আয়োজন
হাসনাত মোবারক
প্রকাশ : ২৭ নভেম্বর ২০২৪ ০৮:৫৮ এএম
আপডেট : ২৭ নভেম্বর ২০২৪ ২২:৩৫ পিএম
‘নিরাময়ের ঐকতান’ শীর্ষক এক আয়োজেন প্রদর্শিত বাদ্যযন্ত্র দেখছেন দর্শনার্থীরা। মঙ্গলবার ধানমন্ডির আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে। প্রবা ফটো
জারি, সারি, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, মুর্শিদি, মারফতি, মাইজভান্ডারি, সাঁওতালি, বাউল, ঝুমুর, ভাদু, টুসু, কবিগান, পালাগানসহ নানারকম গানের তালে বাজাতে হয় নানা ধরনের বাদ্যযন্ত্র। লোকসংস্কৃতির অন্যতম এই উপকরণকে বলা হয় লোকবাদ্যযন্ত্র। এ যন্ত্র বিভিন্ন উৎসব-পাবর্ণের অনুষ্ঠানেও বাজানো হয়। এসবই আমাদের লোক-ঐতিহ্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
লোকবাদ্যযন্ত্র নিয়ে রাজধানী ঢাকার ধানমন্ডির আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে গত ২৫ নভেম্বর সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘অবকল্প’-এর উদ্যোগে শুরু হয়েছে ‘নিরাময়ের ঐকতান’ শীর্ষক এক আয়োজন। যেখানে প্রদর্শিত হচ্ছে বাংলার নিজস্ব ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর শতাধিক বাদ্যযন্ত্র।
যন্ত্রগুলো গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের সংগঠন অবকল্পের সদস্যদের হাতে বানানো। তারা নিজেরা লোকগান পরিবেশন করেন। সেই সঙ্গে গানের সঙ্গে মিল রেখে বিচিত্র এই যন্ত্রগুলো তৈরি করে থাকেন।
লা গ্যালারিতে প্রবেশ করতেই বামপাশে চোখে পড়ল স্বয়ম্বর নামের কাঠের তৈরি যন্ত্র। তারপাশেই রয়েছে পালকি। প্রাচীন এ বাহনের দুপাশে দুটি লাঠি, তার সঙ্গে হারিকেন। প্রদর্শনকক্ষের দেয়ালে সাজানো বাঁশের তৈরি রঙিন কুলা। এ ছাড়া ঝাঁকি জাল এবং নানা তৈজসপত্র দিয়ে সাজানো হয়েছে দেয়াল। গ্যালারিজুড়েই বিরাজ করছে লোকজীবনের আবহ। এখানে আসার পর যে কারও মনে হতে পারে, কোনো বাদ্যযন্ত্রের হাটেই বুঝি এসেছি!
এখানে দেখা যাবে একতারা এবং নানা ধরনের দোতারা। আছে ১০ প্রকারের বাঁশি। হরেক রকম ঢোলের পাশাপাশি বীণা, করন্ড, ডুগডুগি, ঘণ্টা, খড়তাল, জয়ঢাক, শঙ্খ, তাসা, খেমচা, পাখোয়াজ, মাদল, সানাই, মুহরি, খঞ্জনি, খমক, তবল, টুম্বার, দোতারা, মৃদঙ্গ, সানাই, সরাজ, ঢপ, তবলা, বাউলা বায়া, সেতারা, মন্দিরা, সিংগিং বল, নাকারা, কালিম্বা, ডমরু, জেম্বে, জিপসি, করকা, মানো, মাটির হাঁড়ি, নূপুর, স্বরমন্ডল, ঝাম প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্রের দেখা মিলবে।
এক কোণে সাজানো রয়েছে বাদ্যযন্ত্র বানানোর নানা উপকরণ, হাতুড়ি, বাটাল, আঠা, রঙ-সুতো, কৌটা, পানির পাত্র আরও কত কী! কোনোটির রঙ সরিষা ফুলি আবার কোনোটি কাঁঠালি, মেহগনিসহ কত যে রঙ! যন্ত্র তৈরির প্রাথমিক ধাপ থেকে শেষ স্তর পর্যন্ত উপস্থান করা হয়েছে এখানে।
আরেক পাশে রয়েছে গাছের কাটা গুল। পাশে রয়েছে একটি গাছের চারা। এটি দেখিয়ে অবকল্পের অন্যতম যন্ত্র তৈরির কারিগর এবং শিল্পী আজাদুল ইসলাম রাজার কাছে বিষয়টি জানতে চাইলাম। এ শিল্পী বললেন, আমরা কাঠ কেটে যন্ত্র বানাই। সেই সঙ্গে গাছও লাগাই।’
প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে ১৮৪২ সালে সংকলিত বেহুলা লখিন্দারের কাহিনী নিয়ে রচিত হাতে লেখা ‘বিষহরির পুঁথি’। দুর্লভ এই পাণ্ডুলিপির দুজন সংগ্রাহক ইসমাইল হোসেন এবং আকবর আলী মন্ডল। পাশেই রয়েছে জ্বলন্ত বাতি, যা নির্দেশ করে আমাদের লোকসংস্কৃতি যুগের পর যুগ ধরে আলো ফেলবে।
পাঁচ দিনব্যাপী এ অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন বাউলশিল্পী শফি মণ্ডল। এই উদ্যোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, এখানে দেশীয় যন্ত্র প্রদর্শন করা হয়েছে। আমাদের সংস্কৃতির চর্চার ইতিহাস টানতে গেলে এই বাদ্যযন্ত্রগুলোর নাম উঠে আসে। যন্ত্রগুলো দেখলে বাংলাদেশের লোক-ঐতিহ্য খুঁজে পাওয়া যায়।’
অবকল্পের প্রধান সংগীত গবেষক ও প্রদর্শনীর উদ্যোক্তা জাকির হোসেন বলেন, তিন বছর ধরে বাংলার বাদ্যযন্ত্র নিয়ে নিরীক্ষা করছি। এর অংশবিশেষ নিয়ে এ প্রদর্শনী। ভবিষ্যতে আরও বিশেষ কিছু উপস্থাপন করার ইচ্ছে রয়েছে।’
মঙ্গলবার সকালে ছিল বাংলা ঐতিহ্যবাহী তার বাদ্যযন্ত্র বিষয়ক কর্মশালা এবং বিকালে বাদ্যযন্ত্র বাদন পরিবেশনা ও প্রশ্নোত্তর পর্ব। আজ বুধবার বেলা ১১টায় শুরু হবে বাদ্যযন্ত্রে চিত্রাঙ্কন। এ ছাড়া দিনভর রয়েছে নানা আয়োজন। প্রদর্শনীর অন্য দিনগুলোতেও থাকছে লোকসংস্কৃতি বিষয়ে নানা আয়োজন। লোকবাদ্যযন্ত্র প্রদর্শনীটি ২৯ তারিখ শুক্রবার বেলা ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত থাকছে উন্মুক্ত।
মন্তব্য বইয়ে জাফর আহমেদ নামের এক দর্শনার্থী লিখেছেন ‘আমি এই প্রথম এত বাদ্যযন্ত্র দেখলাম। দেখে অভিভূত হয়ে গেলাম।… এখানে আসা সব দর্শনার্থী মুগ্ধ হয়েছেন।’