গৌরাঙ্গ দেবনাথ অপু, নবীনগর (ব্রাহ্মণবাড়িয়া)
প্রকাশ : ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০০:১৬ এএম
আপডেট : ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১০:৫৫ এএম
সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ। সংগৃহীত ছবি
শিবপুর। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলা সদর থেকে মাত্র সাত কিলোমিটার দূরের এক গ্রাম। কিন্তু পৃথিবীতে সংগীতের সমঝদার এমন কেউই বুঝি নেই, যিনি এ নিভৃত গাঁয়ের নাম জানেন না। আর এর কারণ একটাই- এখানেই ১৮৬২ সালের ৮ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন শাস্ত্রীয় সংগীতের বিশ্বখ্যাত সংগীতজ্ঞ, সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ। যিনি বলতেন, ‘সংগীত আমার জাতি আর সুর আমার গোত্র।’ আজ ৬ সেপ্টেম্বর বুধবার তার ৫১তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৭২ সালের এই দিনে তিনি ভারতের মাইহারে মৃত্যুবরণ করেন।
ওস্তাদ আলাউদ্দিনের মায়ের নাম সুন্দরী বেগম। বাবা সবদর হোসেন খাঁ ওরফে সদু খাঁও ছিলেন বিশিষ্ট সংগীতজ্ঞ। তার ডাকনাম ছিল আলম। ছোটবেলায় অগ্রজ ফকির আফতাবউদ্দিন খাঁর কাছে সংগীতে হাতেখড়ি তার। মাত্র ১০ বছর বয়সেই সংগীতের টানে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে এক যাত্রাদলের সঙ্গে যুক্ত হন। একপর্যায়ে কলকাতা গিয়ে প্রখ্যাত সংগীত সাধক গোপাল কৃষ্ণ ভট্টাচার্য ওরফে নুলো গোপালের শিষ্য হতে চান। নুলো গোপাল তাকে একনাগাড়ে নিভৃতে কমপক্ষে ১২ বছর সংগীত সাধনার শর্ত দিলে তিনি তা-ই মেনে নেন। জীবনভর সাধনার মধ্য দিয়ে ওস্তাদ আলাউদ্দিন সংগীতজগতে নতুন যে ঘরানার প্রবর্তন করেন, তা ‘মাইহার ঘরানা’ বা ‘আলাউদ্দিন ঘরানা’ নামে পরিচিত।
সরেজমিন শিবপুর গিয়ে দেখা যায়, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ যে স্থানে জন্ম নিয়েছিলেন, এখন সেখানে ছোট ছোট দুটি টিনের ঘরে সপরিবারে বসবাস করছেন ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর বড় ভাই ফকির আফতাব উদ্দিন খাঁর মেয়ের বংশধর ইদ্রিস খান। ৬৬ বছর বয়স্ক ইদ্রিস খান বলেন, ‘প্রতিবছর জন্ম-মৃত্যুর দিনে সাংবাদিকসহ অনেক গুণী মানুষই এই বাড়িতে আসেন। আমাগো লগে কথা কইয়া যান। কিন্তু সুরসম্রাটের মৃত্যুর ৫১ বছর পরও এই বাড়িটাতে তার স্মৃতি সংরক্ষণের কুনু পদক্ষেপ নেয়া হলো না।’ তিনি জানান, গত দুই বছর আগে এই বাড়িতে সুরসম্রাটের বাবা-মার বিধ্বস্ত কবর দুটি প্রশাসনের উদ্যোগে সংস্কার করা হয়েছে। অন্যদিকে আবার সরকার রাস্তা করার জন্য এই ঐতিহাসিক বাড়ির ১১ শতক জমি অধিগ্রহণ করেছে!
এ বিষয়ে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র ওস্তাদ আয়েত আলীর খাঁর পুত্র, একুশে পদকসহ বিভিন্ন জাতীয় পুরস্কারে ভূষিত সংগীত পরিচালক শেখ সাদী বলেন, ‘বিভিন্ন সময় শুনেছি, শিবপুরে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ পরিবারের স্মৃতি সংরক্ষণে প্রকল্প নেওয়া হবে। কিন্তু কোনো উদ্যোগই বাস্তবে চোখে পড়েনি। বিশ্বখ্যাত এই ওস্তাদ পরিবারটির স্মৃতি সংরক্ষণে কালক্ষেপণ করা ঠিক নয়।’
সরেজমিন দেখা যায়, শিবপুরে যে বাড়িটিতে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁসহ আরও অনেক প্রতিভাধর সংগীতজ্ঞ জন্মেছেন, সেটি এখনও অবহেলিত। বাড়িটিতে সুরসম্রাটের বংশধরদের দুটি ছোট্ট টিনের ঘর, বাবা-মায়ের কবর ছাড়া কিছু নেই। বাড়ির অদূরেই রয়েছে সুরসম্রাটের উদ্যোগে স্থাপিত মসজিদ এবং এ ওস্তাদজির বড় ভাই সংগীতগুরু ফকির তাপস আফতাব উদ্দিন খাঁর সমাধি। এর মাঝামাঝি স্থানে এলাকাবাসীর উদ্যোগে স্থাপন করা হয়েছে ‘সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ মহাবিদ্যালয়।’ তবে এলাকার লোকজন জানান, এলাকাবাসী দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে এলেও শিবপুরে এখনও ‘ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সংগীত জাদুঘর’ স্থাপন করা হয়নি।
শিবপুরে স্থানীয় ‘সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ স্মৃতি সংসদের’ প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, এলাকার কৃষকলীগ নেতা রানা শামীম রতন হতাশা প্রকাশ করে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত শিবপুরে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর স্মৃতি সংরক্ষণে সরকারি বা বেসরকারি কোনো পদক্ষেপ নেওয়া গেল না, একটা কালচারাল মিউজিয়াম কমপ্লেক্স করা গেল নাÑ এটা খুবই দুঃখজনক।’
এ বিষয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রশাসক শাহগীর আলম বলেন, ‘শিবপুরে ওস্তাদজির নামে ‘ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ কালচারাল কমপ্লেক্স’ প্রকল্প সম্পর্কে আমার কিছু জানা নেই। এ সম্পর্কে নবীনগরের ইউএনও হয়তো জানতে পারেন। তবে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শহরে সুরসম্রাট দি আলাউদ্দিন সংগীতাঙ্গনে একটি বড় প্রকল্প প্রক্রিয়াধীন আছে।’
প্রসঙ্গত, ১৯৫৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের কুমারশীল মোড়ে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘সুরসম্রাট দি আলাউদ্দিন সংগীতাঙ্গন’। তবে ২০১৬ সালের ১২ জানুয়ারি মাদ্রাসার ছাত্ররা এবং ২০২১ সালের ২৮ মার্চ হরতাল সমর্থনকারী হেফাজতে ইসলামের কর্মীরা হামলা ও অগ্নিসংযোগ করে এটিকে তছনছ করে দেয়।
নবীনগরের নবাগত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তানভীর শামীম প্রতিদিনের বাংলাদেশকে গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে বলেন, ‘ওস্তাদজির স্মৃতি সংরক্ষণে শিবপুরে শিল্পকলা একাডেমির নেওয়া ‘ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ কালচারাল কমপ্লেক্স’ নির্মাণ প্রকল্প এখন কোন পর্যায়ে আছে, সে বিষয়ে দ্রুত খোঁজ নিয়ে এটি বাস্তবায়নে যথাযথ উদ্যোগ নেব।’
শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক (ডিজি) লিয়াকত আলী লাকীর সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলার জন্য একাধিকবার যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু কথা বলা যায়নি।
স্থানীয় সংস্কৃতিকর্মীরা জানান, ভারতসহ বিশ্বের অনেক বড় বড় সংগীতজ্ঞ এদেশে ওস্তাদ আলাউদ্দিনের জন্মভূমি এই শিবপুরের পুণ্য মাটি স্পর্শ করার উদ্দেশে আসতে চান। কিন্ত শিবপুরে যাতায়াতের রাস্তাটিও চলাচলের উপযোগী নয়। এর নির্মাণকাজ চলছে। যাতায়াতে দুর্ভোগের কথা শুনে অনেকে শিবপুরে আসতে চান না।