রেদওয়ানুল হক
প্রকাশ : ১১ জুলাই ২০২৪ ১৬:৩৭ পিএম
ফাইল ফটো
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি চালিয়ে আসছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে কোনো ফল পাওয়া যাচ্ছে না। তবুও এ নিষ্ফল পদক্ষেপেই ভরসা রাখতে চাচ্ছেন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। নতুন অর্থবছরের জন্য মুদ্রানীতি আরও সংকোচনের পথেই হাঁটছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে কর্মসংস্থান কমে যাওয়ার ধাক্কা সামাল দিতে এসএমই খাতকে শক্তিশালী করার কৌশল থাকছে এবারের মুদ্রানীতিতে।
গতকাল বুধবার এ বিষয়ে অংশীজনদের মতামত নিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। তাদের পরামর্শ আমলে নেওয়া হতে পারে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত মুখপাত্র সাইফুল ইসলাম। তবে সূত্র বলছে, সংকোচন নীতি অব্যাহত রেখে মুদ্রানীতি প্রায় চূড়ান্ত হয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্ষদ সভায় পাস হওয়ার পর তা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হবে।
অংশীজনের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠক সূত্রে জানা যায়, এবারের মুদ্রানীতিতে খেলাপি ঋণ আদায়ের বিষয়ে জোর দেওয়া হবে। এ ছাড়া মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে পথনির্দেশনা আসছে। কারণ গত মুদ্রা নীতিতেও একই ঘোষণা দিয়েছিলেন গভর্নর। ইতোমধ্যে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য একাধিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোনোটাই এখনও ঠিকমতো কাজ করছে না। কবে নাগাদ কাজ শুরু করবে তাও বলা যাচ্ছে না। তাই নীতি সুদহার বৃদ্ধি, ক্রলিং পেগে অটল এবং খেলাপি ঋণ কমানোর মতো পূর্বনির্ধারিত সিদ্ধান্তই আবারও আসছে নতুন অর্থবছরের প্রথম অধ্যায়ের মুদ্রানীতিতে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির কারণে গত বছর দেশে কর্মসংস্থান কমেছে। এর প্রধান কারণ বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা ঠিকমতো ঋণ পায়নি। এমন পরিস্থিতিতে দেশের কর্মসংস্থান ঠিক রেখেই সংকোচনের চিন্তায় হাঁটছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এজন্য এবারের মুদ্রানীতিতে এসএমই খাতকে শক্তিশালী করার পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এতে মূল্যস্ফীতিতে লাগাম টানার পাশাপাশি কর্মসংস্থানও বাড়তে পারে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, মার্কিন ডলারের পাশাপাশি স্থানীয় টাকার সংকট, বৈদেশিক লেনদেনে ভারসাম্যহীনতা এবং সুশাসনের অভাবে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির সাথে নিয়ন্ত্রণহীন ব্যাংক খাতÑ মোটা দাগে এসবই হচ্ছে এখন দেশের আর্থিক খাতে প্রধান সমস্যা। এসব নিয়ন্ত্রণে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা থাকতে হবে মুদ্রানীতিতে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘নতুন মুদ্রানীতিতে দেশের ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি (এসএমই) শিল্পের ঋণপ্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে। বড়দের জন্য পুঁজিবাজার আছে, তারা তহবিল সংগ্রহের জন্য সেখানে যাক।’
তিনি বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি সরবরাহ বাড়াতে হবে। বাজারব্যবস্থায় শৃঙ্খলা আনতে হবে। দেশে কর্মসংস্থান বাড়ানোর কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। মুদ্রানীতিতে এসব বিষয়ে সুস্পষ্ট বার্তা না থাকলে সেটি প্রণয়ন কিংবা ঘোষণা দিয়ে কোনো লাভ নেই।’
সূত্র জানায়, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নতুন করে পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ কম। ব্যাংকঋণের সুদহার এরই মধ্যে ৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৫ শতাংশ ছাড়িয়েছে। এর পরও নীতি সুদের হার বাড়িয়ে টাকাকে আরও দামি করে তোলা হতে পারে। এতে ঋণের সুদের হার আরও বাড়বে।
এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও ভারপ্রাপ্ত মুখপাত্র সাইফুল ইসলাম বলেন, আমাদের মূল লক্ষ্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা। এজন্য ধারাবাহিকভাবে এবারও সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি হবে। যদিও শুধু মুদ্রানীতি দিয়ে মূল্যস্ফীতির লাগাম টানা সম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে অন্য সূচকগুলোকেও কাজে লাগাতে হবে। এক্ষেত্রে বাড়তে পারে নীতি সুদহার। তবে এখনই ক্রলিং পেগ তুলে দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছেন তিনি।
জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের আগাম মুদ্রানীতি প্রণয়ন নিয়ে ইতোমধ্যে মনিটারি পলিসি বিভাগ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেছে। এর আলোকে প্রাথমিকভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রানীতির এমন একটি কাঠামো তৈরি করেছে। এ বিষয়ে গতকাল কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেশের খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মতবিনিময় করার উদ্যোগ নেয়। তবে সেখানে উল্লেখযোগ্য কোনো অর্থনীতিবিদ অংশ নেননি। এতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। দায়সারা এ বৈঠকের বিষয়ে তেমন কিছু জানা যায়নি। গণমাধ্যমের কাছে এ বিষয়ে কোনো তথ্য জানাতে রাজি হননি ভারপ্রাপ্ত মুখপাত্র। আগামী ১৬ জুলাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্ষদ সভায় মুদ্রানীতির খসড়া উপস্থাপন করা হতে পারে। পর্ষদের মতামতের ভিত্তিতে মুদ্রানীতি চূড়ান্ত করা হবে। ১৮ জুলাই মুদ্রানীতি ঘোষণার প্রাথমিক দিন ধার্য করা হয়েছে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য টানা দুই বছর সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণ করা হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে সুদের হার। ডলারের প্রবাহ বাড়ানোর আশায় এর দাম বাড়ানো হয়েছে। ডলারের প্রবাহ বাড়েনি। ফলে কমেনি মূল্যস্ফীতি। উল্টো সুদের হার ও ডলারের দাম বাড়ানোর প্রভাবে মূল্যস্ফীতিও বেড়েছে।
চলতি অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে নামানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। বর্তমানে আছে ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ। এ হার লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে নামানো অসম্ভব বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।
এদিকে আইএমএফ নীতিনির্ধারণী সুদের হারের কাঠামো পরিবর্তনের সুপারিশ করেছে। বর্তমানে রেপো বা ট্রেজারি বিল পুনঃক্রয় চুক্তি হচ্ছে নীতিনির্ধারণী সুদের হার। এ হার ৪ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৮ শতাংশ করা হয়েছে। আইএমএফ বলেছে, ব্যাংক রেটকে নীতিনির্ধারণী সুদের হার হিসাবে ঘোষণা করতে। কিন্তু বর্তমানে ব্যাংক রেট খুব বেশি কার্যকর নয়। এর পরিবর্তে রেপো রেটই বেশি সক্রিয়। বর্তমানে ব্যাংক রেট ৪ শতাংশ। করোনার সময় এ হার কমানো হয়েছিল। এরপর আর বাড়ানো হয়নি। সুদের হার বাড়লেও ব্যাংক রেট বাড়েনি।
এদিকে আগামী মুদ্রানীতিতে অনুৎপাদনশীল খাতে বা বিলাসী খাতে আমদানি যেমন আরও নিয়ন্ত্রণ করা হবে, তেমনই এসব খাতে ঋণের সুদহারও কিছুটা বাড়ানো হবে। ফলে এসব খাতে টাকার প্রবাহ কমে মূল্যস্ফীতি কমবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ছাপানো টাকায় সরকারকে আর নতুন ঋণ দেওয়া হবে না। একই সঙ্গে ছাপানো টাকায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যেসব তহবিল রয়েছে, সেগুলোর আকার ছোট করার পাশাপাশি ঋণের জোগান কমানো হবে। তবে উৎপাদন খাতে ঋণের জোগান বাড়ানো হবে।
এদিকে বিদায়ি অর্থবছরের মুদ্রানীতির বেশির ভাগ লক্ষ্যমাত্রাই অর্জিত হয়নি। এর আলোকে লক্ষ্যমাত্রায় সংশোধন আনা হতে পারে। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে টাকার প্রবাহ বেশি কমানোর পরও মূল্যস্ফীতি কমেনি। ফলে টাকার প্রবাহের ভিত্তিতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা কতটুকু সম্ভব হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অর্থনীতিবিদরা।
মুদ্রানীতি ওয়েবসাইটে প্রকাশের সিদ্ধান্ত
দীর্ঘদিনের রীতি উপেক্ষা করে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথমার্ধের মুদ্রানীতি সংবাদ সম্মেলন না করে ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সংবাদ সংগ্রহে বাধা দেওয়ার প্রেক্ষাপটে সাংবাদিকদের বয়কটের মুখে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আগামী ১৮ জুলাই বিকাল ৩টায় ওয়েবসাইটে মুদ্রানীতির তথ্য প্রকাশ করা হবে বলে নিশ্চিত করেছেন ভারপ্রাপ্ত মুখপাত্র।
এর আগে গত মঙ্গলবার ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের সভাপতি রেফায়েত উল্লাহ মিরধা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে এক বৈঠক শেষে জানান, বাংলাদেশ ব্যাংক পূর্বের অবস্থানে থেকেই মুদ্রানীতি কাভার করার জন্য আহ্বান জানিয়েছিল। কিন্তু আগের মতো প্রবেশাধিকার না দেওয়ায় এ আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেছে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম।
এ বিষয়ে সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা সাংবাদিক সংগঠন ইআরএফের সঙ্গে বৈঠক করেছি। কিন্তু মুদ্রানীতির প্রোগ্রাম তারা কাভার করবে কিনা সে বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত জানায়নি। তাই আমরা অনুষ্ঠান আয়োজন করে পুনরায় অপমানিত হতে চাই না। সাংবাদিকরা রাজি হলে বেলা ১১টায় সংবাদ সম্মেলন করে মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হতো। কিন্তু তাদের পক্ষ থেকে কোনো সিদ্ধান্ত না পাওয়ায় ১৮ তারিখ বিকাল ৩টায় বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইট ফেসবুকসহ অন্য মাধ্যমগুলোতে প্রকাশ করা হবে।’