ইভ্যালির জালিয়াতি
আলাউদ্দিন আরিফ
প্রকাশ : ১৩ জুলাই ২০২৪ ১১:২৪ এএম
আপডেট : ১৪ জুলাই ২০২৪ ১৮:৩১ পিএম
‘আমার ছেলে এরফান আহমেদ সামী চৌধুরী। মেধাবী ছিল, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত। বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে আমাকে না জানিয়ে সুদে টাকা নিয়ে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালিতে বিনিয়োগ করে। ঝামেলা শুরু হলে ই-ভ্যালির রাসেল সাহেব তার পাওনা ১১ লাখ টাকা দুটি চেকের মাধ্যমে দেন। চেক দেওয়ার তিন দিন পর রাসেল গ্রেপ্তার হন। ছেলে তখন আমাকে বলে ‘বাবা, আমি তো শেষ, সুদে টাকা নিয়ে ই-ভ্যালিতে বিনিয়োগ করেছি। ছেলেকে বললাম, বাবা চিন্তা কইরো না; আল্লাহ একটা ব্যবস্থা করে দিবেন। এরপর থেকে ছেলে আমাদের সঙ্গে তেমন যোগাযোগ করত না। কয়েকদিন পর আমার ছেলে পাওনা টাকা দিতে না পেরে লোকজনের চাপে আত্মহত্যা করেছে। এখন রাসেল সাহেবের কাছে অনুরোধ, তিনি যেন চেক দুটি ক্যাশ করে দেন। আমি মানুষের টাকা দিয়ে দেনামুক্ত হই।’ চোখের পানি ফেলে কথাগুলো বলছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী আরফান আহমেদ সামী চৌধুরীর বাবা শফি আহমেদ। তার বাড়ি ফেনী জেলার মহিপালের চৌধুরীবাড়ি। ২৮ বছর বয়সি সামী গত বছরের ১৯ জুন চট্টগ্রাম মহানগরীর আকবর শাহ থানার একটি বাসায় গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন।
একইভাবে ইভ্যালিতে অর্ডার করা পণ্য না পেয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের এক ভিডিওবার্তায় কেএম ধ্রুব নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমি নিজের সঙ্গে পেরে উঠছি না। যদি শুনতে পান; আমি আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছি, তাহলে বুঝবেন এর জন্য সম্পূর্ণ দায়ী ইভ্যালি।’ ‘কেএম ধ্রুব’ নামের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে ৮ মিনিট ৮ সেকেন্ডের ভিডিওতে ওই শিক্ষার্থী এসব কথা বলেন। ধ্রুব শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার শুভ গ্রামের ওবায়দুল হকের ছেলে।
এভাবে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির কাছে পাওনা টাকা না পেয়ে হতাশায় দিন পার করছে প্রায় ৪২ লাখ গ্রাহক ও কয়েক হাজার মার্চেন্ট। পণ্য ও চেক মিলিয়ে ইভ্যালিতে তাদের পাওনা হাজার কোটি টাকা। তবে ইভ্যালির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রাসেল বলছেন, ইভ্যালির কাছে গ্রাহকের পাওনা ৩০০ কোটি টাকার বেশি নয়। আর মার্চেন্টদের পাওনা ২০৫ কোটি ৮৬ লাখ ৮৪ হাজার ৩৮৩ টাকা।
সম্প্রতি নতুন করে ব্যবসা শুরু করেছে ইভ্যালি। খুঁজছে নতুন বিনিয়োগকারী। তবে আগের মতো সাড়া মিলছে না। এই অবস্থায় প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রাসেল বলেন, ‘আমরা সীমিত পরিসরে নতুন করে ব্যবসা শুরু করেছি। লোকজনের পাওনাও দিচ্ছি। আশা করছি, ঘুরে দাঁড়াতে পারব।’
