প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আয়োজন ৩
মোহন আখন্দ
প্রকাশ : ১৯ মার্চ ২০২৪ ১১:২২ এএম
আপডেট : ১৯ মার্চ ২০২৪ ১২:০৭ পিএম
মোহন আখন্দ
দই আর লাল মরিচের জন্য বিখ্যাত বগুড়া শিল্পনগরী হিসেবেও পরিচিত। গত শতাব্দীর ষাটের দশকে বগুড়ায় ব্যাপক শিল্পায়নের ক্ষেত্রে সবচেয়ে সহায়ক ভূমিকা রাখে স্থানীয় ফাউন্ড্রি শিল্প। ফাউন্ড্রি অর্থ ঢালাইবিদ্যা। মূলত পুরোনো লোহা আগুনে গলিয়ে ছাঁচে ঢেলে নির্দিষ্ট আকারের যন্ত্র কিংবা যন্ত্রাংশ তৈরি করা হয় বলেই এ ধরনের শিল্পকে ফাউন্ড্রি বা ঢালাই শিল্প বলা হয়। ফাউন্ড্রি এমন একটি শিল্প যেখানে প্রয়োজন অনুযায়ী নানা ধরনের যন্ত্র বা যন্ত্রাংশ তৈরি করা সম্ভব। আর সে কারণে ফাউন্ড্রি শিল্পকে ‘মাদার ইন্ডাস্ট্রি’ হিসেবেও গণ্য করা হয়। এ শিল্পসম্পৃক্ত প্রবীণ কারিগরদের ভাষ্যমতে, ব্রিটিশ আমলে তৎকালীন বার্মা অর্থাৎ বর্তমান মিয়ানমারে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে লোহা গলিয়ে তাদের প্রয়োজনীয় যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ তৈরি করা হতো। সে সময় কিছু বাঙালিকেও এ কাজে সম্পৃক্ত করা হয়েছিল। পরে তাদের মাধ্যমেই ফাউন্ড্রি শিল্প বগুড়াসহ কয়েকটি জেলায় বিস্তৃতি লাভ করে। সরকারি-বেসরকারি সমন্বিত উদ্যোগ নিলে এবং সময়ের চাহিদা অনুসারে আধুনিকায়ন করা গেলে ঐতিহ্যবাহী ফাউন্ড্রি শিল্পই হতে পারে বগুড়া অঞ্চলের অর্থনীতির অন্যতম প্রাণভোমরা।
বগুড়ায় ফাউন্ড্রি শিল্পের কারখানায় কর্মরত এক শ্রমিক। ছবি : লেখক
মজিবর রহমান ভাণ্ডারি প্রতিষ্ঠিত ‘ভাণ্ডারি শিল্প
গ্রুপ’-এর মাধ্যমে ১৯৬৫ সালে বগুড়ায় ফাউন্ড্রি শিল্পের যাত্রা হয়।
শহরের শিববাটি এলাকায় ভাণ্ডারি গ্রুপের সেই কারখানাটির নাম ছিল ‘ভাণ্ডারি আয়রন
ওয়ার্কস লিমিটেড’। ফাউন্ড্রি শিল্পের কারিগররা এতটাই দক্ষ ছিলেন যে, কোনো যন্ত্র বা যন্ত্রাংশ
একবার দেখলেই তা তৈরি করতে পারতেন। তাদের এ দক্ষতার কারণেই সে সময়
শিল্পোদ্যোক্তাদের কলকারখানা স্থাপনে আগ্রহী করে তোলে। জানা যায়, সে সময় ভাণ্ডারি গ্রুপের কটন স্পিনিং
মিল, গ্যাস ফ্যাক্টরি, ম্যাচ ফ্যাক্টরি, অয়েল মিল, সোপ ফ্যাক্টরির যন্ত্র বা যন্ত্রাংশ ব্যবহার
অনুপযোগী হয়ে পড়লে ফাউন্ড্রি কারখানার কারিগররা তা আবার নতুন করে
তৈরি করে দিতেন। স্থানীয় জামিল গ্রুপ, তাজমা সিরামিক,
জাহেদ মেটালও এ ফাউন্ড্রি কারিগরদের সহযোগিতা নিত।
প্রথম দিকে বগুড়ার ফাউন্ড্রি কারখানাগুলোয় সরিষার
তেলের ঘানি তৈরি করা হতো। পরে রান্নার কড়াই, পণ্যের ওজন মাপার বাটখারা এবং
কৃষিকাজে ব্যবহৃত কোদাল, মাছ ধরার জালের কাঠিসহ আরও কয়েক ধরনের পণ্যের উৎপাদন শুরু
হয়। এসব পণ্যের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ফাউন্ড্রি কারখানার সংখ্যাও বাড়তে থাকে। পরে
কৃষিকাজে শ্যালো ইঞ্জিনচালিত সেচযন্ত্রের ব্যবহার বেড়ে গেলে স্থানীয় উদ্যোক্তারা
