প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আয়োজন ৩
ড. রাহমান নাসির উদ্দিন
প্রকাশ : ১৯ মার্চ ২০২৪ ১১:৫০ এএম
আপডেট : ১৯ মার্চ ২০২৪ ১২:০৬ পিএম
ড. রাহমান নাসির উদ্দিন
বাংলাদেশে মোট আদিবাসীর সংখ্যা কত,
তার কোনো সর্বজনগ্রাহ্য উত্তর নেই। কারণ কয়টি আদিবাসী জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে বাস করে এবং
এদের মোট জনসংখ্যা কত, তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান আমাদের জানা নেই। সরকারি পরিসংখ্যান
দরকারি হলেও এই পরিসংখ্যান নিয়ে আদিবাসীদের নানান সন্দেহ আছে এবং একেবারেই অমূলক নয়।
কেননা আমরা জানি সংখ্যার একটা রাজনীতি আছে। সরকারি পরিসংখ্যানে বাংলাদেশে আদিবাসীর
সংখ্যা ১৫ লাখ ৮৬ হাজার ১৪১ (২০১১ সালের আদমশুমারির হিসাব অনুযায়ী)। আবার আদিবাসীদের
দাবি অনুযায়ী বাংলাদেশে আদিবাসীর সংখ্যা ৩০ লাখের ওপরে। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কত
তা নিয়েও গবেষক ও অ্যাকটিভিস্টদের মধ্যে নানান সংখ্যাগত তারতম্য দেখা যায়। কারও কারও
মতে, বাংলাদেশে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ৪৭, আবার কারও কারও মতে ৫৪ লাখ। কিন্তু আমি
বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে আদিবাসী গ্রামগুলোয় নানান সময় সরেজমিনে গিয়েছি, কথা বলেছি,
আদিবাসীদের সঙ্গে থেকেছি, তাদের জীবনের নানান অনুষ্ঠান-প্রতিষ্ঠানে অংশ নিয়েছি। আমার
অভিজ্ঞতা বলে, বাংলাদেশে আদিবাসীর সংখ্যা জনপ্রিয় জানাজানি এবং সংখ্যাকেন্দ্রিক বোঝাবুঝির
চেয়ে অনেক বেশি।
স্থানিক ও আঞ্চলিক বিবেচনায় বাংলাদেশের
আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। সমতলের আদিবাসী ও পাহাড়ের আদিবাসী। পাহাড়ের
আদিবাসী বলতে সাধারণত পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি,
বান্দরবানে বসবাসরত ১১টি জাতিগোষ্ঠীকে বোঝানো হয়। আর সমতলের আদিবাসী বলতে পার্বত্য
চট্টগ্রামের বাইরে প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাসরত আদিবাসীদের বোঝানো হয়। ইতিহাস-ঐতিহ্য,
সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান-প্রতিষ্ঠান, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, রাজনৈতিক ধরন, জীবিকা-অবলম্বন,
প্রতিবেশ-জীবনব্যবস্থা প্রভৃতি নির্দেশক বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে
প্রধানত চারটি ভৌগোলিক অঞ্চলে ভাগ করে উপস্থাপন করা যায়; যাকে একাডেমিক ভাষায় বলা হয়
‘আদিবাসীদের এথনোগ্রাফিক রিজিয়ন’। এক. বৃহত্তর সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ,
শ্রীমঙ্গলের আদিবাসী জৈন্তা, মণিপুরি, খাসিয়া, হাজং, লালেং, পাত্র, কুন্দ প্রভৃতি।
দুই. বৃহত্তর ময়মনসিংহ, নেত্রকোণা, টাঙ্গাইল, মধুপুর, ভাওয়াল অঞ্চলের গারো, কোচ, খাড়িয়া,
বর্মণ, ডালু প্রভৃতি আদিবাসী। তিন. উত্তরবঙ্গের (দিনাজপুর, রংপুর, নওগাঁ, কুড়িগ্রাম,
লালমনিরহাট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, গাইবান্ধা প্রভৃতি বা বৃহত্তর রংপুর এবং রাজশাহী বিভাগে
বসবাসরত) আদিবাসী যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সাঁওতাল, মুন্ডা, ওরাওঁ, মাহাতো, কোড়া, কাদর,
মালো প্রভৃতি। চার. পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, বম,
