কোরবানির পশুর চামড়া
ফারুক আহমাদ আরিফ
প্রকাশ : ২০ জুন ২০২৪ ১২:৪৩ পিএম
আপডেট : ২০ জুন ২০২৪ ১৩:৩৮ পিএম
রাজধানীর লালবাগের পোস্তায় চামড়ার আড়ত। প্রবা ফটো
সরকারের বেঁধে দেওয়া দামের চেয়ে অনেক কমে এবারও কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রি হয়েছে। ব্যবসায়ীদের মতে, একেবারে নামমাত্র মূল্যে বিক্রি হয়েছে কোরবানির পশুর চামড়া। সোমবার ঈদের দিন যে দামে চামড়া বিক্রি হয়েছে, দ্বিতীয় দিন সেই দামও পাননি বিক্রেতারা। অন্য দিকে, চাহিদা না থাকায় ছাগলের চামড়া কিনে বিপাকে পড়েছেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা।
এ বছর ঢাকায় গরুর প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়ার দাম ৫৫ থেকে ৬০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৫০ থেকে ৫৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল। যা ঢাকায় গত বছরের চেয়ে প্রতি ফুটে ৫ টাকা ও ঢাকার বাইরে ৭ টাকা বেশি। আবার খাসির চামড়ার দাম প্রতি বর্গফুট ২০ থেকে ২৫ টাকা এবং বকরির চামড়া ১৮ থেকে ২০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। এতে করে খাসির ক্ষেত্রে ২ থেকে ৫ টাকা ও বকরির চামড়ায় ৬ টাকা বেশি ধরা হয়। কিন্তু ঈদে দেশের কোথাও নির্ধারিত দামে চামড়া বিক্রি হয়নি।
এক লাখ টাকা দামের গরুর চামড়ার দাম যেখানে ১ হাজার ১০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা হওয়ার কথা ছিল তা বিক্রি হয়েছে ৪০০ থেকে ৫৫০ টাকার মধ্যে। অর্থাৎ সরকারের বেঁধে দেওয়া দরের চেয়ে অর্ধেক দামে চামড়া বিক্রি হয়েছে।
রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা দামের গরু কোরবানি দিয়েছেন সাইফুল ইসলাম। তিনি সেই চামড়া বিক্রি করেছেন ৪৫০ টাকায়। তিনি বলেন, ‘সরকার যে দাম নির্ধারণ করেছিল সে অনুযায়ী চামড়াটির দাম হতো ১ হাজার ১০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ টাকার মতো। কিন্তু সেটি অর্ধেক দামেও বিক্রি করা যায়নি।’
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছেÑ ঢাকার বাইরেও ছিল একই অবস্থা। নাখালপাড়ার সিজান মাহমুদের পরিবার ৯৫ হাজার টাকায় একটি ও এক কোটি ৭৫ হাজার টাকায় আরেকটি পশু কোরবানি দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘চামড়া এতিমখানায় দিয়ে দিয়েছি। সেখানে কোনো ধরনের দাম ধরা হয়নি। মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ যে দামে বিক্রি করবে পুরো টাকা তারা নিয়ে নিবে। তবে গত বছরের চেয়ে এবার ঢাকায় সামান্য বেশি দামে চামড়া বিক্রি হয়েছে।’
দেশের সবচেয়ে বেশি কাঁচা চামড়া বেচাকেনা হয় পুরান ঢাকার পোস্তায়। সেখানে এক লাখ টাকায় কেনা গরুর কাঁচা চামড়া বিক্রি হয়েছে সর্বোচ্চ ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকায়।বেপারিরা বলছেন, একটি চামড়ায় ১০০ টাকার লবণ লাগে। আছে কুলি ও পরিবহন ব্যয়। সেখানে দেড় লাখ টাকায় কেনা গরুর চামড়াও ৫৫০ টাকার বেশি দেওয়া যায়।
এ বছরও কোরবানির পশুর চামড়ার সঠিক দাম পাওয়া যায়নি কেন জানতে চাইলে বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আফতার উদ্দিন বলেন, ‘এক লাখ টাকার গরুর চামড়া ১ হাজার ১০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা দেওয়ার কথা ছিল। আমরা এই দামের গরুর কাঁচা চামড়া কিনেছি ৭৫০ থেকে ৮৫০ টাকা দিয়ে। প্রতিটি চামড়ায় লবণ, কুলি ও পরিবহন বাবদ আমাদের ব্যয় আছে ২৯০ থেকে ৩০০ টাকা।’