২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠার পর দুই-তিন মাসের আগাম সময় নিয়ে প্রায় অর্ধেক মূল্যে পণ্য সরবরাহের বিভিন্ন ‘লোভনীয় অফার’ দিতে শুরু করেছিল ইভ্যালি। অল্প সময়ের মধ্যে সারা দেশ থেকে মোটরসাইকেল, ফ্রিজ, এসি, প্রাইভেটকারসহ নানা পণ্যের ক্রেতারা হুমড়ি খেয়ে পড়ে ইভ্যালিতে। স্বল্প মূল্যের এসব পণ্যের জন্য টাকা নেওয়া হতো অগ্রিম। কিন্তু কিছু ক্রেতাকে পণ্য দিয়ে বাকিদের অপেক্ষায় রাখার অপকৌশল নেয় প্রতিষ্ঠানটি। এসব অনিয়ম নিয়ে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে নানা কথা উঠলেও তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ই-কমার্স ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে যথাযথ আইন ও নীতিমালা না থাকায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াও সম্ভব হয়নি। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে গ্রাহক হয়রানি ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগের পাহাড় জমতে থাকে। একপর্যায়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে বাংলাদেশ ব্যাংক ইভ্যালির বিষয়ে একটি প্রতিবেদন দাখিল করে। ২০২১ সালের ১৪ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘ইভ্যালি ডটকমের মোট সম্পদ ছিল ৯১ কোটি ৬৯ লাখ ৪২ হাজার ৮৪৬ টাকা (চলতি সম্পদ ৬৫ কোটি ১৭ লাখ ৮৩ হাজার ৭৩৬ টাকা) এবং মোট দায় ৪০৭ কোটি ১৮ লাখ ৪৮ হাজার ৯৯৪ টাকা। এর মধ্যে গ্রাহকের কাছে ইভ্যালির দায় ২১৩ কোটি ৯৪ লাখ ৬ হাজার ৫৬০ টাকা এবং মার্চেন্টের কাছে দায় ১৮৯ কোটি ৮৫ লাখ ৯৫ হাজার ৩৫৪ টাকা। ওই প্রতিবেদন পাওয়ার পর ইভ্যালির বিরুদ্ধে তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে দুদককে অনুরোধ করা হয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে। তবে মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনটি পূর্ণাঙ্গ ছিল না বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অপর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ইভ্যালির কাছে মার্চেন্টদের পাওনা ২০৫ কোটি ৮৬ লাখ ৮৪ হাজার ৩৮৩ টাকা। পণ্য ও ইভ্যালি কর্তৃপক্ষের দেওয়া চেক নগদায়ন করতে না পেরে ভুক্তভোগী গ্রাহকরা ভোক্তা অধিকার, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে হাজারো অভিযোগ দেয়।
ইভ্যালির একজন গ্রাহক বলেন, মন্ত্রণালয় থেকে যেসব প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর তথ্য পূর্ণাঙ্গ নয়। কারণ ৪২ লাখ ইউনিক গ্রাহকের সবাই ইভ্যালির কাছে কমবেশি টাকা পাবে। এই হিসাবে টাকার পরিমাণ অনেক। এছাড়া মার্চেন্টরা পাবে আরও কয়েকশ কোটি টাকা।
