হুমায়ুন মাসুদ, চট্টগ্রাম
প্রকাশ : ১১ জুলাই ২০২৪ ২২:২১ পিএম
২০২১ সালে বাংলাদেশে নিজস্ব পতাকাবাহী সামুদ্রিক জাহাজ ছিল ৭৩টি। পরের বছর ১৭টি বেড়ে বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজের বহর উন্নীত হয় ৯০টিতে। এরপর ধারাবাহিকভাবে জাহাজ বেড়ে এখন ১০১টিতে উপনীত হলেও সেই অনুযায়ী দেশে আমদানি করা মেরিন ফুয়েল বিক্রি বাড়ছে না। উল্টো দিন দিন কমছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে যেখানে মেরিন ফুয়েল বিক্রি হয় ৩১ হাজার ২৯২ মেট্রিক টন। সেখানে পরের অর্থবছর বিক্রি হয়েছে ১৭ হাজার ৩৭৫ মেট্রিক টন। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এটি আরও কমেছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)।
অথচ জাহাজ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মেরিন ফুয়েল বিক্রি বাড়ার কথা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুই কারণে বিপিসির তেল বিক্রি কমছে। এর মধ্যে একটি কারণ হলো মেরিন ফুয়েলের মান নিশ্চিত না করা। অন্যটি হলো অন্যান্য দেশের তুলনায় দাম বেশি হওয়া।
বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘দুটি কারণে বাংলাদেশের মেরিন ফুয়েল খাতটা জনপ্রিয় হয়ে উঠছে না। এর একটি কারণ হলো মেরিন ফুয়েলে কোয়ালিটি ঠিক থাকে না। অনেক সময় দেখা গেছে, তেল বিপণনকারী সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে মেরিন ফুয়েল নিয়ে ডিলাররা সেগুলোর সঙ্গে কম মানের তেল মিশিয়ে এরপর সরবরাহ করেন। কম মানের তেল মেশানোর কারণে দুয়েকটি জাহাজের ইঞ্জিন নষ্ট হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। তাই অনেক বিদেশি জাহাজ বাংলাদেশ থেকে মেরিন ফুয়েল কিনে না। আরেকটি কারণ হলো দাম। যেদেশে তেলের দাম কম, সেখান থেকেই জাহাজগুলো তেল কিনে। বাংলাদেশ থেকে সিঙ্গাপুর অথবা কলম্বো বন্দরে দাম কম থাকে। তাই অনেক জাহাজ সেখান থেকেই তেল কিনে।’
বিপিসি মেরিন ফুয়েল আমদানি করার পর প্রতিষ্ঠানটির তিনটি তেল বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা মেরিন ফুয়েল বিক্রি করে। প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে মেরিন ফুয়েল কিনে বিপিসির নিয়োগকৃত ডিলাররা জাহাজে সরবরাহ করে। ডিলাররা বিপিসির তিনটি তেল বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে তেল সংগ্রহ করার পর সেটি জাহাজে সরবরাহ করার মাঝখানে কী হয়, সেটি বিপিসি তদারকি করে না। শিপিং এজেন্ট সংশ্লিষ্টদের দাবি, মাঝখানে ডিলাররা অতি লাভের আশায় মেরিন ফুয়েলে কম মানের তেল মেশান। যে কারণে মেরিন ফুয়েলের মানমাত্রা ঠিক থাকে না। যে কারণে বাণিজ্যিক জাহাজগুলো বাংলাদেশ থেকে তেল কিনতে আগ্রহ দেখায় না।
বিপিসি থেকে ২০২০ সালের আগে কখনও ‘০.৫ শতাংশ সালফার’ মাত্রার মেরিন ফুয়েল আমদানি করা হয়নি। ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশন (আইএমও) রেগুলেশন অনুযায়ী, ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি এ ধরনের মেরিন ফুয়েল ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার পর আমদানি শুরু করে।
এর আগে সামুদ্রিক দূষণ রোধে আইএমওর সদস্য দেশগুলোকে ‘লো-সালফার’ জ্বালানি ব্যবহারে গুরুত্ব দিয়ে ২০১৯ সালে প্রতিটি জাহাজাকে ০.৫ শতাংশের বেশি সালফার বহন না করার নির্দেশনা জারি করেছিল। এরপর ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে সেটি কার্যকর করার পর আইএমওর নির্দেশনা অনুসরণ করে, বিপিসি ওই বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর থেকে লো-সালফার যুক্ত মেরিন ফুয়েল আমদানি করা শুরু করে।
লো সালফার মেরিন ফুয়েল আমদানি শুরু করার পর ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত গত চার অর্থবছরে ১ লাখ ৬ হাজার ৫৩৬ মেট্রিক টন লো সালফার মেরিন ফুয়েল আমদানি করে বিপিসি। প্রতিষ্ঠানটির তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ সালে মেরিন ফুয়েল আমদানি হয় ২৯ হাজার ৯৬৩ মেট্রিক টন। পরের বছর ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৬ হাজার ৫০৬ মেট্রিক টন। এর পরের বছর ২০২২-২৩ অর্থবছর ৩০ হাজার ৬৭ মেট্রিক টন। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছর আমদানি হয় ৩০ হাজার মেট্রিক টন।
এই আমদানির বিপরীতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের আগের তিন বছরে বিপিসি মেরিন ফুয়েল বিক্রি করে ৬২ হাজার ১ মেট্রিক টন। মেরিন ফুয়েল বিক্রির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে ১৩ হাজার ৩৩৪ মেট্রিক টন মেরিন ফুয়েল বিক্রি হয়। এর পরের অর্থবছর ২০২১-২২ অর্থবছরে মেরিন ফুয়েল বিক্রি কিছুটা বাড়ে। ওই বছর মেরিন ফুয়েল বিক্রি হয় ৩১ হাজার ২৯২ মেট্রিক টন। এরপর ২০২২-২৩ অর্থবছরে মেরিন ফুয়েল বিক্রি আবার কমে যায়।
আগের বছরের তুলনায় ১৩ হাজার ৯১৭ মেট্রিক টন কমে ওই অর্থবছর মেরিন ফুয়েল বিক্রি হয় ১৭ হাজার ৩৭৫ মেট্রিক টন। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিক্রি হয়েছে তার সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে গত দুই-তিন অর্থবছরের মতোই কম বিক্রি হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা।
মেরিন ফুয়েল বিক্রি কেন বাড়ছে নাÑ জানতে বিপিসির পরিচালক (বিপণন) কবীর মাহমুদকে একাধিকবার কল করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। পরে অর্থ বিভাগের এক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে বাণিজ্যিক জাহাজের পাশাপাশি কোস্টাল ভেসেল অনেক বেড়েছে। এসব জাহাজে যেই পরিমাণ মেরিন ফুয়েল দরকার আমরা তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখেছি বিপিসির আমদানি করা মেরিন ফুয়েল সেই পরিমাণ বিক্রি হচ্ছে না। এটি দুটি কারণে হতে পারে একটি হচ্ছে বৈদেশিক জাহাজগুলো হয় ভিন্ন দেশ থেকে তেল কিনছে। না-হয় জাহাজগুলো অন্য কোনোভাবে মেরিন ফুয়েল সংগ্রহ করছে।’
অন্য কোনোভাবে বলতে কী বোঝাচ্ছেনÑ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটি হতে পারে বাণিজ্যিক জাহাজগুলো প্রয়োজনের অতিরিক্ত তেল নিয়ে আসছে। পরে সেগুলো এখানে আসার পর অবৈধভাবে অন্য জাহাজের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছে।’