তিনি বলেন, ‘চামড়াগুলো ট্যানারিতে বিক্রি করতে গেলে কিছু নষ্ট হয়ে যায়। সেসব চামড়া বাদ দেওয়া হয়। তখন লোকসানে পড়তে হয়। তা ছাড়া যারা মহল্লা থেকে চামড়া কিনেছে তারা হয়তো কিছু টাকা কম দিয়েছে। কেননা তারা ৬ থেকে ৮টি চামড়ার বেশি নিতে পারে না। এতে প্রতি চামড়ায় তাদের পরিবহন ব্যয় আছে। এজন্য তারা হয়তো কিছু টাকা কম দিয়েছে। তবে সার্বিকভাবে চামড়ার দাম মোটামুটি ভালো ছিল।’
সাধারণ মানুষ যেহেতু চামড়ার মূল্য পাচ্ছে না সেজন্য কাঁচা চামড়া রপ্তানির কোনো সুযোগ আছে কি নাÑ এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কাঁচা চামড়া তথা লবণ দিয়ে রপ্তানি করা ব্যয়বহুল। এজন্য শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কনটেইনার দরকার পড়ে। কোন দেশ কাঁচা চামড়া নেবে সেটিও দেখার বিষয় আছে।’
তিনি বলেন, ‘১৯৯০-এর আগ পর্যন্ত ওয়েট ব্লু চামড়া রপ্তানির সুযোগ ছিল। চামড়া থেকে পশম ছাড়িয়ে প্রক্রিয়াজাত করার পর যে চামড়া পাওয়া যায় সেটিই ওয়েট ব্লু চামড়া। এসব চামড়া এক থেকে দেড় বছরেও নষ্ট হয় না। এভাবে রপ্তানি করা যায় কিন্তু নব্বই দশকের পর এটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।’
তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২১ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত সময়ের মধ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এএসকে ইনভেস্টমেন্ট, কাদের লেদার কমপ্লেক্স, আমিন ট্যানারি লিমিটেড, লেদার ইন্ডাস্ট্রিজ অব বাংলাদেশ লিমিটেড (ইউনিট-২) এবং কালাম ব্রাদারসসহ পাঁচটি প্রতিষ্ঠানকে এক কোটি বর্গফুট ওয়েট ব্লু চামড়া রপ্তানির অনুমতি দিয়েছিল।
গত ৩ জুন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটুর উপস্থিতিতে কাঁচা চামড়ার মূল্য নির্ধারণ করেছিল বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএলএলএফইএ) চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন আহমেদ মাহিন।
তিনি বলেছিলেন, ‘ঈদুল আজহা উপলক্ষে চামড়ার সর্বনিম্ন দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ঢাকায় প্রতি পিস গরুর চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১ হাজার ২০০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ১ হাজার টাকা। গতকাল বুধবার মহিউদ্দিন আহমেদ মাহিনের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি। পরবর্তীতে সংগঠনটির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান মো. দিলজাহান ভূঁইয়া ও ট্রেজারার মো. শাহজালাল মজুমদারের সঙ্গে কথা হয়।
দিলজাহান ভূঁইয়া বলেন, ‘সাভারে যে বিসিক চামড়া শিল্প নগরী স্থাপন করা হয়েছে সেখানে কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগারটি (সিইটিপি) ভালো হয়নি। বিদেশি আমদানিকারকরা এটি দেখে চামড়া আমদানি কমিয়ে দিয়েছে। তাদের চাহিদা অনুযায়ী সেখানে কাজ করা যাচ্ছে না। এতে করে চামড়া রপ্তানি করা যাচ্ছে না। সেজন্য ব্যবসায়ীরাও চামড়া কিনছেন না।’
তিনি বলেন, ৩০ বছর বন্ধ থাকার পর গত দুই বছর আগে ওয়েট ব্লু চামড়া রপ্তানির অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু রপ্তানির সেই লক্ষ্যমাত্রাও অর্জিত হয়নি। গত বছরের তুলনায় এ বছর বেশি সংখ্যক পশু কোরবানি হয়েছে। এতে দাম কমে গেছে। তবে আগামী এক থেকে দুই সপ্তাহ পরে চামড়ার দাম বাড়তে পারে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
অন্য দিকে শাহজালাল মজুমদার বলেন, ‘বিদেশে চামড়া রপ্তানির চাহিদা কমে গেছে, আমরা অর্ডার পাচ্ছি না। আমদানিকারকদের কমপ্লায়েন্স অনুযায়ী চামড়া প্রস্তুত করা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় আমরা কীভাবে বেশি দামে চামড়া কিনব। যে দামে চামড়া কেনা হচ্ছে তা রপ্তানি করা যাবে কি নাÑ তা নিয়েই সন্দেহ রয়েছে।’