সে যন্ত্রের সঙ্গে ব্যবহৃত সেন্ট্রিফিউগাল পাম্প বা পানি উত্তোলনের পাম্প তৈরি শুরু করেন। দামে সুলভ হওয়ায় খুব অল্প সময়ের মধ্যে তারা
সফলতাও পান। উৎপাদিত এসব যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ
লেদ শিল্প বা লাইট ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে বাজারজাত শুরু হয়। ফলে সেচযন্ত্রের
দামও কৃষকের হাতের নাগালে চলে আসে।
বাজারে ব্যাপক চাহিদার কারণে কৃষিকাজে ব্যবহৃত নতুন
নতুন যন্ত্র বা যন্ত্রাংশের উৎপাদনে আরও মনোযোগী হন স্থানীয় ফাউন্ড্রি শিল্প
মালিকরা। বগুড়ায় উৎপাদিত এসব পণ্য সারা দেশে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। একসময় দেশের
কৃষিযন্ত্র বা যন্ত্রাংশের বাজারের সিংহভাগ দখল করে নেয় বগুড়ার ফাউন্ড্রি শিল্প।
পানি উত্তোলনকারী পাম্প দেশের বাজারে চাহিদা মিটিয়ে ভারতেও রপ্তানি শুরু হয়। এক
দশক আগেও দেশে কৃষি ও সেচ যন্ত্রাংশের
মোট চাহিদার ৮০ শতাংশের জোগান দিত বগুড়ার ফাউন্ড্রি শিল্প। ব্যাপক চাহিদার কারণে
বগুড়া বিসিক শিল্পনগরীসহ শহরের ভেতরে ও বাইরে একে একে ৭০টি ফাউন্ড্রি কারখানা গড়ে
ওঠে।
শুধু কৃষি খাতেই নয়, বগুড়ায় ক্ষুদ্র, মাঝারি ও ভারী শিল্পের ব্যাপক
প্রসারের পেছনেও ফাউন্ড্রি শিল্পের ব্যাপক অবদান রয়েছে। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ
পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, ২০০৩ থেকে পরবর্তী ১০ বছরে
বগুড়ায় কুটির ও মাইক্রো শিল্পের পাশাপাশি মাঝারি এবং বড় ধরনের কলকারখনার সংখ্যা
গড়ে ৪৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। বগুড়ায় অন্যান্য কলকারখানা সম্প্রসারণেও স্থানীয় ফাউন্ড্রি এবং এর ওপর
নির্ভরশীল লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পের বড় ভূমিকা রয়েছে।
সঠিক ব্যবস্থাপনা এবং যথাযথ সহযোগিতার অভাবে বগুড়ার এসব ফাউন্ড্রি কারখানার
অনেকটিই বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে বিসিকের ভেতরে পাঁচটিসহ জেলাজুড়ে ৪০টি ফাউন্ড্রি কারখানা সচল
রয়েছে। এসব কারখানার মধ্যে অন্তত তিনটি তাদের উৎপাদনব্যবস্থা আধুনিকায়ন করেছে।
অন্যগুলোও আধুনিকায়নের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কারখানাগুলোয় পাওয়ার টিলার বা
চাষযন্ত্রের বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রাংশ এবং লেদ মেশিন, করাতকল (স-মিল), চিঁড়াকল, অটো রাইস মিল, ফ্লাওয়ার মিল ও টেক্সটাইলের
যন্ত্রাংশ,
মোটরগাড়ির
স্প্রিং,
ব্রেক ড্রাম, গ্রান্ডিং মেশিন, অয়েল মিল ও জুট মিলের যন্ত্রপাতি
তৈরি করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে যুক্ত
হয়েছে কম্বাইন
হারভেস্টার (শস্য কর্তনের যন্ত্র), অটোমোবাইলের যন্ত্রাংশ, রেলের চাকা, রেল ইঞ্জিনের ব্রেক ও স্টিলের যন্ত্রাংশও তৈরি হচ্ছে।
ফাউন্ড্রি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এফওএবি)
