প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২৮ নভেম্বর ২০২৩ ১৯:৩১ পিএম
আপডেট : ২৮ নভেম্বর ২০২৩ ১৯:৫৮ পিএম
মঙ্গলবার রফিকুন নবীর ৮০তম জন্মজয়ন্তীতে রফিকুন নবীর অলংকৃত উনসত্তুরে হুড়া (চারুকলা অনুষদ সংস্করণ ২০২৩) গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন করেন অতিথিরা। প্রবা ফটো
চিত্র পদর্শনী, গান, আড্ডা, আলোচনাসহ নানা আয়োজনে উদযাপন করা হয়েছে দেশের চারুকলা ভুবনের অনন্য ব্যক্তি রফিকুন নবীর ৮০তম জন্মজয়ন্তী। সর্বসাধারণের কাছে রনবী নামে পরিচিত খ্যাতনামা এ চিত্রকর, কার্টুনিস্টের জন্মদিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা প্রাঙ্গণে বসেছিল বন্ধু, সুহৃদ আর অনুসারীদের মিলনমেলা। আয়োজনের রং ছড়ায় শিল্পীর আঁকা প্রায় কয়েক সহস্রাধিক কার্টুন, প্রচ্ছদ ও পোস্টার প্রদর্শনী।
অনুষ্ঠানে রফিকুন নবীর অলংকৃত উনসত্তুরে হুড়া (চারুকলা অনুষদ সংস্করণ ২০২৩) গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন করেন অতিথিরা।
মঙ্গলবার (২৮ নভেম্বর) বিকাল ৩টায় ছিন্নমূল পথশিশুদের জীবন যাতনার প্রতিচ্ছবিময় ‘টোকাই’ শিরোনামের কার্টুনের অনবদ্য সৃষ্টিকর রফিকুন নবীর জন্মোৎসবের মূল আয়োজন শুরু হয়। শুরুতেই চারুকলার জয়নুল গ্যালারিতে শিল্পীর আঁকা কার্টুন, পোস্টার, প্রচ্ছদ ও ইলাস্ট্রেশনের প্রদর্শনীর উদ্বোধন করা হয়। পরে শিল্পীকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগ, অনুষদের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, দেশের খ্যাতনমা সাংকৃতিক ব্যক্তিত্ব, সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগসহ অনেকেই।
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আসাদুজ্জামান নূর এমপির সভাপতিত্বে শিল্পীর কর্মের মূল্যায়নধর্মী আলোচনায় অংশ নেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি, ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. নজরুল ইসলাম, ইমেরিটাস অধ্যাপক শিল্পী হাশেম খান, নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমান প্রমুখ।
রামেন্দু মজুমদার বলেন, রফিকুন নবী কাজের মধ্য দিয়ে একটা স্টাইল তৈরি করেছেন যেটা দেখলেই মনে হয় এটা তার কাজ। আমি আশা করব তিনি আরও সৃষ্টিশীল থাকবেন এবং আমাদের জন্য অনেক কিছু এঁকে যাবেন।
শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেন, আমি স্কুল জীবনে টোকাই চিত্রকর্মের মাধ্যমে তাকে চিনেছি। টোকাই দিয়ে তিনি সমাজের অসঙ্গতিকে তুলে ধরেছেন। এখনো নানা অসঙ্গতির কথা তুলে ধরছেন।
আসাদুজ্জামান নূর বলেন, রফিকুন নবী রনবী নামে পরিচিত হওয়ার আগেই তার সঙ্গে আমার পরিচয়। তখন দেশে স্বাধীকার আন্দোলন ধানা বেধে উঠেছে। তখনও আমরা জানি না স্বাধীনতার দিকে অগ্রসর হচ্ছি। তবে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীদের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন হচ্ছে। তখন হাতে লেখা হতো পোস্টার। আর এই পোস্টারগুলো লেখা হতো তৎকালীন ঢাকা আর্ট কলেজ যা বর্তমানে চারুকলা নামে পরিচিত। এগুলো আঁকার অগ্রভাগে রফিকুন নবী, হাশেম খান, ইমদাদ হোসেন প্রমুখ। আমার পরম সৌভাগ্য এসব মানুষদের সঙ্গে মেশার সুযোগ হয়েছে।