দেশের প্রায় সব স্থানেই সরকারের নির্ধারিত দামে চামড়া কিনতে দেখা যায়নি কেন জানতে চাইলে বাংলাদেশ ট্যানারি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ বলেন, ‘আমি এখন পর্যন্ত ৮ লাখ পিস কাঁচা চামড়া কিনেছি। বিভিন্ন এতিমখানা, মাদ্রাসা ও মসজিদ থেকে এসব চামড়া কেনা হয়েছে। লবণ দেওয়া ছাড়াই আমরা ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা করে প্রতি পিস চামড়া কিনেছি।’ তিনি বলেন, ‘গ্রামাঞ্চলে যদি লবণ দিয়ে চামড়া বিক্রি না হয়ে থাকে তাহলে কম দামে হয়তো বিক্রি হয়েছে। আর লবণ না দিয়ে ফ্রি দিলেও চামড়া কেনার কথা না। আমাদের ট্যানারি শিল্প নগরীতে কঠিন ও তরল বর্জ্য নিষ্কাশনে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আবার বিশ্ববাজারেও চামড়ার দাম কম। এ অবস্থায় চামড়ার দাম নিয়ে আমরা শঙ্কিত।’
বাংলাদেশ থেকে চীন, হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া, ইতালি, জাপান ও স্পেনের মতো দেশে ‘ক্রাস্ট’ ও ‘ফিনিশড লেদার’ রপ্তানি করা হয়ে থাকে।
গত মঙ্গলবার সাভারের হেমায়েতপুরে অবস্থিত বিসিক চামড়া শিল্পনগরী পরিদর্শন করেছেন শিল্প মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব জাকিয়া সুলতানা। এ সময় তিনি বলেন, ‘অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে এবারের পবিত্র ঈদুল আজহায় চামড়া সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনা অনেক বেশি পরিবেশবান্ধব হয়েছে। এবার বিসিক চামড়া শিল্পনগরীর সিইটিপিকে পুরোপুরি প্রস্তুত ও কার্যকর করা হয়েছে। সবগুলো মডিউলকে ওভারহোলিং তথা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষানিরীক্ষা ও মেরামতপূর্বক ঢেলে সাজানো হয়েছে। প্রয়োজনীয় রাসায়নিক দিয়ে তরল বর্জ্যকে পরিশোধন করা হয়েছে। তা ছাড়া বায়োলজিক্যাল ট্রিটমেন্ট ব্যবস্থা চালু রয়েছে। প্রাথমিক পরিশোধন ছাড়া যাতে কোনো ট্যানারির বর্জ্য সিইটিপিতে আসতে না পারে, সেটি নিশ্চিত করা হয়েছে।’
তবে সিইটিপিসহ অন্যান্য কমপ্লায়েন্স পরিপূর্ণ করা হয়নি বলে চামড়া রপ্তানিতে বিদেশিরা অর্ডার কম দিচ্ছেন- বিষয়টি শিল্প সচিবের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বুধবার প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, রপ্তানির অর্ডার কমে যাচ্ছে বিষয়টি দেখভালের দায়িত্ব মূলত বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের। তবে আমরা বলতে পারি গত ১৫ বছরের তুলনায় এ বছর যতটা সম্ভব সিইটিপি ভালো করা হয়েছে। এমনকি ৩ বছর আগেও যে অবস্থা ছিল তা থেকে অনেক উত্তরণ সম্ভব হয়েছে। যদিও ১০০ শতাংশ কমপ্লায়েন্স পুরোপুরি সমাধান করা সম্ভব হয়নি।
জাকিয়া সুলতানা বলেন, ‘দেশে প্রতি বছর ঈদুল আজহায় এক কোটি পশু কোরবানি হয়ে থাকে। তা ছাড়া সারা বছর আরও এক কোটি পশুর চাহিদা রয়েছে। সব মিলিয়ে দুই কোটি পিস চামড়ার সুষ্ঠু ও পরিবেশবান্ধব সংরক্ষণের জন্য চট্টগ্রামে একটি ও ঢাকায় আরও একটিসহ মোট দুটি সিইটিপি নির্মাণ করা হবে। চামড়া শিল্প বিষয়ে মহামান্য হাইকোর্টের চারটি নির্দেশনা যথাযথভাবে প্রতিপালন করা হচ্ছে। বড় ট্যানারিগুলো ইতোমধ্যে ক্রোম রিকভারি ইউনিট (সিআরইউ) স্থাপন করেছে। পরিশোধনকৃত তরল বর্জ্যের মধ্যে ক্রোমিয়াম ও বায়োলজিক্যাল অক্সিজেন ডিমান্ড (বিওডি) ছাড়া অন্য প্যারামিটারগুলো নির্দিষ্ট সীমার মধ্যেই রয়েছে। পরিশোধনকৃত তরল বর্জ্যের সঠিক মান নির্ণয় ও নিয়ন্ত্রণে পরিবেশ অধিদপ্তরের পাশাপাশি সায়েন্স ল্যাবরেটরি ও আমাদের নিজস্ব ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করা হবে বলে তিনি জানান।