খুমি, খেয়াং, ম্রো, পাংখোয়া প্রভৃতি।
ক. অন্যান্য আদিবাসী অঞ্চলের
মতো বৃহত্তর সিলেট-মৌলভীবাজার-হবিগঞ্জ-সুনামগঞ্জের আদিবাসীদেরও অন্যতম প্রধান সমস্যা
ভূমি হলেও সেখানে জীবিকার প্রশ্ন এবং পাশের দেশ ভারতের ‘উন্নয়ন’ কার্যক্রমের একটা নেতিবাচক
প্রভাব রয়েছে। কেননা ভারতের সঙ্গে অমীমাংসিত আন্তঃসীমান্ত চুক্তির নানান নেতিবাচক প্রভাবের
কারণে ক্রমান্বয়ে বেদখল হচ্ছে আদিবাসীদের ভূমি। ফলে মণিপুরি, জৈন্তা, খাসিয়া ও হাজংরা
ধীরে ধীরে সিলেটসহ দেশের বড় বড় শহরে অভিবাসিত হচ্ছে এবং দিনমজুরে পরিণত হচ্ছে। তা ছাড়া
ভারতের মেঘালয়ে প্রতিষ্ঠিত উন্মুক্ত কয়লা খনির কারণে খাসিয়া, জৈন্তা ও হাজংদের একটি
অন্যতম পেশা ‘পানের বরজ’ প্রায় ধ্বংস হওয়ার পথে। দীর্ঘদিন ধরে এ সমস্যা চলছে এবং ধীরে
ধীরে প্রকট আকার ধারণ করলেও এ সমস্যার সমাধানে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো কার্যকর উদ্যোগ
গ্রহণ করা হয়নি। এ ছাড়া চলছে ব্যাপক মাত্রার ধর্মান্তকরণ। হতদরিদ্র মানুষের অসহায়ত্ব
পুঁজি করে ধর্মান্তকরণ পৃথিবীর সব দেশেই হয়, কিন্তু বৃহত্তর সিলেট বিভাগের আদিবাসীদের
মধ্যে বর্তমানে যে মাত্রায় ধর্মান্তকরণ হচ্ছে, তাতে এসব আদিবাসী জনগোষ্ঠীর স্বতন্ত্র
বৈশিষ্ট্য এবং সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার রীতিমতো বিলীন হওয়ার পথে।
খ. বৃহত্তর ময়মনসিংহ ও নেত্রকোণা
অঞ্চলের আদিবাসী বিশেষ করে কোচ, খাড়িয়া, বর্মণ, ডালু ও গারোরা ভূমিকে আদিবাসী জীবনজীবিকার
এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিবেচনা করে। সরকারি ও বেসরকারি নানান আদিবাসী অবান্ধব ‘উন্নয়ন’
কার্যক্রমের প্রতিফল হিসেবে বাস্তুচ্যুত হয়ে ময়মনসিংহ, নেত্রকোণা, টাঙ্গাইল, মধুপুর
ও ভাওয়াল অঞ্চলের আদিবাসীরা বিশেষ করে গারো আদিবাসীদের একটা বড় অংশ এখন আদি ভিটামাটি
ছেড়ে ঢাকাসহ দেশের বড় বড় শহরে স্থানীয় অভিবাসী (লোকাল মাইগ্রেন্টর) হিসেবে দিনযাপন
করছে। ঢাকা শহরের বিউটি-পারলারগুলোয় এখন গারো বিউটিশিয়ানদের হামেশা ক্রমবর্ধমান হারে
দেখা যায়। সরকারি ও বেসরকারি এবং প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিপর্যায়ে ভূমি দখলের অব্যাহত
প্রতিযোগিতায় হাজার হাজার গারোর জীবনজীবিকা এখন সংকটাপন্ন। পাহাড়ি আদিবাসীদের জন্য
পার্বত্য চুক্তির আওতায় একটি ভূমি কমিশন গঠন করা হলেও সমতলের আদিবাসীদের ভূমি সমস্যা
সমাধানে কোনো উদ্যোগ এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। যদি সমতলের আদিবাসীদের জন্য একটি
স্বতন্ত্র ভূমি কমিশন করা হয়, তাহলে আদিবাসীদের অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
গ. বৃহত্তর রাজশাহী ও রংপুর
তথা উত্তরবঙ্গের আদিবাসীদের প্রধান পেশা কৃষি; ফলে তাদের জীবিকা ও জীবনের প্রধান অবলম্বন
হচ্ছে ভূমি। শত শত বছর ধরে ভূমিকে আদিবাসীরা ‘মা’ বলে জানে। কারণ ভূমিতেই তাদের জন্ম,
ভূমিই তাদের লালনপালন করে, ভূমিই তাদের আহার জোগায়, ভূমিই তাদের বেঁচে থাকার অবলম্বন
এবং মৃত্যুর পর ভূমিতেই তারা বিলীন হয়। কিন্তু এখন সে ভূমিই তাদের প্রধান সমস্যা এবং
ভূমিই তাদের জীবনমৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শত শত বছর ধরে উত্তরবঙ্গের আদিবাসীরা