হিসাব অনুযায়ী,
বগুড়ায়
বর্তমানে ফাউন্ড্রি কারখানায় অন্তত ৪ হাজার শ্রমিক কাজ করছে। এ ছাড়া ফাউন্ড্রি শিল্পে উৎপাদিত পণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণের (ফিনিশিং) জন্য
শহরজুড়ে গড়ে ওঠা সহস্রাধিক লেদ শিল্পে (লাইট
ইঞ্জিনিয়ারিং) কর্মরত রয়েছে আরও অন্তত ১০ হাজার শ্রমিক। অর্থাৎ বগুড়ায় ফাউন্ড্রি
কারখানা এবং এর ওপর নির্ভরশীল লেদ শিল্পে সব মিলিয়ে প্রায় ১৪ হাজার শ্রমিকের
কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে।
এসব কারখানায় বছরে অন্তত ১ লাখ মেট্রিক টন পণ্য উৎপাদন হয়। প্রতি মেট্রিক টন ১ লাখ ৫০
হাজার টাকা হিসাবে এর বাজারমূল্য দাঁড়ায় দেড় হাজার কোটি টাকা। তবে উৎপাদিত এসব
পণ্য লেদ মেশিনে ফিনিশিং করার পর তার মূল্য পৌনে ২ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। এ ছাড়া
ফাউন্ড্রি শিল্পে কর্মরত ৪ হাজার শ্রমিক এবং লেদ শিল্পে কর্মরত আরও ১০ হাজার
শ্রমিকের বেতনভাতা বাবদ প্রতি মাসে ১০ কোটি টাকা করে বছরে ব্যয় হয় আরও ১২০ কোটি
টাকা। বিপুল অঙ্কের এ অর্থের সিংহভাগ বগুড়ায় ঘূর্ণায়মান থাকায় জেলার অর্থনীতি বেশ শক্ত অবস্থানে
রাখতে ভূমিকা রাখছে এ শিল্প।
ফাউন্ড্রি এমন একটি শিল্প যেখানে প্রয়োজন অনুযায়ী সব ধরনের যন্ত্র বা যন্ত্রাংশ তৈরি করা সম্ভব।
কিন্তু নানা কারণে সম্ভাবনাময় এ
শিল্পটিও এখন বেশ চ্যালেঞ্জের মুখে। এ চ্যালেঞ্জ
মোকাবিলায় কতগুলো শর্ত পূরণ জরুরি হয়ে পড়েছে। শর্তগুলো খুব কঠিন কিছু নয়। তবে
সিদ্ধান্তটি আসতে হবে নীতিনির্ধারক পর্যায় থেকে।
প্রতিযোগিতামূলক বাজারে বগুড়ার ফাউন্ড্রি শিল্পকে টিকে থাকতে হলে উৎপাদনব্যবস্থার আধুনিকায়ন, নতুন নতুন পণ্য উৎপাদন এবং রপ্তানি বাজারের দিকে দৃষ্টি রাখা জরুরি। সেই সঙ্গে সবার আগে প্রয়োজন দক্ষ কর্মী। কর্মীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, টেস্টিং ল্যাব স্থাপন এবং সাঁচের সংস্কার জরুরি হয়ে পড়েছে। বগুড়ায় কোনো টেস্টিং ল্যাব না
থাকায় ঢাকায় গিয়ে টেস্ট করাতে হয়। এতে একদিকে উৎপাদন খরচ বাড়ে, তেমন সময়েরও অপচয় হয়।
ফাউন্ড্রি শিল্পের আধুনিকায়ন করা গেলে শুধু কৃষি কিংবা
মেটাল সেক্টরেই নয়, দেশের গার্মেন্ট শিল্পে ব্যবহারের জন্য এখন যেসব খুচরা
যন্ত্রাংশ বিদেশ থেকে আমদানি করা হচ্ছে, সেগুলোও স্থানীয়ভাবে তৈরি করা সম্ভব হবে।
পাশাপাশি ইউরোপের দেশগুলোয়ও রপ্তানির দ্বার খুলে যাবে। তখন বছরে অন্তত ১ হাজার
কোটি টাকার পণ্য রপ্তানি করা সম্ভব হবে। এজন্য স্বল্প সুদে ঋণের পাশাপাশি সরকারি
পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন। যদি তা না পাওয়া যায় তাহলে একসময় এ শিল্পের উৎপাদনব্যবস্থা
টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। অন্যদিকে শর্তগুলো পূরণ করতে পারলে
এ ফাউন্ড্রি শিল্পই তৈরি করে দিতে পারে বগুড়ার আগামী দিনের উন্নয়নরেখা।