এসব পাওনা আদায়ের লক্ষ্যে দেশের বিভিন্ন জেলায় ইভ্যালি কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে মামলা করেন গ্রাহকরা। ওই অবস্থায় ২০২১ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর ইভ্যালির এমডি রাসেল ও তার স্ত্রী কোম্পানির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। এরপর চেক জালিয়াতি, টাকা দিয়ে পণ্য না পাওয়াসহ নানা অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে সারা দেশে সিরিজ মামলা হয়। ইভ্যালির পুনর্গঠন হিসাব-নিকাশের সুবিধার্থে চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিনকে গ্রেপ্তারের এক বছরের মাথায় শর্তসাপেক্ষে জামিন দিয়েছিলেন আদালত। পরবর্তীতে ২০২৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর জামিনে মুক্ত হন ইভ্যালির প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ রাসেল। এরপর আবারও ব্যবসা শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। গ্রাহকদের আস্থা অর্জনে ‘বিগ ব্যাং’ ক্যাম্পেইনসহ নানা অফার ও পাওনা টাকা পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দেন তিনি।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) সূত্র জানায়, গ্রেপ্তার হওয়ার আগে ও পরে এই দম্পতির বিরুদ্ধে চেক জালিয়াতি ও অন্যান্য প্রতারণার দায়ে দেশে সাড়ে তিনশরও বেশি মামলা হয়েছিল। এসবের মধ্যে ১৬ মামলায় রাসেলকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
ইভ্যালির বিরুদ্ধে অনেক মামলা ও ভোক্তা অধিদপ্তরে বহু অভিযোগ জমা পড়েছে। তবে অনেক গ্রাহক কোনো অভিযোগ করেননি। এরকমই একজন গণমাধ্যমকর্মী আরাফাত বলেন, আমি দুই চেকে ৭ লাখ টাকা পাব। আমার টাকা ফেরত পাওয়ার বিষয়টি এখনও অনিশ্চিত। বিভিন্ন মাধ্যমে টাকা ফেরত পাওয়ার চেষ্টা করছি।
ভোক্তায় অভিযোগের পাহাড়
ইভ্যালির বিরুদ্ধে ভোক্তা অধিদপ্তরে প্রায় সাত হাজারের বেশি অভিযোগ জমা পড়ে। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় অভিযোগগুলো নিষ্পত্তিও হচ্ছে না। অভিযোগের বাইরেও ইভ্যালির পণ্য না পাওয়া গ্রাহক সংখ্যা অনেক বেশি। গত ৫ মার্চ জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিপ্তরের অভিযোগ নিষ্পত্তির মাধ্যমে দ্বিতীয় দফায় ইভ্যালি ১০০ জন গ্রাহককে তাদের পাওনা টাকা ফেরত দেয়। এর আগে গত ৪ ফেব্রুয়ারি, জানুয়ারি মাসের আয়ের টাকার লাভের অংশ থেকে প্রথম দফায় ১৫০ জনের পাওনা ফেরত দিয়েছিল ইভ্যালি। ইভ্যালির ওয়েবসাইট ও ফেসবুক পেজে গিয়ে দেখা যায়, ইলেকট্রনিক ডিভাইস, ঘড়ি, ফ্যাশন পণ্য, হোম এপ্লায়েন্সসহ বিভিন্ন পণ্যের মজুদ রয়েছে সেখানে। ভোক্তা অধিকারে যারা অভিযোগ দিয়েছিলেন, তাদের ধীরে ধীরে অর্থ পরিশোধ করছে ইভ্যালি।
চার বছরেও অনুসন্ধান প্রতিবেদন দেয়নি দুদক
গ্রাহকের কাছ থেকে নেওয়া অগ্রিম এবং মার্চেন্টের পাওনা ৩৩৮ কোটি ৬২ লাখ টাকা ‘আত্মসাৎ ও পাচারের’ অভিযোগে ইতোমধ্যে ইভ্যালির বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক। এর অংশ হিসেবে রাসেল ও তার স্ত্রীর দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। ২০২১ সালে দুদকের সহকারী পরিচালক মামুনুর রশীদ চৌধুরীর নেতৃত্বে দুই সদস্যের একটি অনুসন্ধান দল গঠন করে কমিশন। আরেক সদস্য হলেন দুদকের উপসহকারী পরিচালক শিহাব সালাম। বিধি অনুসারে তারা ১৮০ কর্মদিবসের মধ্যে কমিশনে অনুসন্ধান প্রতিবেদন দেওয়ার কথা। কিন্তু তা হয়নি।
