প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আয়োজন ৩
এস এম রানা
প্রকাশ : ১৯ মার্চ ২০২৪ ১১:৪৬ এএম
আপডেট : ১৯ মার্চ ২০২৪ ১২:১৮ পিএম
এস এম রানা
নামে বাণিজ্যিক রাজধানী
হলেও বাস্তবে দেশের আর ১০টি শহরের মতোই চট্টগ্রাম। প্রায় দুই হাজার বছরের ইতিহাস-সমৃদ্ধ
এই নগরীকে বাণিজ্যিক রাজধানীর তকমা দেওয়া হয়েছিল ২০০৩ সালে। সেই ঘোষণার দুই দশক
পরও পরিপূর্ণ বাণিজ্যিক রাজধানী হতে পারেনি চট্টগ্রাম। অবশ্য গেল দশকে চট্টগ্রাম
ঘিরে সরকার একাধিক মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। এসব প্রকল্পের কাজ শেষ হলে এবং
বাণিজ্যিক রাজধানী ঘোষণার সময় যে ১৬টি কর্মসূচি বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছিল, সেগুলো
বাস্তবায়িত হলে চট্টগ্রাম হয়ে উঠবে পরিপূর্ণ বাণিজ্যিক রাজধানী।
দেশের অর্থনীতির
লাইফলাইন সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম ঘিরেই চলে দেশের ৮০ শতাংশের বেশি আমদানি-রপ্তানি
বাণিজ্য। দেশের প্রধান ভোগ্যপণ্যের পাইকারি বাজারও চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে। সব মিলিয়ে
চট্টগ্রাম ঘিরে দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা রাখার অপার সম্ভাবনা। সেই সম্ভাবনায়
আলোকরেখায় এখন বিচ্ছুরিত চট্টগ্রামসহ দেশের আগামীর অর্থনীতি।
চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে নির্মিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল সড়কপথে যুক্ত করেছে কর্ণফুলী ও আনোয়ারা উপজেলাকে। ছবি : নিপুল কুমার দে
চট্টগ্রামে বাণিজ্যিক
গোড়াপত্তন ঘটেছিল বন্দর ঘিরে। সেই সময় বিচ্ছুরণ হওয়া আলোকরশ্মি ক্রমেই সারা দেশকে
অর্থনীতির আলোয় আলোকিত করছে। কর্ণফুলী নদী, বঙ্গোপসাগর ও পাহাড়বেষ্টিত
চট্টগ্রামের পরিধি ক্রমেই বাড়ছে। ক্রমবর্ধমান ধারায় নতুন করে যুক্ত হয়েছে
কর্ণফুলী-আনোয়ারা উপজেলা। সরকারের মেগা প্রকল্প বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
টানেলটি গেল বছরের ২৮ অক্টোবর উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর মধ্য
দিয়ে চট্টগ্রাম মহানগরী যুক্ত হয়েছে কর্ণফুলী নদীর অপরপ্রান্তের আনোয়ারা উপজেলা।
ওপারে কর্ণফুলী ও আনোয়ারা উপজেলা ঘিরে নতুন একটি শহর গড়ে উঠবে, বিদ্যমান
কুরিয়ান ইপিজেডের অদূরে নতুন চায়না ইপিজেড স্থাপিত হচ্ছে। পাশাপাশি দেশীয় শিল্প-কারখানার সঙ্গে পারকি সৈকতে পর্যটনশিল্প বিস্তার হতে শুরু
করেছে। সেই প্রান্তে শিল্প-কারখানা এবং পর্যটকদের কলকাকলি অর্থনীতিকে ঋদ্ধ করবেÑএটাই
বাস্তবতা। ফলে কর্ণফুলীর ওপারে জমির দাম বাড়ছে হু হু করে। বিদ্যমান শিল্প-কারখানার
সঙ্গে নতুন শিল্প-কারখানা যুক্ত হয়ে সেই জনপদে নতুন শহর বিস্তৃত হবেÑএটা
সুনিশ্চিত। এতে দেশের অর্থনীতি আরও সমৃদ্ধ হবে। তবে নতুন শহরের মাস্টারপ্ল্যান দ্রুতই চূড়ান্ত করা উচিত হবে সংশ্লিষ্টদের।
টানেল ছাড়াও সরকার
বন্দর ঘিরে একাধিক প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। চট্টগ্রাম বন্দরের কাছাকাছি বঙ্গোপসাগর