শিল্পী রফিকুন নবী বলেন, ৮০ তে এসেছি এটা আয়োজন আমাকে উজ্জীবিত করার চেষ্টা। এতো আয়োজনে আমি অভিভূত। এটা আমার জন্য সারপ্রাইজ।
তিনি বলেন, এক মহাসমুদ্র পেরিয়ে ৮০-তে পৌঁছলাম। এই মহাসমুদ্র সহজ-সরলভাবে নৌকা চড়ে আসলাম তা কিন্তু নয়। এমন একটা দেশে আছি আমরা যেখানে অনেক কিছু নিয়ে ভাবতে হয়, অনেক কিছু নিয়ে লড়াই করতে হয়। রাজনীতি থেকে সমাজ, সমাজ থেকে সংস্কৃতি সবজায়গার মধ্যে আমাদের সহজভাবে এগিয়ে যাওয়ার বিষয়টি নেই। এর মধ্য দিয়ে আমাদের কাজ করতে হয়েছে। এই যে কার্টুন বা অন্য কিছু তা নিজের নাম-সুনামের জন্য নয়; ক্ষেত্র তৈরি করার একটা ব্যাপার ছিল। এসব করতে করতে নিজের ভালো-মন্দ কখনো বিচার করা হয়নি। কাজ করতে হয় কাজ করে গেছি।
তিনি বলেন, আজকে যা কিছু আঁকছি, ভাবছি তার পেছনে আছেন আমাদের জয়নুল আবেদীন স্যার ও আমার বাবা। আমার বাবা পেশায় পুলিশ থাকলেও নিজে ছবি আঁকতেন। ছুটির দিনে তিনি চারুকলায় (তৎকালীন আর্ট কলেজে) পড়ে থাকতেন। তার অনুপ্রেরণায় আমার পথচলা।
জন্মজয়ন্তীর এই আয়োজনে কবিতা আবৃত্তি করেন জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রজ্ঞা লাবনী, তারিক সুজাত ও শিমুল মুস্তাফা। সংগীত নৃত্য ও নাট্য পরিবেশনা করেন ছায়ানট, উদীচী, আরণ্যক, কারক, পঞ্চভাস্কর শান্তমারিয়াম ইউনিভার্সিটি ও জলের গানের শিল্পীরা।
১৯৪৩ সালের ২৮ নভেম্বর রফিকুন নবী চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। বাবা রশীদুন নবী ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা। মা আনোয়ারা বেগম। শিল্পী শৈশব-কৈশোরের লম্বা সময় কেটেছে পুরান ঢাকায়। বাল্যকাল থেকেই ছবি আঁকতেন। এ বিষয়ে অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন বাবার কাছ থেকে।
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন প্রতিষ্ঠিত তৎকালীন ‘ইস্ট পাকিস্তান কলেজ অব আর্ট-এ (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ) ভর্তি হন ১৯৫৯ সালে। স্নাতক ডিগ্রি নেন ১৯৬৪ সালে। ছাত্রজীবন থেকেই সংবাদপত্রে লেখা ও অলঙ্করণের কাজে যুক্ত ছিলেন। কর্মজীবন শুরু করেছিলেন সাংবাদিকতা দিয়েই।
১৯৬৪ সালে আর্ট কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭৩ সালে গ্রিস সরকারের বৃত্তি নিয়ে এথেন্সের স্কুল অব ফাইন আর্টসে তিন বছর ছাপচিত্রে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করেন। দেশে ফিরে তিনি ছাপচিত্রের কাঠখোদাই মাধ্যমে নতুন ধারার প্রবর্তন করেন। সেই ধারা শুধু এ দেশেই নয়, উপমহাদেশেও ছিল নতুন ও স্বতন্ত্র।
শিক্ষকতা জীবনে রফিকুন নবী অঙ্কন ও চিত্রায়ণ বিভাগের প্রধান, চারুকলা ইনস্টিটিউটের পরিচালক এবং অনুষদের ডিন হিসেবে দায়িত্ব পালন করে ২০১০ সালে অবসর গ্রহণ করেন।
শিল্পকলা ও সাহিত্য চর্চায় অবদানের জন্য ইমেরিটাস অধ্যাপক রফিকুন নবী দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সম্মান একুশে পদক, সাহিত্য কর্মের জন্য অগ্রণী ব্যাংক শ্রেষ্ঠ শিশু সাহিত্যিক পুরস্কারসহ দেশ বিদেশে বহু পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন।