নড়াইল প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১৭ জানুয়ারি ২০২৩ ১২:৩৬ পিএম
আপডেট : ১৭ জানুয়ারি ২০২৩ ১৭:০৯ পিএম
এস এম সুলতানের লেখা কয়েকটি চিঠির অংশ। প্রবা ফটো
বিশ্ব বরেণ্য চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান। কৃষক, শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের সঙ্গে পার করেছেন জীবনের বেশি সময়। মানুষের পাশাপাশি প্রাণিকুলের প্রতি ছিল অন্যরকম ভালোবাসা। সেই সুলতান জীবনের বহু সময় কাটিয়েছেন অর্থাভাবে। করেছিলেন অর্থ ধার। সেই ধারের টাকার কিছুটা আবার পরিশোধ করে যেতে পারেননি। বরেণ্য এই চিত্রশিল্পীর লেখা কিছু চিঠিতে পাওয়া গেছে জীবনের সেই দুর্দশার বর্ণনা।
শিল্পী সুলতান জীবনের কঠিন সময়ে যে কয়জন মানুষের কাছে হাত পেতেছিলেন, তাদের একজন নড়াইল শহরের কুড়িগ্রাম এলাকার তাহিদুল ইসলাম আরজান। শহরের রূপগঞ্জ এলাকায় আরজানের রয়েছে একটি ফার্মেসি। সেখানে প্রায় নিয়মিত যাতায়াত ছিল শিল্পীর।
বয়সে আরজান শিল্পীর চেয়ে ছোট হলে দুজনের মধ্যে ছিল ভালো সখ্যতা। সেখান থেকে দুজনের মধ্যে গড়ে উঠেছিল লেনদেনের সম্পর্ক। সেসব নিয়ে তাদের কথা হতো চিঠি ও সুলতানের বিশ্বস্ত কয়েকজন ব্যক্তির মাধ্যমে। তারা হলেন বানছা বিশ্বাস, ওসমান, বিষ্ণু, দুলাল ও রহমান।
সুলতানের মৃত্যু হয় ১৯৯৪ সালের ১০ অক্টোবর। তার কিছুদিন আগে ২৯ সেপ্টেম্বর এক চিঠিতে তিনি লিখেছেন, ‘আরজান, বিষ্ণুকে পাঠালাম। অন্তত তিনশত টাকার সাহায্য করিও।’
একই বছরের ১২ সেপ্টেম্বর লিখেছেন, ‘আরজান কিছু মনে করো না, এই অভাব একটু সুস্থ হলে আর থাকবে না। কারো কাছে বলা যায়না, চালিয়ে নিও।’
এর কয়েক বছর আগে ১৯৯০ সালের ৩ এপ্রিল এক চিঠিতে লিখেছেন, ‘শূন্যহাত, বাজার খরচ নাই। দুলালকে (সুলতানের পালিত পূত্র) ঢাকা পাঠাইয়াছি। হয়তো শিল্পকলা একাডেমি থেকে এক মাসের টাকা পাওয়া যাবে। তিন দিন পর আসবে। তুমি অন্তত দুই শত টাকা ওসমানের (সুলতানের বাসার কেয়ারটেকার) মারফৎ সাহায্য করিও।’
প্রাণিকুলের প্রতি ছিল শিল্পী সুলতানের অগাধ দরদ। সেটির প্রমাণ পাওয়া যায় তার লেখা আরেক চিঠিতে। লিখেছিলেন, ‘আরজান, পশু পাখিদের জন্য যন্ত্রনা আমার সহ্য হচ্ছে না, নিতান্ত অর্থাভাবে আছি। কোন রকম বাজার হচ্ছে না। কিছু ব্যবস্থা কর।’
১৯৯০ সালের ১২ সেপ্টেম্বর লিখেছেন, ‘আরজান চাল কিনতে হবে। জীব জন্তুর দুপুরে রান্না হবে না। কালকের মত একটু কষ্ট করে একটা ব্যবস্থা করিও।’
একই বছরের ৩ অক্টোবর লিখেছেন, ‘আরজান, আজকের বাজারের কোনো ব্যবস্থা হলো না। একটু কষ্ট করে দ্যাখ দেখি সম্ভব হয় কি না। অন্যথায় জীবজন্তু নিযে মুশকিল, ওদের জন্য একটু ভাবো কিছু করতে পার কি না।’
মানুষের দুঃখে পীড়িত হতেন গ্রাম বাংলার মাটির সঙ্গে বেড়ে ওঠা এই চিত্রশিল্পী। একবার চিঠিতে লিখেছেন, ‘আরজান, কুড়ি টাকা রহমানকে দিয়া দিবা, অন্যথায় ওর বাজার হবে না। কদিন তোমাকে বার বার বিরক্ত করছি। মনে কিছু করিও না।’
একই দিন আরেক চিঠিতে লিখেছেন, ‘আরজান, বানছা বিশ্বাস আমাদের বাড়িতে বছর ভরে কাজ করে। খুবই বিস্বস্ত। ভালো মানুষ। ওর জন্য ৫০ টাকা প্রয়োজন।’
পাঁচ বছর ধরে আরজানকে চিঠি লিখেছেন এস এম সুলতান। সংখ্যায় যা ৭০-৭৫টি। কিছু হারিয়ে ফেলেছেন তিনি। বর্তমানে ৪৫টি চিঠি আছে তার কাছে। সেগুলো ল্যামিনেটিং করে বাঁধায় করে রেখেছেন তিনি। সুলতানের সঙ্গে সেই সম্পর্ক নিয়ে এখনও গর্ব করেন আরজান।
বরেণ্য এই চিত্রশিল্পীর ৯৮তম জন্মদিন উপলক্ষে সুলতানের লেখা সেসব চিঠি নিয়ে প্রদর্শনীর আয়োজন করেছেন আরজান। তার দোকানের সামনে সোমবার (১৬ জানুয়ারি) থেকে শুরু হওয়া এ প্রদর্শনী চলবে বুধবার (১৯ জানুয়ারি) পর্যন্ত।
প্রতিদিনের বাংলাদেশের সঙ্গে স্মৃতিচারণ করেন তাহিদুল ইসলাম আরজান। তিনি বলেন, “সুলতান কাকু আমাকে নিজ সন্তানের মতো স্নেহ করতেন। প্রায় তিনি টাকা ধার নিতেন। কিছু অর্থ পরিশোধ করেছেন। কিছু শোধ করতে পানেননি।’
তার ভাষ্য, ‘সবচেয়ে বড় কথা হলো একজন মহান ব্যক্তিকে সাহায্য করেছি। যেটা নিয়ে আমি গর্ববোধ করি। সুলতানের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এবং ভালোবাসা থেকেই এ প্রদর্শনীর আয়োজন করেছি।’