় বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্বব্যাপী অভিবাসন নিয়ে কাজ করা ‘দ্য গ্লোবাল নলেজ পার্টনারশিপ অন মাইগ্রেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’ তথা নোমাদের সাম্প্রতিক প্রকাশিত প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। বিশ্বব্যাংকের সহযোগী এ সংস্থাটির প্রতিবেদনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ২০০ ডলার পাঠানোর তুলনামূলক ব্যয়ের হিসাব তুলে ধরা হয়েছে।
এতে দেখা যায়, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় ২০২২ সালের শেষ প্রান্তিকের তুলনায় গত বছরের শেষ প্রান্তিকে রেমিট্যান্স পাঠানোর ব্যয় বেড়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে বাংলাদেশে রেমিট্যান্স পাঠানোর ব্যয়। এছাড়া বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় রেমিট্যান্স পাঠানোর সবচেয়ে ব্যয়বহুল পাঁচটি রুটের মধ্যে তিনটিই বাংলাদেশের। এগুলো হলো : সিঙ্গাপুর-বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া-বাংলাদেশ ও সংযুক্ত আরব আমিরাত-বাংলাদেশ। এসব রুটে অন্য দেশের তুলনায় ৪ থেকে ৬ গুণ বেশি অর্থ খরচ হয়। আর আগের বছরে তুলনায় গত বছর খরচ বেড়েছে দেড় গুণেরও বেশি।