জানা গেছে, সহকারী পরিচালক মামুনুর রশীদ চৌধুরী পটুয়াখালীতে বদলি হওয়ার পর উপপরিচালক আব্দুল মাজেদের নেতৃত্বে সহকারী পরিচালক সহিদুর রহমান ও রাবিকুল হায়াতের সমন্বয়ে টিম পুনর্গঠন করে দুদক। কিন্তু প্রায় সাড়ে তিন বছর পেরিয়ে গেলেও দুদক এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিবেদন দাখিল বা মামলার সুপারিশ করেনি।
জানতে চাইলে অনুসন্ধান কমিটির একজন সদস্য বলেন, আমরা ব্যাংক ও মন্ত্রণালয়ে নথিপত্র চেয়ে বারবার তাগাদা দিচ্ছি। কিন্তু ব্যাংক ও মন্ত্রণালয় থেকে প্রয়োজনীয় নথিপত্র দিতে দেরি করা হচ্ছে। ফলে প্রতিবেদন দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
যা বললেন রাসেল
পাওনার বিষয়ে জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রাসেল বলেন, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে ১ হাজার কোটি টাকার বেশি দায়দেনার যে তথ্য হাজির করা হচ্ছে তা সঠিক নয়। মোট দায় ৩০০ কোটি টাকার কিছু বেশি। আমি গ্রেপ্তার হওয়ার পর হোস্টিং সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান অ্যামাজনের কাছে একটি বড় অঙ্কের দায় ছিল। নিয়ম অনুযায়ী তারা সার্ভার স্থগিত করে দিয়েছিল। পাওনা পরিশোধ করে সার্ভার চালু করা হয়েছে। নতুন করে ওটিপি দিলেই পুরোনো ৪২ লাখ গ্রাহকের সব লেনদেনের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। আমি এখন ‘সীমিত পরিসরে’ ব্যবসা করছি। গ্রাহকের পাওনা অনেক। কিছু অর্থ পরিশোধ করেছি। একজনের পাওনা মেটালে অন্যরা চাপ দেয়। এতে একটু কথাবার্তা হচ্ছে।
রাসেল আরও বলেন, ‘আদালতের নির্দেশে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি, ই-ক্যাবের প্রতিনিধি ও আমার পরিবারের সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত পর্ষদের অধীনে ইভ্যালি নতুন করে কার্যক্রম শুরু করেছে। এখন ইভ্যালিকে মনিটরিং করার মতো ‘গার্ডিয়ান’ আছে। কম লোকবল নিয়েই চলছে। লভ্যাংশ থেকে কিছু দায় শোধ শুরু করছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘মুনাফা থেকেই আমরা আমাদের দেনা শোধ করব ইনশাআল্লাহ। শোধ না হওয়া পর্যন্ত আমরা উদ্যোক্তা বা পরিচালকরা কোনো টাকা নেব না। এছাড়া বিনিয়োগকারী পেলে ব্যবসা যেমন সম্প্রসারণ করতে পারব, তেমনি বকেয়াও শোধ করে দিতে পারব।’
সিরিজ মামলা সম্পর্কে তিনি বলেন, অনেক মামলা হয়েছে, ১৬ মামলায় আমাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সব মামলায় জামিন পেয়েই কারাগার থেকে বের হয়েছি। কোনো আলোচনা বা সমঝোতা নয়, বরং যেসব গ্রাহক মামলা করেছিল, তারাই আদালতে জানিয়েছেন যে, তারা মনে করেন ইভ্যালি ব্যবসা চালাতে পারলেই তাদের টাকা ফেরত পাবেন এবং সে কারণে তারা আর মামলা চালাতে চান না। এরপরই কিন্তু আমার জামিন হয়েছে। আদালত কিছু শর্ত দিয়েছে; যেমন পাসপোর্ট জমা রাখতে হবে এবং লোকসান দিয়ে বিজনেস করা যাবে না ইত্যাদি।