তীরে বে-টার্মিনাল বিশাল অর্থনৈতিক সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করবে বলে আশা করছে
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। ২০২৩ সালের ২ আগস্ট বিশ্বব্যাংকের
এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, টার্মিনালের অপটিমাইজড অপারেশন থেকে
বার্ষিক ৩৬৩ মিলিয়ন ডলার অর্জনের সম্ভাবনা রয়েছে। ২০২৯ সালে কার্যক্রম চালুর
লক্ষ্যে এগিয়ে নেওয়া বে-টামির্নালটি চালু হলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং
প্রতিযোগিতামূলক স্থানকে আরও শক্তিশালী করবে।
বে-টার্মিনাল ছাড়াও
চট্টগ্রামের অর্থনীতির বাতিঘর হিসেবে চিহ্নিত আরেকটি প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে।
পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনাল নামের প্রকল্পটি গত ১৪ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন
করেছেন। এরপর ৬ ডিসেম্বর টার্মিনালটি পরিচালনার জন্য সরকার সৌদি আরবের রেড সি
গেটওয়ে টার্মিনাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ২২ বছরের জন্য চুক্তি করে। পতেঙ্গা কন্টেইনার
টার্মিনাল প্রকল্পটি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে আশার বাতিঘর হিসেবে
দেখছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। ১ হাজার ২২৯ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত
টার্মিনালটিতে ৫৮৪ মিটার লম্বা জেটিতে একসঙ্গে তিনটি জাহাজ ভেড়ানো যাবে। আরেকটি
জেটিতে তেল খালাস হবে। আধুনিক স্বয়ংসম্পূর্ণ টার্মিনালটি বন্দরের সক্ষমতা আরও
বৃদ্ধি করবে এবং নিরবচ্ছিন্ন বাণিজ্য সহজতর করার পাশাপাশি কর্মসংস্থান ও নতুন
উদ্যোক্তা সৃষ্টির পথও সুগম করবে।
বন্দর যখন আর্থিক
প্রবৃদ্ধির স্বপ্ন দেখাচ্ছে তখন বন্দরসহ পুরো মহানগরীর যানবাহন চলাচলে গতি আনতে
চালু হয়েছে মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী সিডিএ এক্সপ্রেসওয়ে। যানজটে প্রায় স্থবির
মহানগরীতে গাড়ির গতি বাড়াতে এই প্রকল্প কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
প্রায় ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই উড়ালপথ ধরে মহানগরীর লালখান বাজার থেকে সরাসরি পতেঙ্গা
গিয়ে পৌঁছবে যানবাহন। একই সঙ্গে এটিকে যুক্ত করা হচ্ছে আখতারুজ্জামান
উড়ালপথের সঙ্গেও। সেই অর্থে বহদ্দারহাট থেকেই সরাসরি পতেঙ্গা পৌঁছানো যাবে
উড়ালপথে। এই উড়ালসড়ক চট্টগ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থায় গতি এনেছে।
দুই হাজার বছরের চট্টগ্রাম নগরীতে উন্নয়নের
প্রশস্ত দুয়ার খুলে দিয়েছে বঙ্গবন্ধু টানেল।
আর মিরসরাইয়ের বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরী ছড়াচ্ছে সমৃদ্ধির পূর্বাভাস। এই শিল্পাঞ্চল পরিপূর্ণ কার্যকর হলে অন্তত ১৫ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি আয়
সম্ভব হবে বলে ধারণা করছে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল
কর্তৃপক্ষ (বেজা)। চট্টগ্রাম মহানগরী থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরে ঢাকা-চট্টগ্রাম