যেসব ভূমির মালিকানা বংশপরম্পরায় উত্তরাধিকারসূত্রে সংরক্ষণ করছে, সেসব ভূমি এখন বাঙালি
ভূমিদস্যুরা নানান বাহানায় নানান ছুতায় একের পর এক দখল করে নিচ্ছে। ইতঃপূর্বে আমি পত্রিকান্তরে
লিখেছি, ‘দুর্নীতিগ্রস্ত স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তা, কেন্দ্রীয় রাজনীতির যোগসাজশ ও পেশিশক্তিবলে
আদিবাসীদের শত বছরের বংশপরম্পরায় স্থানান্তরিত ভূমি ক্রমান্বয়ে চলে যাচ্ছে বাঙালি ভূমিদস্যুদের
হাতে।’ উত্তরবঙ্গের আদিবাসী জনগোষ্ঠী বিশেষ করে বৃহত্তর রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের আদিবাসীরা
ক্রমান্বয়ে ভূমিহীন হয়ে পড়ছে। উত্তরবঙ্গের আদিবাসীদের জীবনমৃত্যুর মাঝখানে প্রধান অনুঘটক
হিসেবে হাজির হয়েছে ভূমি। যদি সমতলের আদিবাসীদের জন্য সত্যিই একটি স্বতন্ত্র ভূমি কমিশন
গঠন করা হয়, তাহলে উত্তরবঙ্গের আদিবাসীদেরও অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
ঘ. পার্বত্য চট্টগ্রামের
আদিবাসীদের ইতিহাস-ঐতিহ্য, জীবনাচার, অত্যাচার-নিপীড়ন, আন্দোলন-সংগ্রাম এবং জাতিগত
দ্বন্দ্বের আলেখ্য সমতলের আদিবাসীদের তুলনায় উল্লেখযোগ্য হারে ভিন্ন। পার্বত্য চট্টগ্রামের
আদিবাসী জনগোষ্ঠীর স্বতন্ত্র আত্মপরিচয়ের দাবি কেন্দ্র করে দীর্ঘ দুই দশকের বেশি সময়
ধরে সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ১৯৯৭
সালে রাষ্ট্রের সঙ্গে একটি চুক্তি সম্পাদন করে। কিন্তু চুক্তি সম্পাদনের ২৭ বছর পরও
চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের জন্য পাহাড়ি আদিবাসীদের এখনও আন্দোলন-সংগ্রাম ও প্রতিবাদ-সমাবেশ
করতে হয়। এই অভিমত অমূলক নয় যে, পাহাড়ে কাঙ্ক্ষিত শান্তি আসছে না। কিছুদিন পরপর বাঙালি
বনাম পাহাড়ি সংঘাত এবং পাহাড়ি বনাম পাহাড়ি সংঘাত আমরা দেখতে পাই। এখন চলছে কুকি-চিন
নেটওয়ার্কের নানান ধরনের কর্মকাণ্ড। এ ছাড়া ভূমি সমস্যাও একটি বড় সমস্যা। যেহেতু জুম
চাষই হচ্ছে পার্বত্য আদিবাসীদের জীবনজীবিকার প্রধান অবলম্বন, সেহেতু ভূমি সমস্যা দ্রুত
সমাধান না হওয়ার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর
একটা উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষ নিয়মিতভাবে খাদ্যসংকটে নিপতিত হয়। তবে ১৯৯৭ সালে সম্পাদিত
পার্বত্য চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে পার্বত্য আদিবাসীদের অনেক সমস্যার দ্রুত সমাধান
হয়ে যেতে পারে।
এ নিবন্ধে মূলত বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসরত আদিবাসী জনগোষ্ঠীর একটা সাধারণ পরিচয়, স্থানিক বৈশিষ্ট্য, আঞ্চলিক সমস্যা এবং তাদের জীবনজীবিকার একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র অঙ্কনের চেষ্টা করেছি। তবে এটা মনে রাখা জরুরি, বাংলাদেশের প্রধান চারটি অঞ্চলের বাইরেও বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্তভাবে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বসবাস। এসব আদিবাসীই বাংলাদেশকে একটি সত্যিকার বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির দেশ হিসেবে গড়ে তুলেছে এবং বিশ্বের দরবারে সগৌরবে উপস্থাপন করেছে। রাষ্ট্রশক্তির দায়িত্বশীলতার জায়গা থেকে গুরুত্বের সঙ্গে মনে রাখা উচিত এবং নাগরিকদের মধ্যে সাম্যের আলো ছড়ানোর ব্যবস্থা নিশ্চিত করা জরুরি।