কামরুল হাসান, নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়
প্রকাশ : ০৫ ডিসেম্বর ২০২৩ ২০:৫৪ পিএম
আপডেট : ০৬ ডিসেম্বর ২০২৩ ২০:৪৪ পিএম
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চুরুলিয়া মঞ্চে জয়নুল উৎসব। প্রবা ফটো
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন—নাম শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে ১৯৪৩-র দুর্ভিক্ষের ছবি, রাস্তার পাশে পড়ে থাকা কঙ্কালসার মানুষ, ডাস্টবিন, কাক। আরো মনে পড়ে, রেখাচিত্রে আঁকা গরু, গরুর গাড়ি, গ্রীবা উঁচু করে হেঁটে যাওয়া সাঁওতাল রমণীদের কথা। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ২৯ বছর বাংলাদেশের শিল্প আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি নিজেই ছিলেন একটি প্রতিষ্ঠান। ঢাকা আর্ট কলেজ, ময়মনসিংহ জয়নুল সংগ্রহশালা, বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের সূচনা তার হাত ধরেই হয়েছে। তার প্রতিটি কাজে স্বদেশী ঐতিহ্যের সাথে তিনি এশিয়া এবং ইউরোপীয় শিল্পের সমন্বয় ঘটিয়েছেন। বাংলাদেশের চিত্রশিল্পের প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে গণ্য করা হয় জয়নুল আবেদীনকে। তার স্মরণে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হয়েছে জয়নুল উৎসব-২০২৩।
মঙ্গলবার (৫ নভেম্বর) বিশ্ববিদ্যালয়ের চুরুলিয়া মঞ্চে চারুকলা অনুষদের উদ্যোগে শুরু হওয়া দুই দিনের এই উৎসব উদ্বোধন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. সৌমিত্র শেখর। উৎসব ঘিরে মঞ্চ সেজেছে রঙিন সাজে। মঞ্চ প্রাঙ্গণে বসেছে মেলা। চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থীরা উৎসবে অংশ নিয়ে নিজেদের তৈরি নানা কারুপণ্য প্রদর্শন ও বিক্রি করছেন। কারুকার্যখচিত এসব শিল্পকর্মের মধ্যে রয়েছে কাঠের চুড়ি, টিপ, মালা, লকেট, ব্যাগ, দুলসহ শিক্ষার্থীদের নিজ হাতে তৈরি নানা ধরনের শিল্পকর্ম। এসবের মাধ্যমে ফুটে উঠেছে শিক্ষার্থীদের শিল্পনৈপুণ্য। শিক্ষার্থী ছাড়াও স্থানীয় উদ্যোক্তারা মেলায় স্টল বসিয়েছেন। এছাড়া উৎসবকে রঙিন করে তুলতে বসেছে বাহারি সব পিঠার দোকান।
বিকাল গড়াতেই জমে ওঠে মেলা প্রাঙ্গণ। সন্ধ্যায় শুরু হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। আশপাশের বিভিন্ন জায়গা থেকে দর্শনার্থীরা আসেন। পাশাপাশি বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থীরাও এসেছেন উৎসব ঘিরে। মেলায় ক্রেতা কিছুটা কম থাকলেও শিক্ষকরা দরদাম ছাড়াই কিনছেন শিক্ষার্থীদের বানানো এসব শৈল্পিক উপকরণ। মেলায় কেউবা সিনিয়র-জুনিয়র মিলে জুড়ে দিয়েছেন আড্ডা। প্রিয় মানুষকে উপহার দিচ্ছেন কারুকার্যখচিত নানা অলংকার। কেউবা ব্যস্ত উৎসবের মুহূর্ত ফ্রেমবন্দি করতে। সব মিলিয়ে জয়নুল উৎসব পরিণত হয়েছে বর্তমান, প্রাক্তন ছাত্র আর শিক্ষকদের মিলনমেলায়।
চারুকলা অনুষদের ১০ম ব্যাচের শিক্ষার্থী নিলয় দেবনাথ বলেন, ‘শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন আমাদের শিল্পচর্চা ও ছবি আঁকার অনুপ্রেরণা। জয়নুল আবেদীনের হাত ধরেই বাংলাদেশে চারুকলা শব্দটির সূচনা। মূলত তার স্মরণেই এই উৎসব আয়োজন করা হয়েছে।’ চারুকলা অনুষদের আরেক শিক্ষার্থী মুবিন। তিনি বলেন ‘জয়নুল আবেদিনের অনবদ্য সৃষ্টি চারুকলা শিক্ষা প্রসারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। ভবিষ্যত প্রজন্মকেও চারুকলা শিক্ষায় নানাভাবে অনুপ্রেরণা দিতে এই উৎসবের গুরুত্ব অপরিসীম।’
চারুকলা অনুষদের একজন সাবেক শিক্ষার্থী বলেন, ‘নানা ব্যস্ততার কারণে ক্যাম্পাসে আসার সুযোগ হয় না। এই উৎসব উপলক্ষে ক্যাম্পাসে আসা হয়েছে। বহুদিন পর বিভাগের বন্ধু-বান্ধব এবং শিক্ষকদের সাথে দেখা হলো। আমরা চাই এখন থেকে নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে যেন প্রতিবছর বড় পরিসরে জয়নুল উৎসবের আয়োজন হয়।’ চারুকলা অনুষদের নবীন শিক্ষার্থী পুষ্পিতা। তার কথায়, ‘কয়েক মাস হলো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি। এই উৎসবের মাধ্যমে বিভাগের অনেক সাবেক শিক্ষার্থীর সাথে আমাদের পরিচয় হচ্ছে। বিভাগের সিনিয়র, সহপাঠী এবং সকলের সাথে একটি মেলবন্ধনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। সব মিলিয়ে আমরা খুবই আনন্দিত।’
মঙ্গলবার সকালে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি উপাচার্য সৌমিত্র শেখর বলেন, ‘আমাদের সংস্কৃতি হচ্ছে বাঙালির প্রাণভোমরা; বাঙালিকে বাঁচিয়ে রাখবে চিরদিন, চিরকাল। আমাদের হাজার বছরের সংস্কৃতির মূলে যারা কাজ করেছেন, যারা ধারণ করেছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম একজন হলেন জয়নুল আবেদিন। আমাদের চারুকলার যে ধারণা, আমাদের শিল্পকলার যে ধারণা, এটি বহু আগে থেকেই বাঙালি সংস্কৃতিতে প্রবাহমান। কিন্তু জয়নুল আবেদিন আমাদের এই চারুকলাকে এমন মাত্রায় নিয়ে গেছেন যে কারণে আজকে আমাদের চারুকলার যে বিদ্যা সেটা আমাদের অনেক বেশি অণুপ্রাণিত করে।’
চারুকলা অনুষদের ডিন ড. তপন কুমার সরকারের সভাপতিত্বে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার ড. আতাউর রহমান। চারুকলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মাসুম হাওলাদারের সঞ্চালনায় শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন রেজিস্ট্রার কৃষিবিদ ড. মো. হুমায়ুন কবীর, স্বাগত বক্তব্য রাখেন চারুকলা বিভাগের প্রধান নগরবাসী বর্মন।