মহাসড়কের পশ্চিম পাশে বঙ্গোপসাগরের তীরে প্রায় ৩৪ হাজার একর জমিতে গড়ে উঠছে এই
শিল্পনগরী। সেখানে আগামী ১৫ বছরের মধ্যে ১৫ লাখ লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে বলেও
আশা করে বেজা। পুরোদস্তুর প্রস্তুত না হলেও কয়েকটি শিল্প-কারখানা এরই মধ্যে উৎপাদন
কার্যক্রম শুরু করেছে। সব মিলিয়ে আনোয়ারা-কর্ণফুলীর মতো মিরসরাই-ফেনীর উপকূলীয় এলাকাও হয়ে উঠবে নতুন শিল্প শহর। এতে সমৃদ্ধ হবে দেশের অর্থনীতি।
সরকার এরই মধ্যে
চট্টগ্রাম-ঢাকা মহাসড়ককে ছয়-আট লেন এবং চট্টগ্রাম-কক্সবাজার
মহাসড়ক চার-ছয় লেনে উন্নীত করার উদ্যোগে নিচ্ছে। সন্দেহ নেই, মিরসরাই, আনোয়ারা-কর্ণফুলীর
শিল্পাঞ্চল এবং আগামীর বে-টার্মিনাল ও ট্রান্স এশিয়ান হাইওয়ে নেটওয়ার্কের কারণে
ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে যানবাহনের চাপ বাড়বে। সেই পরিস্থিতি সামাল দিতে
এখন থেকেই সরব হচ্ছে সরকার।
যদিও
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার ঘিরে অর্থনৈতিক জোন, সমুদ্রবন্দর, বিদ্যুৎকেন্দ্র, এলএনজি
টার্মিনাল, মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দর কিংবা সড়ক ও আকাশ যোগাযোগে একাধিক প্রকল্প বাস্তবায়িত
হয়েছে। এরপরও এই অঞ্চলের শিল্প-কারখানা মালিকদের বাণিজ্যিক সেবার প্রয়োজনে ছুটতে
হয় ঢাকায়। তাই ঢাকার ওপরই বেশি নির্ভরতা। অথচ বাণিজ্য সহায়ক সুবিধা থাকার কারণেই
চীনের সাংহাই,
যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক এবং ভারতের মুম্বাই বাণিজ্যিক শহর
হয়েছে। আর বাণিজ্য সহায়ক সুবিধা না থাকায় বাস্তবে বাণিজ্যিক রাজধানী হতে পারছে না
চট্টগ্রাম। এটিই চট্টগ্রামের জন্য বড় বাধা। আমদানি-রপ্তানি প্রধান নিয়ন্ত্রকের
দপ্তর থেকে ৫৫টি সেবা দেওয়া হয়। এর মধ্যে ২৮টি সেবা নিতে হয় ঢাকার কার্যালয় থেকে।
একইভাবে শিল্প-কারখানার ব্রয়লার বসানোর নিবন্ধন, অনুমতি, পুরোনো
জাহাজ আমদানির দাপ্তরিক কাজ, কোম্পানি নিবন্ধন, পোশাক
কারখানার যন্ত্রপাতি আমদানির প্রত্যয়নপত্র, রাজস্ব বোর্ডের প্রজ্ঞাপন
সংগ্রহসহ সবকিছুই ঢাকা থেকে সংগ্রহ করতে হয়।
অথচ ২০০৩ সালের ৬ জানুয়ারি চট্টগ্রামকে বাণিজ্যিক রাজধানী ঘোষণার সময় ১৬টি
কর্মসূচি বাস্তবায়নের আওতায় বলা হয়েছিল, যেকোনো একটি ব্যাংক বা বীমা
কোম্পানির সদর দপ্তর চট্টগ্রামে স্থানান্তর হবে। এ ছাড়া শিক্ষা, প্রশাসনিক, যোগাযোগ, পর্যটন, বন্দরসহ
যেসব সরকারি প্রতিষ্ঠানের আঞ্চলিক দপ্তর চট্টগ্রামে রয়েছে, সেগুলোর
ক্ষমতা বাড়ানো হবে। কিন্তু সেসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হয়নি। অবশ্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রামকে সত্যিকারের বাণিজ্যিক রাজধানীতে পরিণত
করার সব ধরনের কার্যক্রম বাস্তবায়ন হবে বলে উল্লেখ করেছেন নানা সময়ে। এখন সেই প্রশাসনিক
বা বাণিজ্যিক সেবা কার্যক্রমগুলো চট্টগ্রাম থেকে দেওয়া শুরু হলে চট্টগ্রাম হয়ে
উঠবে সত্যিকারের বাণিজ্যিক রাজধানী। এতে নিঃসন্দেহে দেশের অর্থনীতি এগিয়ে যাবে।